রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে আত্মঘাতী রাজনীতিকায়ন


ব্যাংক খাত যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ধরনের এক সহায়ক শক্তি। সে জন্য প্রতিটি দেশই চায় দেশের ব্যাংক খাত যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। আর ব্যাংক খাত সুষ্ঠুভাবে চলার প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে গোটা ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। দেশের অর্থনৈতিক চাহিদা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে নেয়া হবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যাবতীয় সিদ্ধান্ত। এর বাইরে গেলেই বিপত্তি। ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য, যদি এ খাতের ওপর নেমে আসে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক প্রভাব। সবচেয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে তখন, যখন ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও ব্যাংক-কর্মকাণ্ড পরিচালনার লাইসেন্স দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। সেই সাথে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়দায়িত্ব যথাযোগ্য পেশাজীবীদের ওপর অর্পণ না করে তা অর্পিত হয় অভিজ্ঞতাহীন ও পেশাসংশ্লিষ্ট জ্ঞানহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ওপর। অথচ রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণ চিন্তা-চেতনা ও দলীয় স্বার্থান্বেষণ বিবেচনায় আমাদের দেশে ব্যাংক কোম্পানির অনুমোদন ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালকেরা ব্যাংক খাতের সঙ্কট সময়ের সাথে বাড়িয়েই চলেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য ব্যাংকগুলোর রাজনৈতিক পরিচালকেরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রধানমন্ত্রীর কোনো কোনো উপদেষ্টার নামেও এ কেলেঙ্কারির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। মোট কথা, ব্যাংকগুলো সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না রাখার ফলে এ ধরনের বড় কেলেঙ্কারি ঘটানো সম্ভব হয়েছে। হলমার্ক গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের যে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তা আদায়ও নাকি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি উদঘাটনে গঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে। প্রতিবেদন মতে, এই পরিমাণ ঋণের অর্থের বিপরীতে হলমার্কের সমুদয় সম্পদের আর্থিক মূল্য মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। আর বিনিয়োগ করা টাকার পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। বাকি টাকার কোনো হদিস নেই। সরকারি দলের লোকদের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবেই এমন ভয়ঙ্কর কেলেঙ্কারি ঘটানো সম্ভব হয়েছে। তবুও সরকারের শিক্ষা হয় না। দীর্ঘ তিন মাস নানা টালবাহানার পর গত ২০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার অবশেষে সরকারি সাত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে ৩১ জন পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব পরিচালক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার আগের মতোই রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়ার রীতিই অনুসরণ করেছে। এবারের পরিচালক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেনÑ রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, সাবেক ব্যাংকার ও সরকারি কর্মকর্তা। রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছেনÑ সরকারদলীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কট্টর সাবেক নেতারাও। এদের কয়েকজন আগের দফায়ও বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তাদের পেশাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে সরকারকে প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে এ সমালোচনা আরো বেশি তীব্র হয় হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাওয়ার পর।

এবারের এসব পরিচালক নিয়োগ দেয়ার এক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড ব্যাংকটির গভর্নরকে পরামর্শ দিয়েছিল, তিনি যেন সরকারি ব্যাংকের পরিচালক পদে কোনো অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগে সম্মতি না দেন। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০০৯ সালে সরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় অনেক লোককে পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়। এর এক বছর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভিযোগ করে, এসব পরিচালকের অনেকেই ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ মিশন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, ব্যাংক পরিচালক নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাপকাঠি মেনে চলতে। কিন্তু সে মাপকাঠি বিবেচনায় না নিয়ে পরিচালক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বিবেচনায় আনা যেখানে একটি অবশ্য পালনীয় বিষয় ছিল, সেখানে তা ও মানা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংক কার্যক্রমে প্রকৌশলী বা চিকিৎসা পেশার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এসব পেশার লোকদেরও এবার ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটি যে কেউ স্বীকার করবেন, আর্থিক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদেরই সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া উচিত। অনেক সাবেক ব্যাংকার রয়েছেন, তাদের ভাবমর্যাদাপূর্ণ কর্মজীবন ও সুনাম রয়েছে। পরিচালক পদে যদি তাদের নিয়োগ দেয়া যেত, এতে করে ব্যাংক খাত সুষ্ঠুভাবে চলার একটা সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু দলবাজ সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগের আরেকটি মন্দ উদাহরণ এ সরকার আবার সৃষ্টি করল।
২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল সরকারি তিন ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদকে অধিকতর কার্যকর, দক্ষ ও পেশাভিত্তিক করতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে অর্থনীতিবিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষ ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী নিয়োগের কথা বলা হয়। প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পেশাজীবী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলা হলেও এবার তা দেখা যায়নি।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শাহ এ এম এস কিবরিয়া অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে একটি ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠন করেছিলেন। সে কমিটি ১৯৯৯ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল : ‘পরিচালনা পর্ষদ এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে, যারা ব্যাংক ব্যবসায় ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন ও যাদের অধীনে ব্যাংক কর্মকর্তারা সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অনুপ্রেরণা পাবেন।’ কমিটির সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ছিল, কোনো সংসদ সদস্য বা কোনো রাজনৈতিক দলে কোনো ধরনের পদে আছেন এমন কাউকে পরিচালক করা যাবে না।
১৯৯৮ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে তিন খণ্ডের একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সে প্রতিবেদনেও বিশ্বব্যাংক কোনো অবস্থাতেই রাজনীতিবিদদের সরকারি ব্যাংকের পরিচালক করা যাবে না বলে সুপারিশ করে। কারণ, এতে ব্যাংকের রাজনীতিকায়ন হয় এবং স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটে।
২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ সরকার এক সার্কুলার জারি করে ব্যাংক পরিচালকেরা কী করতে পারবেন না, তা বলে দেয়। এতে বলা হয়Ñ পরিচালকেরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ, ব্যাংকের রুটিন কিংবা প্রশাসনিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ততা, ব্যাংকের কোনা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোনো বিষয়ে নির্দেশনা দান, কোনো ঋণপ্রস্তাবে জামিনদার এবং কাউকে কোনো সুবিধা দেয়ার বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে প্রভাবিত করবেন না। অথচ পর্ষদ এসব কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় অর্থমন্ত্রীকে ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি চিঠি দিয়ে পর্ষদ পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদিতে পর্ষদ সদস্যরা সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করছেন।’ এই চিঠিও সংশ্লিষ্টরা আমলে নেননি। নিলে আজ আমরা বড় বড় যেসব ঋণ কেলেঙ্কারির কথা শুনছি, হয়তো তা শুনতে হতো না।
সে যাই হোক, এবার সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের ৪৬টি শূন্য পদের মধ্যে ৩১টি পদে পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলো। বাকিদের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। অনেকের ধারণা, বাকি পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পাবে। পেশাদারিত্বের বিবেচনা হবে গৌণ ও উপেক্ষিত। এবার রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া অনেকের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা উঠে এসেছে।
এবার কৃষি ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মশিয়ুর রহমান হুমায়ুন। তিনি এর আগে বিডিবিএলের পরিচালক ছিলেন। অগ্রণী ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার। আগের বার তিনি জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। এ ব্যাংকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক আবদুস সবুর পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এ ব্যাংকে এবার পরিচালক হয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম এ রউফ সরদার। সমালোচকদের প্রশ্নÑ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছেড়ে ব্যাংকের পরিচালক পদে আসীন হয়ে তিনি ওই ব্যাংকের কোন নাক-কান-গলা কাটবেন? বিডিবিএলে পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ এপতার হোসেন। জনতা ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সহসম্পাদক নাগিবুল ইসলাম। সোনালী ব্যাংকে পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন মনিসিং-ফরহাদ স্মৃতি স্ট্রাস্টের সম্পাদক শেখর দত্ত। জনতা ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু নাসের। সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হলেন রাজবাড়ী আওয়ামী লীগ নেতা মো: নজিবর রহমান। এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আবারো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে এ সরকার ব্যাংক খাতকে নতুন করে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয়ার পথটুকুই পাকাপোক্ত করতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের অভিমত।
আমরা এর আগেও সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছুসংখ্যক পরিচালক নিয়োগ হতে দেখেছি। কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় এর আগে কখনোই এত বেশি নিয়োগ দেখা যায়নি। এ সরকারের আমলেই ব্যাংকগুলোতে প্রথমবারের মতো নিম্ন সারির নেতাকর্মীদের পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখনো এই প্রবণতা বিদ্যমান। এ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অতীত কোনো পেশা ছিল না। পরিচালক পদটাই তাদের পেশায় পরিণত হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের এই রাজনীতিকায়ন ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খারাপ করে তুলেছে। এতে ব্যাংকের শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়েছে, বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে চলেছে। সরকারি ব্যাংক হলেও বেসিক ব্যাংক একটি আদর্শ ব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। এখন এ ব্যাংকটিও সমস্যায় পড়েছে।
প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংকের পরিচালক করা হয়েছে শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই। মূলত দলীয় লোকদের আনুগত্যের পুরস্কার দিতেই তাদের ব্যাংকের পরিচালক করা হয় বা হচ্ছে। ব্যাংকের পরিচালক হতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের আগ্রহই বেশি দেখা গেছে (প্রথম আলো ২০.১২.১২)।
বর্তমান সরকারের আমলে সরকারের বিভিন্ন সময়ে জারি করা বিভিন্ন পরিপত্র ও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে সরকারি ব্যাংকগুলো ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি যখন প্রবল সমালোচনার মুখে, তখন ব্যাংক খাতে এক নতুন মাত্রার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর। প্রশ্ন হচ্ছেÑ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর কী করে নতুন অনুমোদন পাওয়া ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হতে পারেন? তিনি কি আইনকানুন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে? সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের মতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর মন্ত্রী পদে বহাল থেকে ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেশের সংবিধানের পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কিছু বাস্তব উদাহরণের কথা এরই মধ্যে উল্লেখ করেছেন। এসব উদাহরণ থেকে এটুকু স্পষ্ট, কেউ মন্ত্রী পদে থাকলে তাকে কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকা চলবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার ইব্রাহিম খালিদ বলেছেন, কারো মন্ত্রী থাকা অবস্থায় একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা আইনসিদ্ধ নয়। সাবেক মন্ত্রী আবদুল জলিলকে বাণিজ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে হয়েছিল। একইভাবে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস যখন গণপূর্ত মন্ত্রী হন, তখন তাকে ঢাকা ব্যাংকের উপদেষ্টা পদ ছাড়তে হয়েছিল। ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে মন্ত্রী পদে থাকা অবস্থায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের লাভজনক পদে আসীন থাকায় কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও সংবিধান তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছেÑ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, মহা হিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নির্বাচন কমিশনার ও সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য এই রূপ কোনো পদে নিযুক্ত বা কর্মরত ব্যক্তি কোনো লাভজনক পদ কিংবা বেতনাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল হবেন না কিংবা মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যযুক্ত কোনো কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় বা পরিচালনায় কোনোরূপ অংশ নেবেন না।
অতএব মহীউদ্দীন খান আলমগীর যখন গত ১৩ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখনই তিনি কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ধরে রাখার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। অতএব তিনি ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ এখনো ধরে রাখায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। উল্লেখ্য, সরকারের উচ্চপর্যায়ের চাপের মুখে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় গত ৮ এপ্রিল নতুন ৯টি ব্যাংক কোম্পানির অনুমোদন দেয়। এই ৯টি ব্যাংকেরই একটি হচ্ছে ফার্মার্স ব্যাংক। এই ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার সময় মহীউদ্দিন খান আলমগীর পাবলিক অ্যাকাউন্টস সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তিনি ওই ব্যাংকের ১৩ পরিচালকের একজন ছিলেন। গত ১৬ অক্টোবর লাইসেন্স নেয়ার জন্য যখন ওই ব্যাংকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়া হয়, তখন মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নাম এর চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।
প্রখ্যাত আইনবিদ শাহদীন মালিক সংবিধান আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, মহীউদ্দীন খান ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে থেকে সুস্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তার সাথে একমত পোষণ করে আর্থিক বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, মহীউদ্দীন খানের জন্য কোনো সুযোগ নেই প্রস্তাবিত ব্যাংকটির পরিচালনার কাজে যুক্ত থাকার। তিনি বলেন, যেখানে এ ব্যাপারে সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে, অতএব এ নিয়ে অন্য কোনো বিধিবিধান দেয়ার প্রয়োজনও নেই।
অতএব এখন দেখার বিষয়, মহীউদ্দীন খান কোনটা বেছে নেবেন। মন্ত্রী থাকবেন, না ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকবেন। তাকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে। এই দু’টি পদ একসাথে ধরে রাখার শক্তি এ দেশের কোনো ব্যক্তির নেই। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ তো আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস সৃষ্টি করে গেছেন, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরও যদি এর বাইরে গিয়ে কিছু করতে হয়, তবে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসম্পন্ন আওয়ামী লীগ চাইলে তা সহজেই করতে পারে। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার জন্য আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আওয়ামী লীগ পারে না, এমন কিছু নেই। প্রয়োজন শুধু তাতে দলের স্বার্থ থাকা। দলীয় স্বার্থে আজ ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ তো সে প্রবণতারই একটি অংশ। নইলে এত সব কেলেঙ্কারি, এতসব সমালোচনার পরও কেন আবার ব্যাংক খাতের এই নির্লজ্জ রাজনীতিকায়ন, যেখানে আমরা দেখছি এই রাজনীতিকায়ন ব্যাংক খাতকে এরই মধ্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। জন্ম দিয়েছে অভূতপূর্ব সব ব্যাংক কেলেঙ্কারির।

1 টি মন্তব্য:

Ads