রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের আগাম রায় রাজপথে!



গত ২২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট রাজধানীতে গণমিছিল করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের কর্মসূচি যে কোনো দল করতেই পারে। কিন্তু কথা উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। ক্ষমতাসীনদের এই গণমিছিল ছুটির দিন শনিবারেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি করেছিল। যানজট ছড়িয়ে পড়েছিল রাজধানীজুড়ে। সেই সাথে জনমনে ভীতি-আতংকও দেখা দিয়েছিল। কারণ, মিছিলটি ছিল মারমুখী। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিকে যখন ১০-২০ জনের সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না তেমন এক সময়েই ১৪ দলীয় জোট বিনা বাধায় তো বটেই, গণমিছিল করেছে পুলিশের প্রহরায়। রাজধানীজুড়ে যানজট সৃষ্টি করলেও কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে সমালোচনায় সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তারা বরং নিজেদের উচ্ছ্বাসই প্রকাশ করেছেন। একই অবস্থা দেখা গেছে গত ১৮ ডিসেম্বরও। সেদিন সরকারের ইঙ্গিতে ও পুলিশের সক্রিয় সমর্থনে কমিউিনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদসহ নাম সর্বস্ব কয়েকটি দল হরতাল করেছে। পুলিশ এমনকি ট্রেন ও বিআরটিসির বাস চলাচলও বন্ধ করিয়েছিল। বিরোধী দলের হরতালের সময় কিন্তু একই পুলিশকে লাঠিপেটার অভিযানে নামানো হয়। অন্যদিকে পুলিশকে দিয়ে হরতাল ‘সফল' করানোর পাশাপাশি হাস্যকরভাবে হরতালকারীদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! ক্ষমতায় রয়েছেন বলে এভাবে যে কোনো কিছুই তারা করতে পারেন এবং করছেনও। জনগণ যতই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হোক না কেন ক্ষমতাসীনদের যে কিছুই যায় আসে না সেটাও তারা ন্যক্কারজনকভাবেই বুঝিয়ে চলেছেন। এই সুযোগে বেআইনী অনেক বিষয়ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে এমন অনেক বক্তব্য- যেগুলো কোনো বিবেচনাতেই আইনসম্মত নয় বরং আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও নেতারা গণমিছিল উপলক্ষেও এরকম কিছু বক্তব্য রেখেছেন। যেমন কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে তারা বলেছেন, আগামী বছর এই বিচার শেষ হবে এবং ১৪ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। কথাগুলো শোনা গেছে ঘুষ কেলেংকারীতে রেলমন্ত্রীর পদ হারানো দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুখে। জামায়াতে ইসলামী তো বটেই, বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়াও যে এই বিচার বানচাল করতে পারবেন না সে ঘোষণাও মিস্টার সেনগুপ্ত বেশ জোরেশোরেই শুনিয়েছেন। ১৪ জনের ফাঁসির রায়ও ঠেকাতে পারবেন না বলে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন তিনি। আমরা মনে করি, কিছু বিশেষ কারণে বিষয়টি অবশ্যই গুরুতর। প্রথমত, বেছে বেছে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনায় এবং অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকর নানা ধরনের তথ্য-প্রমাণ হাজির করায় প্রথম থেকেই বিচারটি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তো তুলেছেই, একই সাথে ট্রাইব্যুনাল বাতিল করারও দাবি জানিয়েছে। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও একই বক্তব্য এসেছে। এখনো আসছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপি সংলাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কথিত যুদ্ধাপরাধের পুরো বিচার প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিতর্কিত ও নিন্দিত ওই বিচারপতি পদত্যাগ করে বিদায় নেয়ার ফলে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। দাবি উঠেছে নতুন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করার। সে দাবি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমর্থনও পেয়েছে। এমন এক অবস্থার মধ্যেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরাসরি রায় ঘোষণা করে বসেছেন! সে রায়ও আবার যেমন-তেমন নয়। ১৪ জন অভিযুক্তকে তিনি ফাঁসিতে ঝোলানোর ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ বিচারাধীন কোনো বিষয়ে এভাবে রায় ঘোষণা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধাপরাধের মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার বিষয়ে মন্তব্য করায় এর আগেও একজন মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান নেত্রীকে ট্রাইব্যুনাল থেকেই সতর্ক করা হয়েছে। অন্য দু'চারজনকেও তলব করে সতর্ক করেছে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন যে ঘটেনি সে সম্পর্কেই জানান দিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অথচ ‘ব্রিফলেস উকিল' হলেও ‘আইনের মানুষ' হিসেবে তার ভালোভাবেই জানা থাকার কথা, এ ধরনের বিষয়ে বক্তব্য রাখা এবং রাজপথে রায় ঘোষণা করাটা সর্বতোভাবেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সব জেনেও মিস্টার সেনগুপ্ত যেহেতু বলেছেন সেহেতু বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনদের গোপন পরিকল্পনারই প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ বিচারের নামে নাটক সাজিয়ে তারা জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চান। আমরা ক্ষমতাসীনদের এই নাটক ও পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং মনে করি, এ বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিশেষ করণীয় রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের কিছু বক্তব্যের উল্লেখ করা দরকার। গত ২০ ডিসেম্বর জেলা ও মহানগর দায়রা জজ এবং সমপদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বিচার কাজে কোনো বিচারকের অসততার প্রমাণ পেলে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিচার বিভাগের মানসম্মান যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে যত্নবান হওয়ার জন্যও তিনি বিচারকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিত করে কিনা সেটা একটি প্রশ্ন বটে তবে দুঃখের সঙ্গে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো বিচারকের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অভাবে ইদানিং কিছু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এবং কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে। এমনটি মোটেও কাম্য নয় এবং কোনো অজুহাতেই তা মার্জনা করা হবে না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আরো বলেছেন, প্রত্যেককে বিচার করতে হবে সুষ্ঠুভাবে। বিচার বিভাগই জনগণের শেষ ভরসার স্থল কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে কিছু ব্যক্তির ভুলের কারণে তাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেয়া যায় না। নিজের প্রত্যাশার কথা জানাতে গিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, যে অবস্থানেই থাকুন বিচারক ও বিচার বিভাগের কাছ থেকে সংযত আচরণ প্রত্যাশা করেন। আমরা মনে করি, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ সংলাপ ফাঁস হওয়ার পরপর মিস্টার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যেভাবে ট্রাইব্যুনালের রায় রাজপথে ঘোষণা করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধান বিচারপতির তথা সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্বের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সামনে চলে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যতিক্রম ও অপ্রত্যাশিত ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত যদি চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন তাহলেই শুধু জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে, যা তার নিজেরও প্রত্যাশা বলে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। এখন দেখার বিষয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল এবং সর্বোচ্চ আদালত কোনো ব্যবস্থা নেন কিনা। তবে এটুকু অন্তত আরো একবার পরিষ্কার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। একই কারণে বিচারের সম্ভাব্য রায়ও গ্রহণযোগ্য হতে পারবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads