শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১২

সরকারের সর্ষের মধ্যেই ভূত



সাদেক খান
এবারের বিজয় দিবস উদযাপনে উৎসবমুখরতা বর্ণনায় কোনো কোনো দৈনিকে শিরোনাম হয়েছে : ‘জাতীয় ঐক্যের আহ্বান মহান বিজয় দিবসে’। অন্য দৈনিকে এসেছে : ‘ফুল হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি লকণ্ঠে’। বাস্তবতা ছিল একটু ভিন্ন। সাভার স্মৃতিসৌধে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যেও ছিল চাপা আতঙ্ক, সংঘর্ষের আশঙ্কা। ঐক্যের বুলি ছিল কপট কথকতা মাত্র। পত্রপত্রিকারই বিস্তারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিজয় দিবসে সাভারের রাস্তায় কয়েকটি স্থানে অনেক লোককে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এতে স্থানীয় লোকজনসহ সাভারে আগতদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। প্রকাশ, মতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের কর্মীরা আধিপত্য বিস্তারের জন্য লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।
প্রত্যদর্শী জানান,  প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলে স্থানীয় এমপি মুরাদ জংয়ের কর্মীরা ভোর থেকে স্মৃতিসৌধের মূল গেটসহ আশপাশের এলাকা দখল করে রাখেন। তারা ব্যানার-ফেস্টুন ও লাঠি হাতে করতে থাকেন শোডাউন। ভোর সাড়ে ৬টায় প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যাওয়ার পরও তারা অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। অন্য দিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা: দেওয়ান মো: সালাউদ্দিন বাবু, সাভার পৌরমেয়র রেফাতুল্লাহ, কাউন্সিলর খোরশেদ ও মেজর (অব:) মিজানুর রহমানের পৃথক গ্র“প খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কর্মীরাও লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করেছেন।
পুষ্পস্তবক অর্পণ করে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী সাভার ত্যাগ করার পরপরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে শোডাউন করতে থাকেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধের গেট, জয় রেস্তোরাঁ, পেট্রল পাম্পসহ আশপাশ এলাকায় অবস্থান নেন। আর বিএনপির দেওয়ান সালাউদ্দিন, রেফাতুল্লাহ এবং খোরশেদ, মিজান গ্রুপের নেতাকর্মীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর বাসস্ট্যান্ড, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, গোকুলনগর বিশমাইল এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় দু’দলের নেতাকর্মীরা নানা ধরনের উসকানিমূলক স্লোগান দিতে থাকেন। স্থানীয় লোকজনের আশঙ্কা ছিল যেকোনো মুহূর্তে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। আরো খবর : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা দেয়া হয়। সাভারের উদ্দেশে রওনা করার আগ মুহূর্তে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রটোকল গাড়িটি গুলশান থানায় নিয়ে ৪৫ মিনিট আটকে রাখে। এর ফলে বেগম খালেদা জিয়ার সাভারে রওনা করতে বিলম্ব ঘটে। বিজয় দিবসের আগের রাত ভোর হওয়ার আগ থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের বাসভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ভোর ৬টার দিকে বেগম খালেদা জিয়ার প্রটোকল গাড়িটি গুলশান থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে ৪৫ মিনিট আটকে রেখে পরে এটি ছেড়ে দেয়া হয়।
রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার পর থেকেই বিভিন্ন দল ও সংগঠনের তরফে পুষ্পস্তবক অর্পণের পাশাপাশি গায়ে পতাকা রঙের জামা এবং কপাল, হাতে ও মাথায় লাল-সবুজের চিহ্ন নিয়ে জনতার বাঁধভাঙা ঢল ছুটেছিল স্মৃতিসৌধের দিকে। নাটক, দেশাত্মবোধক গান, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখরিত ছিল স্মৃতিসৌধ এলাকা। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নামে লাখো মানুষের ঢল। এই জনস্রোতের মধ্যে ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান’ নামধারী একটি সংগঠন একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের দাবিতে স্মৃতিসৌধের বেদির পাশে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করে। সংগঠনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইমন রহমান বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান আমির এবং বিএনপির দুই নেতাসহ যে ১১ জনের মামলা চলছে, ইতোমধ্যে সেগুলোর কয়েকটি শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে শুনেছি। কাজেই আমরা আশা করছি, ২৬ মার্চের আগেই মামলার রায় ঘোষিত হবে।’
তবে মার্চে স্বাধীনতা দিবসের আগে নয়, আগামী বছর ডিসেম্বরে পরবর্তী বিজয় দিবসের আগেই যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হবে বলে সাংবাদিকদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। পরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে ট্রাকের ওপর নির্মিত অস্থায়ী মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের বিজয় শোভাযাত্রা উদ্বোধনকালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন : ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে এবং রায় কার্যকর হবে, এটাও অনেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। যে নেত্রীর নেতৃত্বে (শেখ হাসিনা) বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং রায় কার্যকর হয়েছে, তার নেতৃত্বেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে; অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কোনো শক্তির মতা নেই যুদ্ধাপরাধীদের রা করার। খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের সাথে ঐক্য গড়ে তুলেছেন। তাদের বিচার যাতে শেষ না হয়, সে জন্য তিনি হরতাল ডেকেছেন। এই হরতাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নয়, যুদ্ধাপরাধীদের রার জন্য।’ ওদিকে বিএনপির সমন্বয়ক ও দলের মুখপাত্র তরিকুল ইসলাম বিজয় দিবস উপলে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেন : ‘প্রধানমন্ত্রীর হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত। এই বিজয়ের মাসে তার নিজস্ব বাহিনী বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করেছে। সারা দেশে এরকম অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে আওয়ামী লীগ বিজয়ের মাসে অসংখ্য লাশ উপহার দিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করাই বিজয় দিবসে বিএনপির অঙ্গীকার।’
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিএনপিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও নিরপে মানদণ্ডে।’
জামায়াতে ইসলামী ‘মহান বিজয় দিবস উপলে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠান’ করেছে ঢাকা মহানগর কমিটির উদ্যোগে। সেখানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেছেন, ‘শুধু পতাকা অর্জনের নামই কোনো দেশের সত্যিকারের স্বাধীনতা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা হলো, ুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। ুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি। দুর্নীতি আর লুটপাট আমাদেরকে অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যখনই মতায় এসেছে তখনই তারা জনগণের সম্পদ লুটপাট করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে। ুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ল্েয সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।… আওয়ামী লীগ সরকার যা করছে সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। দেশের বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সবই চলছে এখন মতাসীন দলের ইচ্ছামতো। দেশে আজ গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিন ধরে স্বাধীনতার প-বিপ বলে জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করে আসছে। কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তারা জাতিকে বিভক্ত করার চূড়ান্ত অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কথিত বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূলের যে গোপন মিশন শুরু করেছিল, তা এখন জাতির সামনে প্রকাশ হয়ে গেছে। এত বড় কেলেঙ্কারির পর এই বিচার আর এক দিনও চলতে পারে না। অবিলম্বে অবৈধ ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে হবে।’
এবারের বিজয়ের মাসের উৎসব যে সঙ্ঘাতপ্রবণ আর সরকারবিমুখ ছিল, সে কথা এসেছে ভারতীয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ঢাকা থেকে প্রেরিত বিজয় দিবসসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদনে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পুরাতন ওই দৈনিকে বলা হয়েছে : ‘চোরাগোপ্তা খুন, অগ্নিসংযোগ, হিংসাত্মক হরতাল, সন্ত্রাসের আশঙ্কা। বাংলাদেশের এই সার্বিক থমথমে আবহে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আবেগকেই আবার ফিরে দেখার কৌশল নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এখানে পা দেয়ার পর দেখা যাচ্ছে একই শহরের দুই মুখ। এক দিকে হিংসা, অন্য দিকে বিজয় দিবসের মোড়কে জাতীয়তাবাদের উৎসব। রাজপথে অসংখ্য পোস্টার-ফেস্টুনে বন্দুক হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাদা-কালো ছবি। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অসংখ্য অতিথি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ইমিগ্রেশন কর্মীরা। অন্য দিকে শহরের নিরাপত্তা একবারেই যুদ্ধকালীন।’…
১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে ’৭১-এর যুদ্ধে শামিল হওয়া ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর-লেফটেন্যান্টসহ ৬৩ জন ‘বন্ধুর’ হাতে খেতাব তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার কথায়, নতুন প্রজন্ম, যারা এই যুদ্ধ সম্পর্কে জানেন না বা যারা ভুলে  গেছেন, তাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াসেই বিজয় উদযাপন… চার দিকে সাজ সাজ রব। একাত্তরকে যেন পুনর্নির্মাণ করে তুলে ধরা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে।…
বিএনপিসহ আঠারো দলের বিরোধী জোটের ঐক্যের ছবিটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ১৫ দিন ধরে একটার পর একটা সরকারবিরোধী কর্মসূচি, হরতাল সফল হচ্ছে। অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গিপনা ক্রমেই চড়া হচ্ছে। সরকারি হিসাবে বলছে, গত এক সপ্তাহে প্রায় দেড় শ’টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে বাংলাদেশে। গ্যারাজে গিয়েও আগুন লাগানো হয়েছে পুলিশের গাড়িতে। জখম পুলিশের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে।
ভোট শতাংশ বা সংসদে আসন বেশি না হলেও জামায়াতের প্রভাব বাংলাদেশে যথেষ্ট বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। অনেকের মতে, ইসলামি দলগুলো সংসদীয় নির্বাচনে আসন জেতার তুলনায় বেশি মনোযোগী হয়েছে বাংলাদেশের সমাজকে ইসলামিকরণ করার দিকে। সেই সূত্র ধরেই জামায়াতের ভারতবিরোধী স্বরটিও সমর্থন পাচ্ছে।… নভেম্বরে ভারত থেকে ফেরার পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দিল্লি-বিরোধিতা কমেছে, সেদিকেও নজর রেখেছেন জামায়াত নেতৃবৃন্দ। কিন্তু হাসিনার বিরুদ্ধে বিএনপিকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করাটাই তাদের ল্য। তাই বিএনপিকে আবার পুরনো জায়গায় নিয়ে আসার একটা চেষ্টা থেকেই যাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষণার কথা ছিল চলতি সপ্তাহে। খালেদা জিয়ার সময়ের জামায়াতের কয়েকজন নেতা-মন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে, এমনটা ভাবা গিয়েছিল। বিএনপি নেতা আবদুল আলিম, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরও একই পরিণতি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু বিজয়ের এ মাসেই শাস্তি ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে উসকে দেয়া যে আওয়ামী লীগের ‘ডিসেম্বর পরিকল্পনা’, তা বুঝতে পেরে হিংসাত্মক অবরোধে নেমেছে জামায়াত ও বিএনপি। ফলস্বরূপ শাস্তি ঘোষণা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে হাসিনা সরকার। সব মিলিয়ে উৎসব ও আতঙ্ক দু’টিরই সহাবস্থান এখন বাংলাদেশে।’
তবে সরকারপ ‘ফুল হাতে যারা যুদ্ধাপরাধের দ্রুত বিচারের দাবি’ করে চলেছেন এবং ১৮ ডিসেম্বর জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সিপিবি-বাসদ নেতৃত্বে বামজোট যে সরকার-সমর্থিত হরতাল পালনের জন্য বাস চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা করে রাজধানীসহ অনেক শহরে ‘শান্তিপূর্ণ অচলাবস্থা’ সৃষ্টি করেছেন, সেই ুদ্রপ এ দেশের ‘ইসলামি চেতনা’ নির্মূল করার বাদ্যকার হিসেবে সরকারেরই সাঙ্গাত। যতই ‘ষড়যন্ত্র’, ‘ষড়যন্ত্র’ বলে আওয়াজ তুলুন না কেন, রাজনৈতিক বাজিমাতের মতলবের কারণে আর বিচারব্যবস্থার দলীয়করণজাত অত্যুৎসাহের বিভ্রমে চলমান যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সে জন্য বিরোধীপরে ষড়যন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। কারণ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত প্রথম ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজেই স্কাইপিতে দীর্ঘ দূরালাপনি আইনি সংলাপের আড়ালে বিচারবহির্ভূত পরে রাজনৈতিক পরামর্শ গ্রহণ এবং উচ্চতর আদালতে পদোন্নতির জন্য দরকষাকষির স্যাপ্রমাণ রেখেছেন। সেটা ফাঁস হয়েছে লন্ডন থেকে প্রকাশিত, সারা বিশ্বে প্রচারিত সাপ্তাহিক দ্য ইকনোমিস্ট-এর কারণে। প্রবাসী বাংলাদেশী মহলে গুঞ্জন, এই সরকারের আমলেই সরকারের সন্দেহ বা বিরাগভাজন ব্যক্তিদের টেলিফোনে আড়িপাতা বা ই-মেইল কপি করার গোয়েন্দাগিরিকে বৈধতা দিয়ে যে আইন পাস হয়েছে, সেই আইনের আওতায় বাংলাদেশের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১’এর স্কাইপি কথাবার্তা এবং ই-মেইলের রেকর্ড রাখা হয়। সেই রেকর্ড পাচার হয়ে যায় সরকারের প্রতিপরে কাছে, যারা দ্য ইকনোমিস্টকে তার সবাক সচিত্র অনুলিপি পৌঁছে দেয়। দ্য ইকনোমিস্ট এ সম্পর্কে ওই বিচারপতির বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি সরাসরি সেসব কথাবার্তার বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘বিচার্য বিষয় নিয়ে তিনি তার স্ত্রীর সাথেও কোনো কথা বলেন না; সেটা অনৈতিক।’ কিন্তু পরদিনই ট্রাইব্যুনালের তরফ থেকে দ্য ইকনোমিস্টকে নোটিশ দেয়া হয়, প্রবাসী আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের কথোপকথন অবৈধভাবে ‘হ্যাক’ করা হয়েছে, তার প্রকাশ নিষিদ্ধ। ট্রাইব্যুনাল প্রধানের স্ববিরোধী বক্তব্য নিয়ে পরের সপ্তাহে প্রশ্ন তুলল দ্য ইকনোমিস্ট ৮ ডিসেম্বর সংখ্যায়। অতঃপর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর সংখ্যায় ট্রাইব্যুনালের নিষেধাজ্ঞা উপো করে জনস্বার্থে এবং ওই কথোপকথন ওই মেইলভিত্তিক একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে ওই কথোপকথনের অনুলিপি হাতে পেয়ে আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ৯ ডিসেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন ভাগে সেটা বাংলাদেশেই প্রকাশ করেছে। আমার দেশের সাহসী সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে, কিন্তু আটকাদেশ এখনো কার্যকর হয়নি। কারণ ইতোমধ্যে ১২ ডিসেম্বরের সব পত্রপত্রিকায় স্থান পেয়েছে ওই বিচারপতির কৃতকর্মের প্রতিফল।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে অবশেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেছেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলেও এর কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হবে না। কারণ দু’টি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের সাথে জড়িত বিচারক ও প্রসিকিউশনের অন্যান্য সদস্য নিয়ে স্কাইপিতে এমন কিছু কথা এসেছে, যার ফলে আইন ও সংবিধানবিরোধিতাদুষ্ট হয়েছে গোটা বিচারপ্রক্রিয়া।
ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে বিচারপতি নিজামুল হক যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে অভিযুক্তদের মামলার শুনানি কখন হবে, কোন মামলার রায় আগে হবে, কোনটার রায় পরে হবে, কোন ট্রাইব্যুনালে কোন মামলায় কতজন সাী আসামিপকে আনতে দেয়া হবে, রায়ের কাঠামো কী হবে, অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাী সুলতানা কামাল, মুনতাসীর মামুন ও জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে দিয়ে কোন কোন বিষয় কিভাবে বলানো হবে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিচারের রায়ের কাঠামো কী হবে সে বিষয়ে বেলজিয়াম থেকে আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মাধ্যমে লিখিয়ে আনা বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান হয়। পুরো বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে রাষ্ট্রপরে আইনজীবীদের সাথে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের গোপন যোগসাজশ, আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগসাজশসহ বিচারকার্যক্রম যে বাইরের বিভিন্ন মহলের প্রভাবে ও ইশারা-ইঙ্গিতে চলেছে তা জানা যায় এ সংলাপ ফাঁস হওয়ার মাধ্যমে। বিশেষ করে সুদূর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থানরত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনই যে এ বিচারের বিভিন্ন গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিচ্ছিলেন তা স্পষ্ট হয়েছে। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এই বিচারপ্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের জন্য কোন কোন ব্যক্তি ও মহলের সাথে যোগাযোগ রা করেন, তা-ও স্পষ্ট হয়ে যায়।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads