বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

দেশের ঠাকুর ফেলি…


বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মতায় আসার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশীদের ‘স্বাধীনতা সম্মাননা’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ নামে নানা ধরনের মর্যাদা দেয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে। ২৫ জুলাই ২০১১ সর্বোচ্চ স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ২৭ মার্চ ২০১২-তে ৮৩ জন বিদেশীকে সম্মাননা দেয়া হয়। তৃতীয় পর্বে ২০ অক্টোবর ২০১২ আরো ৬১ জন বিদেশীকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা জানানো হয়। এবার ১৫ ডিসেম্বর ২০১২-তে ৬০ জন বিদেশী বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্র, তার স্বামী রমেশ মিত্র, গণসঙ্গীতশিল্পী সলিল চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে, চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক ঋত্বিক ঘটক ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিল্পী মকবুল ফিদা হোসেন, রাজনীতিক বাঘা যতিন, নেপাল নাগ, নিবেদিতা নাগ, সাংবাদিক বাসব সরকার,  বরুন সেনগুপ্ত প্রমুখ। এর পাশাপাশি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পত্রিকার মুখপত্র প্রাভদা এবং ত্রিপুরার একটি হাসপাতালকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিদেশী বন্ধুদের সম্মান জানানোয় আমরা দোষের কিছু দেখি না। ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ সম্মাননা প্রদানের সে অনুষ্ঠান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে আমার মতো দেশের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী মানুষ দেখেছে। বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে আমাদের দেশীয় যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন এমন রাষ্ট্রীয় খেতাবধারী বীর উত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীকদের তেমন দেখা যায়নি। দেখা যায়নি মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সংগঠকদের, অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী; যাদের মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। হ্যাঁ, কিছু মুখের উপস্থিতি ছিল যারা মতাসীন দলের সুবিধাভোগী, উজির-নাজির এমন। ‘স্বাধীনতার মাসে মানবতার অপমৃত্যু’ শিরোনামে ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার লেখা কলামে লিখেছেন, ‘সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতার বেদনার সাথে জড়িত প্রত্য মুক্তিযোদ্ধারা সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই অবহেলিত, নির্যাতিত। এখনো পণ্ডিতেরা মনে করেন, তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি লেখালেখিতেই সব হয়ে গেছে। তাদের কাছে কলমের কালির দাম আছে, মুক্তিযোদ্ধার রক্তের কোনো দাম নেই। স্বাধীনতার ৪২ বছরে গ্রামগঞ্জের প্রত্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কত কী যে মাদারীর খেল হলো, বলে শেষ করা যাবে না; তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের দোষের অন্ত নেই। পদে পদে তাদের গলা টিপে ধরেছে। যারাই শাসক হয়, তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মায়াকান্না করে, চেতনার কথা বলে ফায়দা লোটে। কেউ এর ব্যতিক্রম নেই।’ একই কলামের অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘তবে আজ যে মেজর জেনারেল জ্যাকবকে নিয়ে এত নাচানাচি, সেই জেনারেল কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক দিনও রণাঙ্গন দেখেননি। আমরা মাইলের পর মাইল হেঁটে, কখনো গাড়িতে, কখনো হেলিকপ্টারে, কখনো মৌচাকে, কড্ডায় আবার সাভারের হেমায়েতপুরে রণাঙ্গনে উল্কার মতো ঘুরেছি। হেমায়েতপুর থেকে সৈন্যদের সাথে হেঁটে হেঁটে মিরপুর এসেছি। মিরপুর থেকে সসৈন্য ১৪ ডিভিশন হেডকোর্টার দখল নেয়াতেও যদি আমাদের কোনো কৃতিত্ব না থাকে, যশোর থেকে হেলিকপ্টারে মুক্ত ঢাকায় আসা মেজর জেনারেল জ্যাকবের সব কৃতিত্ব হয়, তাহলে এই ইতিহাস বিকৃতির জমানায় কী আর বলার থাকে।’

 মেজর জলিলের স্যা
মেজর জলিলের নেতৃত্বে বৃহত্তর বরিশাল-পটুয়াখালী শত্র“মুক্ত থেকেছিল ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ পর্যন্ত। এপ্রিলের শেষ নাগাদ বরিশাল-পটুয়াখালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে নেয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও মেজর জলিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন পশ্চিম বাংলার বশিরহাটের হাসনাবাদে। এ সময় বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে নবম সেক্টর গঠিত হলে কমান্ডার নিয্ক্তু হন তিনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ সেক্টরটিতে কোনো নিয়মিত বাহিনী ছিল না। প্রবাসী সরকার ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় মেজর জলিলের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠল ৮০ হাজার সদস্যের বিরাট মুক্তিবাহিনী। নবম সেক্টরকে ভাগ করা হলো পাঁচটি সাব-সেক্টরে। এগুলো ছিলÑ সাতীরা, খুলনা, সুন্দরবন, বরিশাল ও পটুয়াখালী। তার নেতৃত্বে ৭ ডিসেম্বর সাতীরা, ৮ তারিখে বরিশাল-পটুয়াখালী মুক্ত হলো। ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ী বেশে তিনি খুলনা প্রবেশ করেন। সেখানে মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন দলবীর সিং। মুক্তবাংলায় ভারতীয় বাহিনী লুটপাটে অংশ নিলো। বাংলার সম্পদ পাচার শুরু করল। এ সময় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এ লুটেরাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মেজর জলিল। মিত্রবাহিনীর প্রধান দলবীর সিংকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার সৈন্যরা লুটেরার ভূমিকা থেকে সরে না দাঁড়ালে আমি গুলি ছুড়তে বাধ্য হবো।’ দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলার মাটিতে কারারুদ্ধ হলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক, বিদেশী মিডিয়ার চোখে ‘হিপ্পি মেজর’ খ্যাত নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী। পাঁচ মাস সাত দিন পর তিনি মুক্তি পেলেন। বন্দীজীবন সম্পর্কে তার ছোট্ট বর্ণনাÑ ‘যশোর সেনাছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে বেলা ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ি না, যেন হানাবাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশে বেশ কিছু নরকঙ্কাল পড়ে আছে। ঘরের রুমে মানুষের রক্তের দাগ। কোনো ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল।’
রচনাবলীর অন্য এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি ২১ এপ্রিল, ১৯৭১ কয়েকটি মোটর লঞ্চ সহকারে সুন্দরবনের পথ ধরে ভারতের উদ্দেশে রওনা করি। প্রধান ল্যই ছিল ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা। বরিশাল সদর থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় সংসদ সদস্য (প্রাদেশিক) জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ইতিপূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বরিশালে ফেরত এসে আমাকে জানালেন যে, লে: জেনারেল অরোরা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙ্গালী অফিসারের কাছে অস্ত্রের সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত আছেন। এ তথ্য লাভের এক দিন পরই আমি কিছু মুক্তিযোদ্ধা সহকারে ভারত অভিমুখে রওনা হয়ে প্রথমে পৌঁছি পশ্চিম বাংলার বারাসাত জেলার হাছনাবাদ বর্ডার টাউনে। ঐ অঞ্চলের বিএসএফের কমান্ডার শ্রী মুখার্জির সঙ্গে হয় প্রথম আলোচনা। কমান্ডার মুখার্জি অত্যন্ত সহৃদয় বাঙ্গালী অফিসার। তিনি সর্বান্তকরণেই আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে সরাসরি লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিয়ে গেলেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তার হেডকোয়ার্টার। তিনি আমাকে প্রথম সাাতেই সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতে পারলেন না। সাী-প্রমাণ দাবি করলেন আমার কাছে। তখনই আমাকে সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী সাহেবের নাম দিতে হয়েছে। উত্তরে জেনারেল অরোরা সাহেব আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কে যা বাজে মন্তব্য করলেন তা কেবল ইয়াংকিদের মুখেই সদা উচ্চারিত হয়ে থাকে। সোজা ভাষায় তার উত্তর ছিলÑ ‘ঐ দুটো ব্লাডি ইঁদুরের কথা আমি জানি না, ওদের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। অন্য কোনো সাী থাকলে আমাকে বলো।’
 অস্থায়ী সরকার
১৭ এপ্রিল ১৯৭১ শেখ মুজিবুর রহমানকে (যিনি ২৫ মার্চ ১৯৭১ গ্রেফতার বরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে কারারুদ্ধ) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী; খোন্দকার মোশতাক আহমদ বৈদেশিক, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী; এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। উল্লেখ্য, প্রকৃতপে ১৯৭১ সালের জুন মাসের আগ পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলা’ সরকারের কোনো নির্দিষ্ট অফিস ছিল না। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত, বিএসএফের অফিস খালি করে প্রবাসী সরকার মন্ত্রিসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়।
মেজর জলিলের মতে, ‘ব্যক্তিজীবন পদ্ধতিতে সীমাহীন লোভ-লালসার কারণেই আশ্রয়দানকারী ভারতীয় কর্তৃপ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দুর্বলতাগুলো অতি সহজেই নির্ণয় করে নিয়েছে এবং তাদের ভোগবিলাসে কোনোরূপ বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থেকেছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপরে ঔদার্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উত্তরোত্তর কলঙ্কময় করে তুলতে সহায়তা করেছে। অপর দিকে, কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্বাধীন বাংলাদেশের অফিস থাকলেও মতার সব উৎসই ছিল ভারতীয় কর্তৃপ। স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব একজন সম্মানিত বন্দীর জীবনযাপন করা ব্যতীত আর তেমন কিছুই করার সুযোগ ছিল না তার।’
 মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং অবসান
এ দেশের কামার-কুমার, জেলে, তাঁতি, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ-আনসারে কর্মরত বাংলাদেশী এবং ছাত্র-জনতা সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রাতেই পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দেয়। হতভম্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেদিন আত্মরার জন্য ভারতীয় সীমান্তকে বেছে নেয়। ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে ভেসে আসে স্বাধীনতার ঘোষণা। এই ঘোষণার সাথে সাথেই সাড়ে সাত কোটি মানুষ ফিরে পায় আলোর দিশাÑ যুদ্ধের দিকনির্দেশনা। এরপর থেকেই সারা দেশে গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পরে সারা দেশকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের শেষ ১৪ দিন ভারতীয় সেনা কমান্ডের অধীনে থেকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ভারতীয় কূটকৌশলে পাক-ভারতের যুদ্ধে পর্যবসিত হয়ে ওঠে। অন্তত ইতিহাসে তো এটাই লেখা হয়ে আছে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। আত্মসমর্পণের দলিলে সুস্পষ্ট করে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ও সিভিলিয়ান ফোর্স তাদের অস্ত্র সমর্পণ করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কথা বলা হলেও সে দলিলে শুধু পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই জেনারেলই স্বার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দায়িত্বশীল কাউকে সেদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বীর সেনাদের অনেকেই এখনো জীবিত। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে তাদের অনেকেরই স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালায় খুব একটা ডাক পড়ে না। অথচ তাদের মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মতাসীন দলের অনুসারী না হলে তাদের এখন
পাকিস্তানের চর, রাজাকার এবং স্বাধীনতাবিরোধী বলে গালাগাল করা হয়। যারা স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মহান স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসকে দলীয়করণ করেছেন; ইতিহাস তাদের কখনোই মা করবে না।
লক্ষ শহীদের রক্ত আর অজস্র মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সম্মান জানান। প্রতিদিন স্যালুট করুন আমাদের যোদ্ধা বীরদের। দেশের আনাচে-কানাচে খোঁজ নিন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো কেমন আছে। ভারতীয়দের এ দেশে এনে সম্মাননা দেয়ার আগে আমাদের জীবিত বীর উত্তম, বীরপ্রতীক, বীরবিক্রমদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত ছিল। মৃতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা উচিত ছিল। দেশের বীর সন্তানদের যথাযথ সম্মানের মধ্য দিয়ে জাতি গৌরবান্বিত হয়। আর বিদেশীদের ডেকে এনে মুক্তিযুদ্ধের নামে যা করা হচ্ছে তা জাতিকে হীনম্মন্যতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। আমরা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইÑ কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের সেবাদাসদাসী হতে চাই না। এটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads