শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

লঙ্ঘিত মানবাধিকারের খণ্ডিত চিত্র



সিলেট মহানগরীর অলিগলিতে সকাল-বিকাল যে কোনো সময়ে কর্কশ সুরে ডাক শুনে থাকবেন, ‘টিন, লোহা, প্লাস্টিক আছেনি... ভাঙা টর্চ, বালতি, ব্যাটারি আছেনি?’ ইত্যাদি। একবার বেরিয়ে এসে এ টিন-লোহা জমাকারী কিশোরকে ভালো করে দেখুন। তার নাম কাদের। জিরজিরে চেহারা, ঘোর কালো রং, পায়ে দগদগে ঘা, শরীরে শতচ্ছিন্ন পোশাক আর গায়ে উত্কট গন্ধ। বয়স কত হবে? বারো কি তেরো। পড়াশোনার ধারেকাছেও যায়নি কোনোদিন। কেমন লাগবে ওর কাছ থেকে তার কাহিনী শুনতে।
বাবার নাম? জানি না। মা? ফাতেমা। কোথায় থাকে? সিলেট রেললাইনের পাশে। মা কী করে? কাজ করে। কী কাজ? জানি না। কখন বের হয় রোজ ঘর থেকে? সকালবেলা। ঘরে ফিরে সন্ধ্যার সময়। রোজ কত রোজগার করে? সব দিন হয় না। কোনোদিন ৫০ টাকা, কোনো দিন বেশি।
কাদের যখন আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে যায় ‘টিন, লোহা, প্লাস্টিক...’ হাঁক দিয়ে, অনেক সময়ই বারান্দা থেকে আপনার জুতা বা নতুন-পুরনো স্যান্ডেল অথবা দড়িতে শুকাতে দেয়া কাপড়-গামছা উধাও হয়ে যেতে পারে। বেশ কয়েকবারই এলাকার সজ্জনরা হাতেনাতে ধরে বেশ করে হাতের সুখ মিটিয়ে নিয়েছেন।
ফাতেমাকে তো চিনেন (কল্পিত নাম)। আপনার বাড়িতে সপ্তাহে সাত দিনই সকাল ১০টা নাগাদ এসে পড়ে। ফাতেমার কাছ থেকেও তার জীবনকাহিনীর অনেকটা আপনি জেনে গেছেন। আপনার বাড়িতে আসার আগে সে আরেক বাড়িতে বাসনপত্র মেজে ঘর মুছে আসে। দুপুর ৩টা-সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আপনার বাড়ির ঘর ঝাড় দেয়া, বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া—সবই করে। একবেলা নাস্তা, একবেলা খাবার, মাসে সাত-আটশ’ টাকা তাকে আপনারা দেন। সপ্তাহে কোনোদিন কামাই করলে আপনারা ৫০ টাকা কাটার ভয় দেখান। ওর জীবনকথা আপনারা জানেন। ওর বর রিকশা চালাতে চালাতে আর মদ খেতে খেতে প্রাণবায়ু বিসর্জন দিল দু’বছর আগে। ফাতেমার বয়স এখন তিরিশের কোঠায়। বাড়িতে চারটি ছেলেমেয়ে। বড় ছেলেটির বয়স এখন তেরো। ফাতেমার ভাষায়—ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে। যদিও একটা চায়ের দোকানে ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেটে-ভাতে আছে, আর রোজ দশ টাকা করে দেয় মালিক। ফাতেমা জানে না এ দশ টাকা নিয়ে ছেলেটা কী করে। মাঝের দুটো মেয়ে বয়স আট ও দশ। ফাতেমা চেষ্টায় আছে মেয়ে দুটোকে কোনো বাসায় কাজে ঢুকিয়ে দিতে। তবে চিন্তা একটাই—তার পাঁচ বছরের ছেলেটিকে সারাদিন দেখাশোনা করবে কে? সে নিজেও সকাল ৬টায় বের হয় আর সন্ধ্যা ৬-৭টায় তার বস্তিঘরে ফেরে। ফাতেমার আট ও দশ বছরের মেয়ে দুটোকে অনেকে বাড়িতে তাদের কাজের জন্য চেয়ে থাকেন। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের বিনিময়ে ওরা আট থেকে দশ ঘণ্টা কাজ করবে মালিকের বাড়িতে প্রতিদিন। ফাতেমা ও তার পরিবার-পরিজন স্বাধীন নাগরিক। পৌরসভা, জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটরঙ্গে সে অধিকারী। প্রিয় পাঠক, কাদের আর ফাতেমার মতো অনেককেই চেনেন আপনারা। আপনাদের প্রতিদিনের জীবনে তাদের সঙ্গে দেখা হয় প্রতিনিয়ত। আজকের আলোচনাতে এদের উল্লেখ এজন্য প্রয়োজন হলো, কারণ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে বিশ্ব মানবাধিকার সনদ গৃহীত হলেও কাদেরদের জীবনে তা ক কোনো অর্থ বহন করে?
মানবাধিকার বলতে আমরা মানুষের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সার্বিক অধিকারগুলোকে বুঝি, যে অধিকার তাকে সুস্থভাবে, সুস্থ পরিবেশে, সুস্থ সমাজে বেঁচে থাকতে দেবে। আজ যাকে আমরা মানবাধিকার নামে সংজ্ঞায়িত করছি, তা আসলে প্রতিটি মানুষের সুস্থভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে তথা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদে মানবাধিকারের সংজ্ঞায়নে বলা হয়েছে, এটা হচ্ছে সে অধিকার, যা ছাড়া মানুষ নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। তাই প্রতিটি মানুষ তার এ ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে জন্মসূত্রে স্বাধীনতা অর্জন করে আসে। বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা আইন বলছে, মানবাধিকার হচ্ছে জীবনসংক্রান্ত, স্বাধীনতাসংক্রান্ত, সাম্যসংক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার, যা তাকে সংবিধান প্রদান করেছে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত। আর্থিকভাবে অসুরক্ষিত মানুষের জীবনে মানবাধিকার কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে, এ প্রশ্নটা আমাদের মনে খুব একটা নাড়া দেয় না। আজকের পৃথিবীতেও অন্তত পনেরো কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে জর্জরিত। প্রতিবছরে দেড় কোটি মানুষ এ বিশ্বে মারা যায় অনাহারে। প্রতি মিনিটে ২৪ জন মানুষ মরছে অনাহারে; আর তার মধ্যে ১৮ জন শিশু মৃত্যুবরণ করে পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই। গত দু’বছরে এ পৃথিবীতে অনাহারে যত লোক মারা গেছে গত শতাব্দীর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধে কিন্তু তত লোকের জীবনসংহার হয়নি। হিরোশিমার বোমাবর্ষণে যত লোক মৃত্যুবরণ করেছিল, এ পৃথিবীতে প্রতি দু’দিনে তার থেকে বেশি লোক মারা যায় শুধু অনাহারে।
ওপরের তথ্যগুলো সারা বিশ্বের হলেও বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের জানা দরকার, অনাহারে জর্জরিত ১৫ কোটি মানুষের বড় একটা অংশের বাস এ বাংলাদেশে। সফটওয়্যারে দেশের অগ্রগতিতে আমরা গৌরবান্বিত। শিল্পপতির দলে নতুন নতুন নামের অন্তর্ভুক্তি আমাদের আনন্দিত করে। এদেশে প্রতিবছরে শত শত শিশু অন্ধত্বের কবলে পড়ে শুধু ভিটামিন ‘এ’র অভাবে। এটা কিন্তু শুধু সরকারি হিসাব। তার বাইরের খবর কোনো হিসাবেও আসে না। সরকারি হিসাবমতেই এ দেশে জন্মগ্রহণকারী ৫০ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অনাহারের কারণ কিন্তু খাদ্যাভাব নয়, বরং বলা যায়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য উত্পাদিত হচ্ছে এদেশে। তা সত্ত্বেও এ দেশে এত অনাহার—যার কারণ আমাদের ত্রুটিপূর্ণ বণ্টনব্যবস্থা। আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটাই যখন এমন—যেখানে এক বৃহত্ সংখ্যক জনসংখ্যার কাছে খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার সুরক্ষিত নয়, তখন আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার ও সুরক্ষার প্রশ্নই আসে না। যে কথাটা অত্যন্ত জরুরি, মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য আইনই যথেষ্ট নয়। তার জন্য চাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। যতদিন তা না হয়, ততদিন কাদের মোল্লা আর ফাতেমার মতো বঞ্চিতরা আমাদের সভ্যতার, আমাদের উন্নতির গর্বে ঝামা ঘষতেই থাকবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads