সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

বিজয়ের মাসে অবরুদ্ধ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা



শওকত মাহমুদ

১৬ ডিসেম্বর ২০১২। বিজয়ের এ কেমন উদযাপন? গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্ধত, দেশপ্রাণতার পরিচয়ে উদ্ভাসিত, সত্য প্রকাশে নিরাপস ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, পুলিশ-অবরুদ্ধ হয়ে নিজ অফিসে আবারও গ্রেফতারের জন্য অপেক্ষমাণ। একাত্তরের বিজয় অর্জনে কি সাংবাদিকরা আত্মোত্সর্গ করেননি? এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতি সংগ্রামের পরতে পরতে যেখানে সাংবাদিক-লেখকদের স্পষ্টচেতা ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেখানে কলমযোদ্ধা মাহমুদুর রহমানকে আবারও স্মরণকালের বর্বরতম কালো শক্তি বিজয়ের মাসে কারাগারে নিক্ষেপে উন্মত্ত। পত্রিকাটির দ্বিতীয় হত্যায় ধারালো অস্ত্রে শান দিচ্ছে। বিশ্বজিত্ হত্যায় শাকিলের চাপাতি এখন কারওয়ান বাজারে।
১৯৩৫ থেকে ’৪৪ এই উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আন্দোলনে উচ্চকিত সাংবাদিক-লেখকদের মধ্যে ফরাসি সাহিত্যের দিকপাল লুই আরাগঁ’র সেই অমর বাণী আজ মনে পড়ে— ‘মহত্তম অভীষ্টের জন্য এক চিত্কার—আমার চিত্কার তার প্রতিধ্বনি হোক।’ মাহমুদুর রহমানের অভীষ্ট, সত্যের প্রকাশ। বিচার বিভাগের মান-মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, জনগণকে সত্য জানানোর তাগিদে তিনি প্রকাশ করেছেন বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি সংলাপ। সত্যকে মেনে নিয়ে, শপথ ভঙ্গের বোধ থেকেই এরপর ওই বিচারপতি পদত্যাগ করলেন। কিন্তু কি-ই না দুঃসময়, উল্টো মাহমুদুর রহমান আসামির কাঠগড়ায়। তিনি কি পারবেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ও সাংবাদিকতার এই ঐতিহাসিক লড়াইয়ে জয়ী হতে? বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজের মহত্তম অভীষ্ট অবাধ তথ্য প্রবাহের সংগ্রামকে তিনি কি চূড়ান্ত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবেন? আমরা যদি সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকি, মনুষ্যত্বের বর্তমান লাঞ্ছনায় যদি আমরা রাজনীতি বিভাজনের যুক্তিতে আপন আপন গৃহকক্ষে উদাসীন জড়ত্বের মধ্যে দিনযাপন না করি, তবেই আমরা সার্থক হব। বুদ্ধিজীবী আঁরি বারব্যুস এবং চিন্তাবিদ রোমাঁ রোলাঁ ১৯২৭ সালে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী বর্বরতা রুখতে বিশ্ববাসীর কাছে ‘মুক্ত মানবাত্মার নিকট আবেদন’ শীর্ষক আবেদনপত্রে যা বলেছিলেন, আজ বাংলাদেশে সে আহ্বান সময়োপযোগী। তারা বলেছিলেন—‘আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করছি যে ফ্যাসিবাদের নামে স্বাধীনতার সমস্ত বিজয়কে হয় ধ্বংস নতুবা বিপদাপন্ন করা হচ্ছে। সংগঠন গড়ার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের ও বিবেকের স্বাধীনতা—যা শত শত বছরের আত্মত্যাগ ও আয়াসে অর্জিত হয়েছে, আজ সেই সব কিছুকেই নির্দয়ভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। প্রগতির এই দেউলিয়া অবস্থায় আমরা আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারি না।’ আমাদের উপমহাদেশে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ডের পর। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে একটি ফ্যাসিস্টবিরোধী সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য শ্রমিক মিছিল নিয়ে সোমেন যখন এগোচ্ছিলেন, তখন লক্ষ্মীবাজারের কাছে, রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে একদল ‘প্রো-ফ্যাসিস্ট’ রাজনৈতিক কর্মী ও গুণ্ডার হাতে পাশবিকভাবে নিহত হন সোমেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে। প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে এই হত্যাকাণ্ড। ২০১২-তে সেই সূত্রাপুর থানাধীন এলাকায় অরাজনৈতিক তরুণ বিশ্বজিতের পাশবিক হত্যাকাণ্ড আমাদের হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। ফ্যাসিস্টরা প্রকাশ্যে পুলিশ মিডিয়া ও জনগণের সামনে নিষ্পাপ নিরীহ ওই তরুণকে কী বীভত্স উল্লাসেই না হত্যা করল! কোথায় আজ আমাদের বিবেক, কোথায় সোমেন চন্দের নির্বীর্য কম্যুনিস্ট উত্তরসূরিরা? সে সময় ঢাকা ও কলকাতায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক ও লেখকরা এক হয়ে একাধিক সম্মেলনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, গোলাম কুদ্দুস, কাইফি আজামী, সাজ্জাদ জহির, আবুল মনসুর আহমেদ, হাবীবুল্লাহ বাহার, আহসান হাবীব, শওকত ওসমান প্রমুখ ছিলেন অন্যতম। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারিতে ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন—“... ফ্যাসিজম ও তার সর্ববিধ শয়তানি রূপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আমাদের দেশের উদারহৃদয় অথচ দীর্ঘকাল ধরে অত্যাচারিত জনগণের সঙ্গে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিশেষভাবে সংগ্রাম—‘ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা’ কথাটার মধ্যে প্রকাশ পায়।” খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ, যার গর্বিত সন্তান আজকের পুরোধা সাংবাদিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, তখন বলেছিলেন—“ভারতের হিন্দু ও মুসলমানের জীবনাদর্শের এবং ঐতিহাসিক শিক্ষা ফ্যাসিবাদের বিরোধী। কাজেই ভারতের লেখক ও শিল্পীদের ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা একটা নেতিবাচক ভাববিলাসিতা নহে। ইহার মধ্যে আমাদের জীবনের যোগ আছে।”
আজকের বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃশাসনে ফ্যাসিবাদ চলছে এবং আরও ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে। নির্বিচারে সাংবাদিক খুন-নির্যাতন চলছে। সত্যের প্রকাশ বিপজ্জনক, ভিন্নমত ও বিরোধী দলের দলন নজিরবিহীন বর্বরতায় উপনীত। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ও হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষময়তা উল্লেখ করে করে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি এমনই সর্বগ্রাসী যে বিদেশি দাতারা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সংবিধানের যথেচ্ছ সংশোধনী এবং লঙ্ঘন চলছে। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের চরম দলীয়করণে জবুথবু দেশ। ছাত্রলীগ-যুবলীগের চাপাতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রক্তচক্ষু হুমকিতে জনমনে উত্কণ্ঠা চরমে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছাড়া হচ্ছে বিরোধীদের হত্যার জন্য। গৃহযুদ্ধের আলামত অনেকটাই লক্ষণীয়। জনমতকে পদদলিত করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই এসব হচ্ছে।
সময়ের সাহসী দৈনিক ‘আমার দেশ’ এবং সঠিক অর্থে নির্ভীক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এই দুর্নীতি-অপশাসনের আংশিক চিত্র প্রকাশ করতে গিয়ে যত পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন, বাংলাদেশে আর কোনো পত্রিকা বা সম্পাদককে এমন লাগাতার লাঞ্ছনা সইতে হয়নি। মন্ত্রীরা তাকে দেখে নেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। ঢাকা ও লন্ডনে তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। বিচার বিভাগ আদালত অবমাননার দায়ে তাকে জেল খাটিয়েছে। তিনি আদালতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেননি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার কী সাহসী ভূমিকা! গ্রেফতার অবস্থায় বর্বর নির্যাতন সইতে হয়েছে মাহমুদুর রহমানকে। অন্য ব্যবসা ছেড়ে সর্বস্ব দিয়ে শুধু ‘আমার দেশ’ চালাচ্ছেন। সাংবাদিকতার সাধনায় মগ্ন এই সম্পাদকের বিরুদ্ধে ‘তিনি সম্পাদক নন’ এ ধরনের কটু কথা বলার আর কোনো সুযোগ আছে কি? তার লেখাগুলো দেশে-বিদেশে দারুণ জনপ্রিয়। সত্য প্রকাশে অনড় এই সম্পাদক যেমনি করে সংবিধান মোতাবেক বিচার বিভাগকে অসঙ্গতি-অনিয়ম থেকে রক্ষা করার জন্য ব্রতী হয়েছেন, সে তুলনাও বিরল। হাইকোর্টের একজন বিচারপতি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির কাছে সপ্রমাণ অভিযোগ করেছেন। এছাড়া সম্প্রতি মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করে জনগণের সত্য জানার অধিকারকে গৌরবমণ্ডিত করেছেন। সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কে অপরিহার্য— মাহমুদুর রহমান নাকি আলোচিত বিচারপতি?
‘আমার দেশ’-এ প্রকাশিত স্কাইপি-সংলাপ আর না ছাপানোর নির্দেশ, তথ্য প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের জন্য মাহমুদুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আসামি করানো, গ্রেফতার করার জন্য হাইকোর্টের অভিপ্রায় কোনোভাবেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সহায়ক নয়, বরং প্রতিবন্ধকতা। আমেরিকার সংবিধানের বিল অব রাইটসের ভাষ্যকার হ্যারি ক্যালভেন বলেছিলেন, “... the existence of the officious libel Ñ a hostile attack of govt. Ñ is the hallmark of unfree society” অর্থাত্ রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের উপস্থিতি, প্রয়োগ তো দূরের কথা, মানেই পরাধীন সমাজের অস্তিত্ব। ‘আমার দেশ’ ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সমাজে অস্থিতির জন্য স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করেননি, বরং বিচার বিভাগকে পরিশুদ্ধ করার অঙ্গীকারে ধারাবাহিকভাবে তিনি যে প্রয়াস রাখছেন, এই প্রতিবেদন তারই প্রমাণ। আমেরিকার সুপ্রিমকোর্ট ব্রান্ডেনবার্গ বনাম ওহাইয়ো মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কে মত দিয়েছেন—“decisions have fashioned the principle that the constitutional guarantees of free speech and free press do not permit a state to forbid or proscribe advocacy of the use of force or of law violation except where such advocacy is directed to inciting or producing imminent lawless action and is likely to incite or produce such action.” মাহমুদুর রহমান অভিযুক্ত হলে তো ইকোনমিস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ বিশ্বের অনেক সংবাদপত্র একই অভিযোগে দায়ী হবে। বিচার বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে সংবাদপত্রের লেখালেখি এক সময় scandalizing the court বলে মনে করা হতো। এরিক বেরেন্ডেটের ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ গ্রন্থে বিচার বিভাগের ওপর আক্রমণ শীর্ষক আলোচনায় বলা হয়েছে, বর্তমান যুগে আদালত অবমাননার চাইতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মূল্যকে অধিকতর বিবেচনায় আনা হয়। তিনি জানাচ্েQbÑ “It is clear, however that reasonable and moderate criticism of judicial decisions does not constitute contempt. In the leading privy council ruling Ambard VS Attorney General for Trinidad and Tobago, Lord Atkin distinguished the imputation of improper motives and malicious comment on the one hand from good faith criticism on the other. Both in his opinion and in that of Lord Denning Mr. in a more recent court of appeal case, emphasis was placed on the importance of the freedom, Particularly of the Press to comment on the administration of justice.” উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যে বিচারপতির স্কাইপি সংলাপ প্রকাশিত হয়েছে, তিনি নীরবে দায় মেনে পদত্যাগ করেছেন। সংক্ষুব্ধ হয়ে কোনো আদেশ দেননি। অন্যদিকে মাহমুদুর রহমান সঠিকভাবেই বলছেন, হাইকোর্টের যে বিচারপতি রুল জারি করেছেন, তার সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির কাছে আগেই তিনি অভিযোগ করে রেখেছেন, যেন তার বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করে। অতএব এ মামলা ওই বিচারপতি শুনতে পারেন না। এখন প্রশ্ন হলো, সত্য প্রকাশের জন্য সরাসরি নয়, বরং তথ্যপ্রাপ্তির সূত্র বা এর প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পাদক ও পত্রিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি দাঁড় করানো হচ্ছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্য মাহমুদুর রহমান ও ‘আমার দেশ’ বিশ্বের অগুনতি প্রশংসা পাচ্ছে। কেউ জিজ্ঞেসই করছেন না কেমন করে খবরটি পেলেন। ইকোনমিস্ট সাময়িকী, যার কাছে প্রথম হস্তগত হয় স্কাইপি সংলাপ, তাদেরও খবরের সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে না। কারণ এ সত্য প্রতিষ্ঠিত, যে সাংবাদিকরা তাদের খবরের সূত্র না জানানো অথবা সূত্রকে সুরক্ষার জন্য এক ধরনের অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। ইংল্যান্ডের contempt of court Act 1981-এর সেকশন ১০-এ বলা হয়েছে— “No court may require a person to disclose, nor is any person guilty of contempt of court for refusing to disclose, the source of information contained in a publication for which he is responsible, unless it be established to the satisfaction of the court that disclosure is necessary in the interests of justice or national security or for the prevention of disorder or crime.” বাংলাদেশে আদালত অবমাননা বা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ঔপনিবেশিক আমলের। এগুলো এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের সংশোধনীর জন্য সাংবাদিকরা বহুদিন বলে আসছে। বাংলাদেশে এখন গোপনীয় তথ্যের সূত্রদের সুরক্ষার জন্য যেখানে ডযরংঃষব ইষড়বিত্ চত্ড়ঃবপঃরড়হ আইন হয়, সেখানে খবরের উত্স না জানানোর অপরাধকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আখ্যা দেয়ার বাস্তবতা কোথায়?
উপসংহারে বলব, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান অর্থাত্ ইতিহাসের প্রত্যেক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের সাংবাদিক-লেখকরা মরণপণ অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতার সংগ্রামকে তারা সার্থক না করলে ’৭১-এর ২৫ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে পাক বাহিনী কামান দাগাত না, পত্রিকা অফিসে আগুন দিয়ে শহীদ সাবেরকে হত্যা করত না, এমনকি স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা করত না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই বুদ্ধিজীবীরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর বাকশাল সফল হয়নি অনেকগুলো কারণে। একটি হলো চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বাতিল করে মত প্রকাশের অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল বলে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল ২৭ নভেম্বর থেকে লাগাতার সংবাদপত্র ধর্মঘটের কারণে। সাংবাদিকরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আর পত্রিকা প্রকাশ নয়। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের বিদায়ের পর পত্রিকা বের হয়েছিল। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের রহস্য আজও সরকার বের করতে চাইছে না। দু’হাজারের বেশি সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। সাংবাদিক খুনের সংখ্যা এ জমানায় সবচেয়ে বেশি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে লাথি মেরে, সাংবাদিক সমাজকে ভীতসন্ত্রস্ত রেখে, আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানকে মেরে-কেটে কোনো সরকার টিকতে পারবে না। আসলে রাষ্ট্রকে বাস্তবিক অর্থে স্বাধীন-সার্বভৌম ও মানবিক করা, জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত করা এবং দুর্নীতির বিপক্ষে বাংলাদেশে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত করার অভিপ্রায় সেই জাগরণেরই অংশ। তাই মানবিকতার জন্য পূর্ণশক্তিতে জেগে ওঠা এবং ফ্যাসিবাদের তলানিটুকু ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা সবার জন্যই জরুরি। মাহমুদুর রহমানকে আমি ফ্যাসিবাদবিরোধী সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের একজন অগ্রণী সেনা হিসেবেই মানি। আসুন, তার পাশে দাঁড়াই সব নিরপেক্ষতার কৃত্রিম জড়তা ছেড়ে। এই সম্পাদককে অভিবাদন জানাই এবং স্মরণ করি বিষ্ণু দে’র ‘ইতিহাস’ কবিতাটি, যা সে সময় ‘প্রাচীর’ নামের সংগ্রামী সঙ্কলনে প্রকাশিত হয়েছিল—
অমর প্রাণের অবজ্ঞা হেনে আমাদের জয়হাস্য
ভাঙা ছুরি জানি অকর্মণ্য, অসহায় হাতিয়ারে
তবু আমি এই দধীচির হাতে এই ভাঙা হাতিয়ারে
ইতিহাসে আজ কেটে দেব পাতা, লিখব বিজয় ভাষ্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads