রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ও আওয়ামী ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট


বিশ্বজিৎ দাসের ওপর হামলাকারী কেউ ছাত্রলীগের নয় বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দাবি করা হয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এ দাবি করেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির মানুষ হত্যা করে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা তাদের একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমে নাম আসা আপাত অভিযুক্তদের ছয়জনের পরিচয় তুলে ধরেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া পৌরসভার চরকৈলাশ গ্রামে। তার বাবা মাওলানা মহীউদ্দিন সুখচর আজফারুল উলুম ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল। তার বড় ভাই সাব্বির আহমেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের বড় নেতা ছিলেন। অভিযুক্ত ও আটক রফিকুল ইসলাম শাকিল পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলার বাসিন্দা। তার বাবা আনসার আলী খলিফা স্থানীয় কর অফিসের অবসরপ্রাপ্ত পিয়ন। তিনি বিএনপির সমর্থক। শাকিলের বড় ভাই সহিদুল ইসলাম শাহিন পটুয়াখালী পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। মাহফুজুর রহমান নাহিদ ভোলার বিভিন্ন মাদরাসা থেকে আলিম ও ফাজিল পাস করেন। তার বাবা স্থানীয় জামায়াতের নেতা। তার নানা মৃত ইউনুস রাজাকার ছিলেন। তার মামারা বিএনপির সমর্থক। নাহিদের বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হল শাখা শিবিরের সভাপতি। তিনি ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা মামলার আসামি। আর মোহাম্মদ নূরে আলমের বাড়ি রংপুরের পীরগাছায়। তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, ছিনতাই, অপহরণসহ একাধিক মামলা রয়েছে। ইমদাদুল হকের বাড়ি যশোরের শার্শায়। তার চাচা শাহজাহান আলী জামায়াতের কর্মী এবং স্থানীয় সামটা মাদরাসার প্রিন্সিপাল। সাইফুল ইসলামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদীতে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র। তিনি এও বলেন, খুনি ও সন্ত্রাসীরা কোনো দলের নয়। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেয়ার পর দেশবাসী বিস্মিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্নÑ যেখানে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ও মুদ্রণ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ ও ছবি থেকে এটুকু সুস্পষ্ট যে, ছাত্রলীগের ছেলেরাই প্রকাশ্যে রাজপথে কুপিয়ে হত্যা করেছে বিশ্বজিৎ দাস নামের নিরীহ পথচারীকে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে কেন হত্যাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা চালানো হলো। আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবী বলে সুপরিচিত ড. আনোয়ার হোসেন ও খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, কী দরকার ছিল প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেনÑ খুনিদের খুনি বলতে বাধা কোথায়? ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তার প্রেস সচিবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য সংবাদ সম্মেলনে প্রচার করা হয়েছে, তাতে কয়েকজন অভিযুক্তের পরিবারের সদস্যদের বিএনপি ও জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়েছে, কারো পরিবারের সদস্য কোনো মাদরাসার প্রিন্সিপাল। কেউ মাদরাসায় লেখাপড়া করেছে। এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে জনমনে এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয় যে, এই অভিযুক্তরা সেই সূত্রে জামায়াত-বিএনপির লোক। আর এরাই বিশ্বজিৎকে খুন করে এর দায় ছাত্রলীগের ওপর চাপাতে চাইছে। তাহলে প্রশ্ন জাগেÑ যারা আওয়ামী ওলামা লীগের হয়ে আজ সরকারের পক্ষে কাজ করছেন, তাদের লেখাপড়ার পটভূমি কী? এরা কি অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের লেখাপড়া করা কেউ? এরা কি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত নন? তা ছাড়া বর্তমান সরকারে এমন অনেক মন্ত্রী বা এমপি আছেন, যাদের পরিবারের আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন না বা করতেন না, কেউ কেউ স্বাধীনতাবিরোধী বলেও পরিচিত। তাই বলে পরিবারের এক সদস্যের ভুলের জন্য কি অন্য সদস্যকে অভিযুক্ত করার কোনো আইনি কিংবা নৈতিক ভিত্তি আছে। আইনে স্বীকৃত সত্য হচ্ছে, ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের দায় ব্যক্তিবিশেষের; অন্য কারো নয়।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগের কোনো বড় নেতা ভুল-শুদ্ধ যাই বলেন, তার সমর্থনে প্রচার-প্রচারণার জন্য এই দলটিতে স্তাবকের অভাব হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, বিশ্বজিৎ হত্যার সাথে যারা জড়িত, তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কেউ বিশ্বাস করেননি, বরং প্রধানমন্ত্রীর মতো এত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য শুনে মানুষ বিস্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা বক্তব্য শুনেছি মন্ত্রী হাছান মাহমুদের কাছ থেকে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর মতো একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তির পরিধি ও তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বজিৎকে হত্যাকারী কেউ ছাত্রলীগের নয়। এরা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি বিশ্বজিতের পরিবারের কেউ বিশ্বাস করেন না। কারণ বিশ্বজিৎকে হত্যার দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ তারা বারবার দেখেছেন, পত্রপত্রিকায় ছবি দেখেছেন, যাতে এটুকু স্পষ্ট হয়, কারা কিভাবে বিশ্বজিৎকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
গত শুক্রবার হিন্দু মহাজোট আয়োজিত ঢাকার এক সমাবেশে বিশ্বজিতের চাচাতো ভাই নবীন দাস বলেন, তার ভাইকে হত্যার দায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর কিছুতেই এড়াতে পারেন না। জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নেতারা বলেন, দেশে পুলিশ-র‌্যাব থাকা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনিদের রাস্তায় নামিয়ে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এর দায়দায়িত্ব তিনি কখনোই এড়াতে পারেন না। সবিশেষ উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দাবি করেন বিশ্বজিতের খুনের দায়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তখন পুলিশ বলে মাত্র একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে জনমনে এমন বিশ্বাস জন্মে যে, সরকার বিশ্বজিতের খুনিদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ জন্য মিথ্যার আশ্রয় পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। তারই প্রতিফলন হয়েছে গত ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত এক অনলাইন ভোট জরিপে। সেখানে প্রশ্ন ছিল : বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন কি? এর জবাবে ‘হ্যা’ বলেছেন ৯.২১ শতাংশ পাঠক। ‘না’ বলেছেন ৬.২৮ শতাংশ পাঠক। মন্তব্য নেই ০.২১ শতাংশ পাঠকের।

দেশবাসী বলছে, কিছু দূরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক ডজন পুলিশের নীরব ভূমিকার মধ্যে বিশ্বজিৎকে যারা হত্যা করেছে, তারা ছাত্রলীগেরই লোক। এখন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগ তা করেনি। এমনি বিতর্কিত প্রেক্ষাপটে দৈনিক প্রথম আলো তাদের বিভিন্ন স্থানের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রণীত একটি নিজস্ব প্রতিবেদন ছাপে গত শুক্রবার। এর শিরোনাম ছিলÑ ‘পরিবার ও নেতারা বলছেন হামলাকারীরা ছাত্রলীগ কর্মী।’
এই প্রতিবেদন মতে, বিশ্বজিৎ হত্যা ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এইচ এম কিবরিয়া আওয়ামী লীগেরই কর্মী। কিবরিয়ার গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার চেংগুটিয়ায়। তার বাবা আতিকুর রহমান হাওলাদার সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার। তার গ্রামের বাড়িতে গেলে কিবরিয়ার বাবা প্রথম আলোকে বলেন, আগে কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করে কিবরিয়া। কিবরিয়ার বড় ভাই আসাদুজ্জামান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরিবারে সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক।
রাজন তালুকদারের ধারালো অস্ত্রের আঘাতেই বিশ্বজিৎ বেশি আহত হন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারাই। রাজনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। এ সময় লোকজন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, রাজন স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। রাজনের বাবা সুসেন চন্দ্র একজন মুক্তিযোদ্ধা ও হোমিও চিকিৎসক। তিনি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, রাজন ছাত্রলীগের রাজনীতি করে। সে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়কের (সাবেক) কাছাকাছি থাকে। গত মঙ্গলবারের পর থেকে তার সাথে যোগাযোগ নেই।
একই কথা বলে গত শুক্রবার গ্রেফতার হওয়া সাইফুলের পরিবার। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ির পূর্বপাড়ায়। তার মা বলেন, ‘আমার পোলা এই খুনের লগে থাকলে এই বিচার তো আমি আটকাইয়ে রাখতে পারুম না।’ সাইফুলের এলাকার সহপাঠীরা প্রথম আলোকে বলেছেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সাইফুল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দলীয় প্রভাবেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংদী ছাত্রকল্যাণ ঐক্য পরিষদের সভাপতি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে জায়গা করে নিতে তিনি রাজনীতিতে আরো সক্রিয় হন।
রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওনের গ্রামের বাড়ি খুলনার পাইকগাছার নাসিরপুর গ্রামে। বুধবার তিনি বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গণমাধ্যমে নাম ছাপা হওয়ার পর তিনি গা-ঢাকা দেন। তার বাবা লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেডা ভালো ছিল, গ্রামে কোনো দল করত না। ঢাকায় যাওয়ার পরে ছাত্রলীগ করা শুরু করল। তখন আমি ওকে মিছিল-মিটিংয়ে যাতি নিষেধ করেছি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবদুল্লাহ আল-মামুনের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার খলিলপুর সরদারপাড়ায়। বাবা সাদেকুল ইসলাম একটি মাদরাসার সুপার। আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা বলেন, মামুনকে এরা ঢাকার ছাত্রলীগের একজন বড় ছাত্রনেতা হিসেবেই জানেন। সাদেকুল ইসলাম বলেন, এরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে ভালো করেই চেনেন। নির্বাচনের সময় তিনি এই সংসদ সদস্যের পক্ষে প্রচারকাজ চালিয়েছেন। চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কুপিয়েছেন রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল। তার বাবা আনসার মিয়া কর বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। আনসার মিয়া বলেন, ‘পটুয়াখালী থাকার সময় শাকিলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঢাকার রাজনীতিতে জড়িয়ে সে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে।’ অবশ্য শাকিলের বড় ভাই শাহিন মিয়া পটুয়াখালী যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে আনসার মিয়া জানিয়েছেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন মতে, আরেক অভিযুক্ত মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদের বাড়ি ভোলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের খায়েরহাটে। বাবা মাওলানা আবদুর রহমান দক্ষিণ জয়নগর হোসাইনিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। বর্তমানে খায়েরহাট বাজার মসজিদের ইমাম। মাহফুজ ওই মাদরাসা থেকেই দাখিল ও আলিম পাস করেন। বড় ভাই মাকসুদুর রহমান একটি দাখিল মাদরাসার শিক্ষক। মাহফুজ ও ইমদাদুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফুল ইসলামের কর্মী।
অভিযুক্ত ইমদাদুল হকের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচকয়রা গ্রামে। বছর তিনেক আগে মারা গেছেন বাবা আকরাম আলী। ছোট ভাই জাকির হোসেন ভ্যান চালিয়ে ও দিনমজুরি করে সংসার চালান। ইমদাদের চাচা শাহজাহান আলী শার্শা উপজেলার সামটা সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক। ইমদাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তার খোঁজখবর রাখি না। বাড়িতে সে কখন আসে কখন যায়, আমি বুঝতে পারি না। তার হাবভাবে যতটুকু বুঝেছি, সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
মীর মো: নূরে আলম ওরফে লিমন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার শুল্লিপাড়া গ্রামের মীর মো: নুরুল ইসলামের ছেলে। নুরুল ইসলাম বংশানুক্রমে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে জানান তিনি। তার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত যাদের নাম-ছবি গণমাধ্যমে এসেছে এবং যাদের ডিবি গ্রেফতার করেছে, তাদের প্রত্যেকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষের কর্মী। মাহফুজ ও ইমদাদুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফুল ইসলামের কর্মী। শাকিল, রাজন, শাওন, সাইফুল, উজ্জ্বল, কিবরিয়া ও কাইয়ুম সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের পক্ষের কর্মী। তাদের বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপনাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক জহির উদ্দিন ওরফে বাবরের পক্ষের কর্মী ছিলেন।
গত শুক্রবার বিশ্বজিতের অভিযুক্ত সাত খুনির বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করে ডেইলি স্টারের ‘মার্ডারার্স ইনডিড লিঙ্কড টু বিসিএল’ শীর্ষক শীর্ষ সংবাদে বলা হয়েছে, এরা ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন গ্রুপের নেতার কর্মী। একই সময় এর দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম ছিল এমনÑ ‘কিলার্স নট বিসিএল ম্যান : কেইমস পিএমও, সারপ্রাইজ অল’। এভাবে দেশের প্রতিটি পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যে চারজনকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, বহিষ্কারের পরেও এরা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। বিশ্বজিৎকে হত্যার মাত্র ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর এদের অনেকেই ছাত্রলীগের অন্য নেতাদের সাথে মিছিল করতে দেখা গেছে। এদের নামোল্লেখ করে ডেইলি স্টার গত শুক্রবার প্রথম পাতায় ছবি ছাপিয়েছে। তা ছাড়া ঘটনার পরদিন অভিযুক্ত হত্যাকারী নাহিদকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির জন্মদিনে যোগ দিতে দেখা গেছে। এর ছবিও ছাপা হয়েছে ডেইলি স্টারে। তা ছাড়া আজ কয়েক দিন ধরেই বারবার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে বিশ্বজিতের হত্যার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ঘুরেফিরে দেখানো হচ্ছে। এসব ভিডিও ফুটেজে খুনিদের চেহারাও সুস্পষ্ট। এর পরও প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা গুয়েবলসীয় কায়দায় বলে বেড়াচ্ছেনÑ বিশ্বজিৎকে যারা হত্যা করেছে, তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের ছেলেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, চাকরিবাণিজ্য, অন্তর্দলীয় খুনোখুনি থেকে শুরু করে হেন অপরাধ নেই যেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। বিশ্বজিৎ হত্যার বিষয়টি নিয়ে যখন সারা দেশে তোলপাড় তখনো এদের চাঁদাবাজি থেমে নেই। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোর শীর্ষ সংবাদ এর প্রমাণ। এর শিরোনামÑ ‘চাঁদা না দিলে প্রাণ যাবে’। এই খবরে বলা হয়, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বড় ও মাঝারি প্যাভিলিয়ন বানাতে হলে চাঁদা দিতে হবে, নইলে প্রাণ যাবে। শেরেবাংলা নগর কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এই নির্দেশ জারি করেছেন। রিপোর্টে এই চাঁদাবাজির বিশদ বিবরণ রয়েছে। কারা কিভাবে এই চাঁদাবাজি প্রক্রিয়ায় জড়িত, তাদের নামধাম উল্লেখ করা হয়েছে এ রিপোর্টে। রিপোর্টটি ছিল এতই সুনির্দিষ্ট যে, এবার আওয়ামী লীগের পক্ষে বলার কোনো সুযোগ ছিল না এসব চাঁদাবাজ ছাত্রলীগের কেউ নয়। ফলে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ কৃষি প্রশিক্ষণ ইউনিট সংশ্লিষ্ট কমিটি বাতিল ও অভিযুক্ত এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক এনামুলকে বহিষ্কার করতে হয়েছে।
আসলে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগ তো বটেই, এমনকি এর মুরব্বি সংগঠন আওয়ামী লীগের জন্য একটি কলঙ্কের বোঝা হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে নিজের জন্য এমনি আরো নানা কলঙ্কের জন্ম দিয়েছে। এসব কেলেঙ্কারিতে আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো শীর্ষ সারির নেতার বিরুদ্ধে নানামাত্রিক অভিযোগের কথা উঠেছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি কেলেঙ্কারি, রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা কেলেঙ্কারি। আওয়ামী লীগ সরকার সব ক্ষেত্রেই এসব কেলেঙ্কারির নায়কদের চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’ বলে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে তাদের বাঁচাতে চেয়েছে। সবশেষে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তদেরও একইভাবে কিন সার্টিফিকেট দিয়ে তাদের বাঁচাতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু চাইলেই কি আর সব রক্ষা হয়। এরই মধ্যে অনেক কেলেঙ্কারির নায়কদের উইকেট পতন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। এখনো যদি আওয়ামী লীগ সাবধান না হয়, তবে আরো অনেক উইকেটের পতন ঘটবে এ কথা নিশ্চিত। আওয়ামী লীগের কোনো ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তখন কোনো কাজে আসবে না। তবে সাবধান হলে মঙ্গল হবে আওয়ামী লীগেরই।
আওয়ামী লীগ সাবধান হবে, সে ভরসা পাওয়ার সুযোগ কোথায়? বিশ্বজিৎ হত্যার বিষয়টি নিয়ে যখন সারা দেশে হইচই, তখন দেশবাসী জানল দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ ছাড়া পেলেন কঠোর গোপনীয়তায়। এমনটিই আমরা জানলাম প্রথম আলোসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে। প্রথম আলো জানিয়েছে, কঠোর গোপনীয়তায় কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস (৪৬)। শুক্রবার সকাল সোয়া ৮টায় কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের সন্ত্রাসী কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানানো হয়। বছর বছর ধরে এ রীতি মেনে চলা হচ্ছে। কিন্তু বিকাশের ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনার কারণে নি¤œ আদালত থেকে বিকাশের জামিন দেয়া হয়। আদালত থেকে জামিনের কাগজ কারাগারে পৌঁছানো থেকে তার মুক্তি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই কঠোর গোপনীয়তায় সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল, বিকাশকে বিশেষ ব্যবস্থায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিকাশ ১৫ বছর ধরে কারাবন্দী ছিলেন। কারাগারে বসেই মোবাইল ফোনে চলত তার চাঁদাবাজি। প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেন বিকাশকে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে এভাবে গোপনে ছেড়ে দেয়া হলো? এর পেছনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। অতএব প্রশ্ন থেকেই যায়Ñ এর পেছনে কী রহস্যই বা লুকিয়ে আছে। একটি পত্রিকায় দেখলাম, বিশেষ কিলিং মিশন নিয়েই বিকাশকে এবার রহস্যজনকভাবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ছাড়া হয়েছে।
সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি দেখে আরো প্রশ্ন জাগেÑ সরকার এ কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে? আওয়ামী লীগের মতো একটি জনসংশ্লিষ্ট দলের এ কোন পরিণতি। দলটির নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে আজ দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন রাজনৈতিক জট। এ জট খোলার কোনো প্রয়াস নেই এ দলটির পক্ষ থেকে। দলটির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে আজ সারা দেশ দুই ভাগে বিভক্ত। জাতীয় ঐক্য ভূলুণ্ঠিত। এখন বড়ই প্রয়োজন যেখানে জাতীয় ঐক্যের, সেখানে সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভাজনের নানা উপাদান। আঁকড়ে ধরে রাখা হচ্ছে অসহিষ্ণু রাজনীতিকে। জানি না, এর শেষ কোথায়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads