বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১২

আত্মঘাতী খেলার শেষ কোথায়?


মাসুম খলিলী

আকস্মিক অস্থিরতা যেন বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চলেছে। উদ্বেগ আতঙ্ক চার দিকে। বিশিষ্টজনেরাও উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক কর্মীরা যেন উ™£ান্ত। নেতারাও বেশি কিছু বলতে পারছেন না। কোন গন্তব্যে ছুটছে বাংলাদেশÑ এ প্রশ্নের জবাব নির্দিষ্ট করে কারো কাছে যেন নেই। এটুকু অনুমান করা যায় যে, কোনো চোরাবালিতে আটকে পড়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এক কথাই যেন বলছেন, সংলাপে বসতে হবে। আলোচনা করে দূর করতে হবে ব্যবধান। নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। কিন্তু কে শোনে কার কথা। যারা এটি বলছেন, তারাও হচ্ছেন আক্রমণের শিকার। সরকারের বিবেকবান বলে পরিচিতরাও প্রতিপক্ষকে বাণবিদ্ধ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ বলছেন বিরোধী নেত্রীকেও ছাড়া হবে না। আবার কেউ হেনস্তা করছেন প্রভাবশালী দেশের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রদূতকে। কোয়াক ডাক্তারের অপারেশনের নির্বিচার ছুরি যেন চলছে বাংলাদেশ নামের দেশটির শরীরে। নিশ্চয় এর শেষ রয়েছে। অন্ধকার শেষে আলো নিশ্চয় দেখা যাবে। এ নিয়েই আজকের আলোচনা।
বিশ্বের যে দেশ বা অঞ্চলে সঙ্ঘাত বা যুদ্ধ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেয়, সেখানে আন্তর্জাতিক নীতি পরামর্শক সংস্থা হিসেবে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। সাধারণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় সঙ্কট। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট সঙ্কটে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্দেশনার ভূমিকা পালন করেছে এ সংস্থাটি। আনুষ্ঠানিক কূটনীতি যেখানে বরফ ভাঙতে পারে না, সমাধানের উপায় বের করতে পারে না, সেখানে ক্রাইসিস গ্রুপের মতো সংস্থাগুলো কাজ করে। ২০০৬-০৭-০৮ সালেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল এই সংস্থার। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট যখন প্রান্তিক রূপ নিতে শুরু করে, তখন একটি ব্যাপকভিত্তিক রিপোর্ট তৈরি করে গ্রুপটি। এ রিপোর্টে সঙ্কটের গভীরতা ও সমাধানের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সেনাবাহিনীর সাথে সমাঝোতামূলক কর্মপন্থা গ্রহণ করে বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না আনলে ২০১৩ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দুই বছরের সামরিক সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর দেশে ও বিদেশে জনগণের এই রায়কে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সমঝোতা তৈরিতে শেখ হাসিনা কাজে লাগাবেন বলে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অস্বস্তিকর সঙ্ঘাতের যে চক্র তার অবসান ঘটবে। কিন্তু শেখ হাসিনার সাড়ে তিন বছরের বেশি সময়ের শাসনে সে আশাবাদের পরিবর্তে সৃষ্টি হয়েছে গভীর হতাশা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও অস্থিরতা আর  বৈরী সামরিক বিস্ফোরণের দুই ঝুঁকি আবার ফিরে আসার হুমকি দেখা দিয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ উল্লেখ করেছে, পুরনো ধাঁচের রাজনীতি পরিবর্তনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচারব্যবস্থাকে সেই পুরনো ধারায় ব্যবহার করছে। এর অংশ হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনীকে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়েছে। সব চেয়ে উদ্বেগজনক হলো আওয়ামী লীগ প্রধান সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল তা তুলে দেয়া হয়েছে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নির্বাচনে কারচুপি করার পথে বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা। নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিরোধী দলগুলোকে আস্থাশীল করার যে ব্যবস্থা ছিল এটি বিলুপ্ত করে তার অবসান ঘটানো হলো। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এর পাশাপাশি আরো অনেক বিপজ্জনক দিক রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, এই সংশোধনীর পর যে কেউ যদি সংবিধানের সমালোচনা করে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের ও এই অভিযোগে বিচার করা যাবে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের বিরাট এক অংশে পরিবর্তন আনা কার্যত অসম্ভব করা হয়েছে। আর এ বিধানও করা হয়েছে যে, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের কোনো ষড়যন্ত্র করা হলে তার জন্য শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।
গ্রুপ উল্লেখ করেছে, সংবিধানে এসব পরিবর্তনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, আর সেটি না মানলে রাজপথে আন্দোলনের মোকাবেলা করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দাবিতে ঢাকা ও অন্যত্র তারা যে সমাবেশের আয়োজন করেছে তাতে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ হয়েছে। আর এ ধরনের সমাবেশ হয়ে উঠছে সহিংস। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সরকার কোনো পদক্ষেপ কার্যত নেয়নি, ফলে বিরোধী দল একের পর এক বিক্ষোভের ডাক দিয়ে চলেছে দেশব্যাপী।
ক্রাইসিস গ্রুপ উল্লেখ করেছে, এর মধ্যে সামরিক বাহিনীতে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার ঘোষণা দেয়া হয়েছে ১৯ জানুয়ারি। বলা হয়েছে, মধ্যপর্যায়ের ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এর আগে অক্টোবর ২০০৯ মধ্যসারির কিছু অফিসারের বিরুদ্ধে পিলখানায় পূর্ববর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে একজন সংসদ সদস্যের ওপর হামলার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ক্রাইসিস গ্রুপ উল্লেখ করে, এ ঘটনার পর ব্যাপকভাবে সেনাকর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়, বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় অনেককে, রাজনীতিকীকরণ ও ভিন্ন মত দলনে কঠোর পদক্ষেপও নেয়া হয়। সেই সাথে চরম মানসিকতার উৎপাটনের পদক্ষেপ হিসেবে যা করা হয় তা এ ধরনের অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির করেছে। এতে শীর্ষপর্যায় থেকে কোনো পরিবর্তনের উদ্যোগের আশঙ্কা না থাকলেও ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মনে করে, এ পরিস্থিতি আবার কোনো-না-কোনো আকারে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে। এবার বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে ২০০৭ সালের মতো কিছু করার অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। তেমন কিছু ঘটলে যারা এটি করবে তাদের আরো বেশি ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেয়ার পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে এবার। এমনকি আগে রাজনীতি থেকে মাইনাস টু করার যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, সে বিষয়েও যে তারা কঠোরভাবে এগোবে না তা-ও বলা যায় না। ক্রাইসিস গ্রুপের উদ্বেগজনক অনুসিদ্ধান্ত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে নতুন যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে প্রাথমিক অবনতিশীল শঙ্কাগুলো খানিকটা দূরে রাখলেও এটি যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তিগুলোকে নিঃশেষ করে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
যে রাজনৈতিক নৈরাজ্যের শঙ্কা দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো করছে, তার বাস্তবতা আমরাও দেখতে পাচ্ছি। অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিশ্বসংস্থা ও প্রভাবশালী দেশের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আসছেন। জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল  চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সরকারি ও বিরোধী জোটের বিভিন্ন দলের নেতা, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি আর নির্বাচন কমিশনের সাথে মতবিনিময় করেছেন। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে রাজনৈতিক ব্যবধান দূর করতে দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসঙ্ঘ সহায়তা দেবে নির্বাচন কমিশনকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কাঠামো বানানো হয়েছে, তাতে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে কেবল সরকার। এ ধরনের নির্বাচনে জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর সঙ্কট ও সঙ্ঘাত নিপীড়িত বিভিন্ন দেশে জাতিসঙ্ঘের তত্বাবধানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে সরকারের কোনো ভূমিকা থাকে না। জাতিসঙ্ঘের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি তখনই বাস্তবে দেখা যাবে, যখন কার্যকর সরকার দেশে থাকবে না অথবা দেশে তৈরি হবে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি। শেষোক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি আফ্রিকার আইভরিকোস্ট, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, কঙ্গোসহ বেশ কিছু দেশে হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটেছে। আবার কোনো কোনো দেশে ঘটেনি। বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘ কিভাবে নির্বাচনে সহায়তা করবে সেটি স্পষ্ট নয়। তবে এ প্রস্তাব বেশ ইঙ্গিতবহ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতির মাত্রাগত অবনতি কতটা গভীর হবে সেটি অনুমান করা কঠিন। তবে দেশের চিন্তাশীল সুশীলসমাজের মধ্যেও তেমন আশঙ্কা ব্যক্ত হচ্ছে বিভিন্ন টকশো, সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকার বা কলামে। একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে সময়ের আলোচিত ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বক্তব্যটা ঠিক এ রকমÑ ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই চলছে বিপথে। কে কার বিরুদ্ধে, কেন হরতাল-অবরোধ করছে, বুঝলাম না। এতে মানুুষ মরছে, গাড়ি পুড়ছে, দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। যারা হরতাল-অবরোধ করছে, তাদের বুঝতে হবে, দেশটা সবার। ক্ষতি যা হওয়ার দেশ বা মানুষের হচ্ছে।’ বর্তমান পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের মতো আশাবাদী মানুষও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমি কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় না এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ খোলা আছে। প্রধান দলগুলো যদি উপলব্ধি করতে না পারে, সমাধানে রাজি না হয়, তাহলে কারো পক্ষে এই সঙ্কট সমাধান করা সম্ভব নয়। দেশের ভেতরের বা বাইরের কেউ এসে এদের কোনো কিছু বোঝাতে পারবে না।’ অশুভবুদ্ধিরই পরাক্রম দেখতে পাচ্ছেন ড. আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘একটি মহল রাজপথে নেমেছে এবং বেছে নিয়েছে সহিংস উপায়। মানুষের সম্পদ ও প্রাণ সবই তাদের কাছে তুচ্ছ; বিদেশী অতিথিরাও তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। অন্য দিকে, যারা এই সহিংসতা প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেককে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বলে মনে হয় না। আমি কিছুতেই মানতে চাই না যে, বাংলাদেশের মানুষের শুভবুদ্ধি বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু ক’দিন ধরে দেশে অশুভবুদ্ধিরই পরাক্রম দেখতে পাচ্ছি।’
সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর পর্যবেক্ষণটা ঠিক এ রকমÑ ‘পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠছে। আমরা আসলেই বুঝতে পারছি না, কোথায় যাচ্ছি। এটা যেকোনো দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত। রাজনৈতিক সঙ্ঘাত বন্ধ করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না। আমি তৃণমূলের মানুষ ও প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি। এই দুই ক্ষেত্রের মানুষ দেশ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধান দায়িত্ব প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের। গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের কাছে পুরো জাতি জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছি না।’
আমেরিকান সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক আসেন জাতিসঙ্ঘের রাজনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত সহকারী মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের পর। তিনিও সরকার পক্ষ, বিরোধী দল ও সুশীলসমাজের সাথে কথা বলেছেন। যথারীতি সঙ্কট উত্তরণে সংলাপের তাগিদ তিনিও দিয়েছেন। কিন্তু সমঝোতার পথে হাঁটার যে কোনো লক্ষণ নেই, সে বিষয়টি আসছে সবার পর্যবেক্ষণে। সুশীলসমাজের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সমঝোতা না হলে ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তির মতো কিছু হওয়ার শঙ্কার কথা অনেকেই বলেছেন। কেউ কেউ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। গভীর রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের পথ ধরেই এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিবেদন গভীরভাবে পড়লে এমন আশঙ্কার বিষয় সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায়। জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব বা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক সহিংসতা ও সঙ্ঘাত নিরসনে সংলাপের যে তাগিদ দিয়েছেন তা না হলে যা হবে তাতেও সেই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। যেকোনো দেশে গৃহযুদ্ধ বা গভীর রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে সরকার পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সরকারের কোনো পক্ষ সে ধরনের ভূমিকায় রয়েছেন কি না সে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি মোকাবেলায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে ধরনের আগ্রাসী ভূমিকায় একসময় দেখা যেত, তেমনটি এখন আর প্রত্যক্ষ করা যায় না। বিরোধী পক্ষÑ সেটি বিএনপি বা জামায়াত যে দলই হোক, তাদের কর্মসূচিকে ভেঙে দিতে, লাঠিপেটা করতে পুলিশের অতি উৎসাহ নজরে আসত। সেটি না থাকায় হয়তো বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘গ্রেফতার’ করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার, উৎখাত করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের প্রতি। দেশের অনেক স্থানে এর মহড়া শুরু হয়। গ্রেফতার করার নামে চাঁদা আদায়ের নতুন বাণিজ্যের পথ সুগম হয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সামনে। প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে মিছিল করতে, বিরোধী পক্ষের কর্মসূচিতে লড়াই করতে দেখা যায় ছাত্রলীগকে। এর নির্মম শিকার হতে হয় শরীয়তপুরের নিরীহ দর্জি বিশ্বজিৎকে। তাকে প্রকাশ্যে রাজপথে কুপিয়ে পিটিয়ে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘পিটিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত দেশে নৈরাজ্য চলছে।’ ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থে অবিলম্বে এই উন্মত্ততার অবসান ঘটুক, জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকুক।’ ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘এখন যে রাজনীতি চলছে, তাকে অসুস্থ রাজনীতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। যা ঘটছে তা অসুস্থ রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিতে ন্যূনতম কোনো সম্প্রীতি নেই। প্রতিশোধ ও ব্যক্তিচিন্তা প্রাধান্য পাচ্ছে। যারা ক্ষমতায় নেই তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আর যারা ক্ষমতায় আছেন তারা একে আঁকড়ে থাকার অপচেষ্টা করছেন।’
প্রাইভেট ধরনের বাহিনী রাস্তায় নামানো হচ্ছে কিনা এমন একটি শঙ্কা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রশাসনকে দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করা না গেলে শাসকদলের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানো হতে পারে। এ জন্য ছাত্রলীগকে অস্ত্রসজ্জিত করার একটি অভিযোগও রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখার পরও তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা এ কারণে নেয়া হয়নি বলে উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশের মতো দেশে এ পথে যেই চলার চেষ্টা করুক না কেন, তাতে অরাজকতার যে আগুন জ্বলবে তাতে আগে পুড়বে ক্ষমতার উত্তাপে থেকে যারা বাস্তবকে দেখতে পাচ্ছেন না, তারা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আসলে কী পথ রয়েছে। অথবা ওয়ান-ইলেভেনের মতো অস্বাভাবিক পরিবর্তন এড়িয়ে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের কোনো রাস্তা রয়েছে কি না। এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতটাকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সঙ্কট উত্তরণের উপায় হিসেবে দেখা যেতে পারে। ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, স্বল্পমেয়াদে সমঝোতার প্রক্রিয়ার মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবার নিয়ে আসা যেতে পারে। এ সরকার অবশ্যই পূর্ববর্তী সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা গঠন এবং নির্বাচনের একটি স্পষ্ট গাইড লাইন তৈরি করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা ও মেয়াদ সীমিত করবে এবং সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের সুস্পষ্ট একটি অবয়ব দেবে। দীর্ঘ মেয়াদে চার প্রধান রাজনৈতিক দল, অন্য ছোটখাটো রাজনৈতিক দল সুশীলসমাজ ও সামরিক বাহিনীর সাথে আলোচনা করে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, প্রয়োজনীয় বহু ধাপের নির্বাচনপ্রক্রিয়া বের করবে, যাতে দলীয় মানসিকতার সংবিধান সংশোধনের বিপরীতে শান্তিপূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য ও নিয়মিত ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি উপায় বের হবে।
ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্কট নিরসনের এই ফর্মুলা সরকার মেনে নেবে এমনটা স্বাভাবিকভাবে মনে হয় না। তবে গ্রুপটি যে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার একটি অনুষঙ্গ ও অনানুষ্ঠানিক সংস্থা হিসেবে এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। ফলে কোনো পক্ষ মেনে নিতে না চাইলেও এমন অনেক কিছু বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদের হাতে হয়তো রয়েছে, যাতে যৌক্তিক ও নির্দেশিত পথের বাইরে যাওয়ার পথ তাদের জন্য একসময়  রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে যত দ্রুত শুভবুদ্ধির উদয় হবে রাষ্ট্র ও জনগণ ততটা ক্ষতি ও বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads