রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলে দিশেহারা জাতি



নাজমুল ইসলাম মকবুল
 
তাজ্জব ব্যাপার। এক জোয়ান মরদ সাংবাদিকতার চাকরি নেয়ার জন্য যার সুপারিশ প্রয়োজন তার বাসায় বিশাল আকারের একটি মাছ নিয়ে হাজির হলো ফুরফুরে মেজাজে। বেচারা থতমত খেয়ে গেলেন। বাপরে বাপ। এত্ত বড় মাছ কোনোদিন বাজার থেকে কিনে আনার সামর্থ্য অন্তত আমার মতো ফাটা কপালির তো হয়নি। করি কী! তবে ভাবনার বিষয় হলো, নিশ্চয় ওই জোয়ান মরদের মতলব ভালো নয়। ওকে ওই চাকরির সুযোগ করে দিলে পদে পদে যে দুর্নীতি করবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? ঘুষ-দুর্নীতির জোরে যে বা যারাই চাকরিতে প্রবেশ করে তারা আপাদমস্তক দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশকে রসাতলে নিয়ে যায়। তাদের কারণেই আমাদের দেশ দুর্নীতিতে বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের তকমা অর্জনসহ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও আস্থা হারিয়েছে।
সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। সংবাদপত্র জাতির দর্পণ বা আয়না। এই জাতির বিবেকের মধ্যেও যদি ঘুণে ধরে, তখন বুঝতে হবে আমাদের কতটা অধঃপতন ঘটেছে। ‘হলুদ সাংবাদিকতায় সয়লাব দেশ : জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত’ শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেছিলাম। বিদেশের অনেক পত্রপত্রিকায় তা ফলাও করে ছাপিয়ে কপি পর্যন্ত ডাকযোগে পাঠিয়েছে। মোবারকবাদও জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু বিপত্তি বাধে দেশের পত্রপত্রিকাগুলো নিয়ে। জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে একমাত্র আমার দেশ আর্টিকেলটি ছাপানোর দুঃসাহস দেখিয়েছিল। আমার দেশ-এ ছাপা হওয়ার পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অগণিত ফোন আসে এ অধমের কাছে। স্থানীয় ও জাতীয় অনেক পত্রিকার কর্তাব্যক্তি ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন হাঁড়ির খবরটা নিয়ে লেখার জন্য। তবে অনেকে এও জানালেন যে, সীমাবদ্ধতা থাকায় লেখাটি ছাপাতে পারছি না বলে দুঃখিত। দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা অবশ্য লেখাটি ছাপানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে। এসএসসি পাসের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বড় মাছ খেয়ে যারা অযোগ্য, দুর্নীতিবাজদের প্রবেশে সুযোগ করে দেন, তাদেরও মুখোশ উন্মোচন না করলে দেশ ও জাতির কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই যাবে বলে মনে করি।
বিটিভিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় ‘শেষ কোথায়’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতও থাকেন পরিচালকের সঙ্গে। বিশেষ করে খাবারে ভেজাল মেশানো এবং নোংরা-অপরিচ্ছন্ন পচা-বাসি খাবার পরিবেশনের সরেজমিন খোঁজ-খবর নিয়ে দোষীদের তাত্ক্ষণিক সাজা ও জরিমানা করা হয়। গত ১২ অক্টোবর দেখলাম, একটি সরকারি হসপিটালের কাছেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনেক ক্লিনিকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে আসা হয়। যারা ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে রোগী আনতে সমর্থ হয়, তারা নির্দিষ্ট একটা কমিশনও পায় নগদে। এই ভাগানোর মহত্(!) কাজে ক্লিনিকের মালিকের স্ত্রী-কন্যা-পুত্ররাও দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। ওই পেশাদাররা রোগী ভাগিয়ে এনে হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে এই পরীক্ষা সেই পরীক্ষা শুরু করে দেন। রিপোর্টে নামকরা ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানদের সিল-মারা থাকে ঠিকই, কিন্তু তাতে স্বাক্ষর করেন পাঠশালাপড়ুয়া কেয়ারটেকাররা। ডাক্তারি চিকিত্সাও দেন ওই কেয়ারটেকার কিংবা মালিকের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা। এগুলোর কয়েকটি হাতেনাতে ধরে দু’লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, ক্লিনিক সিলগালা করা এবং বছর-দু’বছরের জেলও দিতে দেখলাম। কিন্তু দেখে অবাক হলাম না মোটেও। কারণ ওরা অভিযান চালিয়েছেন নির্দিষ্ট একটি জায়গায়। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে একই ধরনের অবস্থা চলছে, সেসব স্থানে অভিযান চালাবেন কারা? সারা দেশে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হলে শুধু জরিমানা আদায় বাবত সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় তো হতোই, দেশের চিকিত্সাসেবার উন্নতিতে বিশ্ববাসীও কর্তৃপক্ষকে বাহবা দিতে পারতেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ৯০ শতাংশ ডাক্তার ঠিকমত কর্মক্ষেত্রে থাকেন না। রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না। কিন্তু চেম্বারে গেলে চড়া ভিজিটের বিনিময়ে ওরাই আবার হাসিমুখে কথা বলার নাটক করেন। অধিকাংশ ডাক্তারের চেম্বারে রোগীদের চেয়ে ওষুধ কোম্পানির লোকদের ভিড় দেখা যায় বেশি। কোম্পানি থেকে যে যত বড় অফার দেয়, তার ওষুধও লেখেন তত বেশি। রোগী গোল্লায় যাক, তাতে তাদের কিছু যায়-আসে না। কোম্পানির পক্ষ থেকে ডাক্তার বাবুদের বাসা ও চেম্বারের জন্য নানা উপহার পাঠানো হয়। এগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা দেখেও না দেখার ভান করেন। কারণ দুর্নীতিকে হালাল করা হয় আরও বড় দুর্নীতি দিয়ে।
ফেসবুকে একটি কার্টুন দেখলাম। সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় বিভিন্ন কাজের জন্য। এই বরাদ্দ যে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে আসে—সব ধাপেই নির্দিষ্ট অঙ্কের পার্সেন্টেজ দিয়েই আসতে হয়। দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত যা থাকে, তা দিয়ে আর ওই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। ক’দিনের ব্যবধানে আবার যেই লাউ সেই কদু। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা তো অনেক আগেই আমরা পেয়ে গেছি। সময়ের ব্যবধানে একই প্রকল্পে বারবার বরাদ্দ, বারবার লুটপাট। বিজ্ঞজনেরা তাই বলে থাকেন, দেশে বহাল তবিয়তে আছে মাত্র দুটিই দল। একদল হলো লুটপাট পার্টি, আর অন্যদল হলো সাধারণ পাবলিক, যাদের হরদম লুট করা হয়। লুটপাট পার্টির কোনো আদর্শ নেই। তাদের গোড়া বড়ই মজবুত। ওদের রোখার শক্তি, সাহস ও সামর্থ্য যেন কারোরই নেই! আর সাধারণ পাবলিক শুধু মার খেয়ে খেয়েই জীবন পাড়ি দেবে। দিচ্ছেও।
লেখক : সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম
nazmulsylhet@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads