বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন


 সম্প্রতি বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক দু'টি মানবাধিকার সংস্থা। সংস্থাগুলোর দীর্ঘ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সার্বিক আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিএনপি, জামায়াতসহ ১৮ দলীয় গণতান্ত্রিক বৃহত্তম বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-পীড়ন ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এছাড়া রাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থী সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপের সমালোচনার পাশাপাশি সংবাদপত্রসমূহের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি দেয়ার বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে। অথচ এসব ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-এমপিরা এবং সরকারি দলের নেতারা বরাবরের মতোই মিথ্যাচারের মাধ্যমে সকল দায় এড়িয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নটি ক্রমেই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের গণতন্ত্রকামী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা দু'টি হচ্ছে হংকংভিত্তিক ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' এবং প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য অবজারভেটরি ফর দ্য প্রটেকশন অব হিউম্যান, রাইস ডিফেন্ডার।' বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থতির উপর ‘দ্য স্টেট অব হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ ইন ২০১২'-শীর্ষক প্রতিবেদনে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের প্রতি অনুগতদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কারণে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একচোখা আওয়ামী দানবে পরিণত হয়ে সম্পূর্ণভাবে বিকল হয়ে পড়েছে। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ রয়ে গেছে ক্ষমতাসীন সরকারের চাতুর্যপূর্ণ তত্ত্বগত বিষয় হিসেবে। এতে আরো বলা হয়েছে, দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নির্দ্বিধায় চলছেই। এ অবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা বাগাড়ম্বরে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী সরকারের চার বছরে একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডেরও বিচার হয়নি। অপরদিকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে আওয়ামী সরকারের ‘পক্ষপাতদুষ্ট' আখ্যা দিয়ে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘দ্য অবজারভেটরি ফর দ্য  প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার' ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশে বিচার বিভাগ ভিন্নমত দমনে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারকে প্রচ্ছন্নভাবে সহায়তা করছে, অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে বিচার বিভাগীয় হয়রানি। দেশটির বিচার বিভাগ মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠরোধ করছে বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। সংস্থা দু'টির প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুয়ায়ী, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন বিস্ফোরণোম্মুখ। এখানে রয়েছে আওয়ামী সরকারের ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি। আওয়ামী সরকারের দমননীতি বাস্তবায়নে ইচ্ছামতো গ্রেফতার ও আটকের আতঙ্কে থাকছে বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় বৃহত্তম গণাতন্ত্রিক জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। আওয়ামী-বাকশালী রামরাজত্ব কায়েমে সারাদেশে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে পাইকারীহারে গণগ্রেফতার অভিযান চালিয়ে দেশটাকে বন্দীশিবিরে পরিণত করা হয়েছে। সরকারি দলের কর্মী-ক্যাডাররা সারাদেশে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও নির্দেশে। এই সরকারের চার বছরের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনে নাগরিকদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কেবল বেড়েই চলেছে। প্রতিবেদনগুলোতে আরো বলা হয়েছে, আওয়ামী সরকারের আমলে বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশটিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বী মিডিয়া হয়রানি, ভয়ভীতি, এমনকি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশে উচ্চকণ্ঠ দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় সংস্থার নির্যাতন ও আটকের ঘটনার কথাও প্রকাশ করা হয়েছে। আলোচ্য প্রতিবেদনগুলোতে দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, মিডিয়া ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন-সংস্থাসমূহের উদ্ধৃতি দিয়ে সরকার দলীয় ২১ কুখ্যাত খুনি-অপরাধী-আসামীকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমা ঘোষণার প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় বসে দলীয় নেতা-কর্মী-ক্যাডার নামধারী ৭ হাজার পাঁচশ' আসামীর মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সন্ত্রাসী ও খুনিসহ আরো কয়েক হাজার আসামীর মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি পর্যবেক্ষক টিম পাঠায়। গত ১৪ থেকে ২২ নবেম্বর উক্ত টিম বাংলাদেশ সফর করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ঐ প্রতিবেদনে এসব তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাগুলো আগামী বছর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে তা জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে পেশ করা হবে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ সরকারকেও দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
বলতে দ্বিধা নেই যে, বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলে দেশের নাগরিকদের শেষ ভরসাস্থল বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে কোথাও স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক ও অস্থিরতা। একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল, বন্দী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তিদান, সকল মিথ্যা ও সাজানো মামলা প্রত্যাহার, পুলিশী হয়রানি বন্ধ, জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং দ্রব্যমূল্য কমানোসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে হরতাল, অবরোধসহ গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করে যাচ্ছে বিএননপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক জোট। অন্যদিকে সরকার তথাকথিত নাশকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির মনগড়া অজুহাত খাড়া করে সকল গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড বানচাল করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের নেতা-কর্মী নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিচ্ছে। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই হরহামেশাই জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ হচ্ছে, আহত ও গ্রেফতার হচ্ছে শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। প্রকাশ্য রাজপথে নির্মমভাবে খুন হচ্ছে ভিন্নমতের সমর্থকসহ সাধারণ নাগরিককরা। সরকারি দলের পোষা সন্ত্রাসীদের এই ভয়াবহ পরিবেশের শিকার হচ্ছে দেশের অসহায় জনগণ। সেই দুঃখজনক, বিভীষিকাময় পরিস্থিতির আওতায় যেন চলে এসেছে দেশের বিচার বিভাগও। বিচারক নিয়োগে সরকারের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এতে বড় হচ্ছে সংশয় ও নৈরাজ্যের পরিধি। এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারদলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত কেবল ‘প্রতিহত' করার হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। অর্থাৎ পুলিশ ও সরকারি দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত-পালিত সন্ত্রাসী-অপরাধীদের প্রতি হুকুম- যেখানেই বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে পাবে, সেখানেই ধরো, মারো, কাটো এবং জেলে ঢুকায়। আর হচ্ছেও তাই। সরকার নির্যাতনের মাধ্যমে দেশটাকে যেন বন্দীশিবিরে পরিণত করেছে। অথচ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মর্তা ও সদস্যরা নাকি চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও দাগী অপরাধীদের খুঁজে পাচ্ছে না। অরাজকতার সব দায় চাপানো হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের উপর। সরকারের এহেন দমন অভিযান এবং চাতুর্যপূর্ণ মিথ্যাচার গণতন্ত্রকামী জনগণ কখনো মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও মেনে নেবে না- বলেই আমাদের বিশ্বাস। অতএব, দেশের এই বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে গণতন্ত্রকামী আপামর জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কাজেই, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জননিরাপত্তা, জনস্বার্থ রক্ষায় সর্বোপরি নাগরিক মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারকেই উদ্যোগ, পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads