সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ


১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন তৎকালীন পাকিস্তানে এবং পরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বিরাট পদক্ষেপ ছিল। নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি জাতীয় পরিষদ আসনের মধ্যে ১৬৭টি ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে। সে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে আর কতটুকুই বা জাল ভোটের প্রভাব ছিল তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন চাকরিচ্যুত তথ্যসচিব আবু করিম। ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেই নির্বাচনের সময় আমার যা বয়স ছিল, তাতে আমি ভোটার হওয়ার কথা নয়। সুতরাং আমি ভোট দেইনি। তবে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলাম। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ভোটের সময় কিছু কিছু জাল ভোট পড়েছিলÑ যেমন আমাদের গ্রামে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের কয়েকজন চিহ্নিত সমর্থক ছিলেন, তারা সংখ্যায় আট-দশজন হবেন। সকাল বেলায় ভোটকেন্দ্র চালু হওয়ার পর সর্বপ্রথমেই তাদের ভোটগুলো অন্যলোক দিয়ে দেন। তারপর গ্রামের লোকেরা লাইন ধরে সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দিতে থাকে। জামায়াতের লোকজন যখন ভোট দিতে আসেন তখন তাদের জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। তবে এটা ঠিক যে, এই সামান্য কিছু জালভোট না দিলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করতেন’ (আমাদের একাত্তর, পৃ: ৫২০)। কিন্তু এই নির্বাচনই তৎকালীন পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার বৃক্ষে ফলকে পরিপক্ব করেছিল।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাবিরোধী অংশকে বাদ দিয়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বাকি সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের ঘোষিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী এ গণপরিষদ সাংবিধানিক পরিষদ হিসেবে (Constituent Assembley) ঘোষিত হয় এবং একই সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হলে গণপরিষদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা প্রতিপালিত না করে ৯২ দিন পর সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফ্ফর)। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কলঙ্কমুক্ত থাকতে পারেনি। জাসদের আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের বিজয়কে ছিনতাই করার জন্য দাউদকান্দি এলাকার সব ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনের ওপর ১৯৭৩ সালেই শুরু হয় ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাব বিস্তারের খেলা। ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের মসনদকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অনৈতিক পথ বারবার ব্যবহার করে।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ যে মোশতাক আহমেদকে নির্বাচিত করার জন্য সব ধরনের কারসাজি অবলম্বন করে, সেই মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক লীগ সরকার গঠিত হয় এবং তাদের হাতেই শেখ মুজিবকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়। এ বছরের ৬ নভেম্বর সামরিক শাসন জারি, সংসদ বিলুপ্ত করে সংবিধান স্থগিত করা হয়। পরদিন ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবর্তন এলেও স্থগিত সংবিধান চালু করা হয়নি, বাতিল সংসদ পুনর্বহাল করা হয়নি, এমনকি আগের দিনে (৬ নভেম্বর) নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমকে পরিবর্তন করা হয়নি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে প্রধান বিচারপতি একটি সামরিক সরকারের নেতৃত্বে দেন।
১৯৭৫ সালের ৪ জানুয়ারি বাকশাল গঠনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য শিষ্যের হাতে গণতন্ত্র ৪ মিনিটের মধ্যে বলি হয়। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে বাকশালব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিকব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং সংবিধানকে পুনর্জীবিত করা হয়। এ নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ছিল তা বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান গবেষকদের।
১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জেনারেল এরশাদ আমলে অনুষ্ঠিত হয়। এ দু’টি নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নির্বাচন কমিশন বারবার অনৈতিক ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। এমনও ঘটনা দেখা যায় যে, রাত্রে একজন প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণার পরদিন সকালে তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়েছে।
এক সময় এ অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশ্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব নিয়মের অতিরিক্ত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার তত্ত্ব, উপস্থাপন করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৮০ সালে (সম্ভবত) এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। জামায়াতে ইসলামী ৮-১০ বছর এ তত্ত্বটি জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালালেও এটিকে জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত করতে পারেনি।
১৯৯০ সালে কল্পনাতীতভাবে বিএনপি অধিক সংখ্যায় আসন লাভ করাতে তারা সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা এটিকে সূক্ষ্ম কারচুপির নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আওয়ামী লীগ তার চিরশত্রু জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির গোলাম আযমের তত্ত্বকে নিজ দলের একটি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে এবং পরবর্তী নির্বাচন কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার জন্য আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তত্ত্বটি যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর ছিল সে জন্য এরাও আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সে সময় বিএনপি প্রধান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা  তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে পরাজিত হয়।
২০০০ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন কমিশনকে তাদের দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে সাজিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। উল্লেখ্য, সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করার পরিকল্পনা ও প্রচারণা শুরু করেছিলেন। বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি এর প্রতিদান দেবেন। বিচারপতি লতিফুর রহমানও আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি ও পরবর্তী নির্বাচনের জন্য পরিকল্পনা ও প্রচারণা শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সাজানো বাগানও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে ওই দলকে কোনো ফুল ও ফল দিতে পারেনি। বরং ফলগুলো বিএনপির ঝুড়িতে জমা হয়েছে।
২০০৬ সালে এবং আওয়ামী লীগ অভিযোগ তুলে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরাই নির্বাচনের দিনক্ষণ হিসাব করতে গিয়ে বিনা চাহিদা ও প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারকের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেয় এবং নির্বাচন কমিশনও নতুন করে সাজানো হয়। আন্দোলনে সিদ্ধহস্ত আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে নির্বাচন না করার জন্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশে অসামরিক লেভেলে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ওই সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিলে সামরিক সরকারের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের প্রতি আনুকূল্য প্রকাশ করে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যোগ-বিয়োগ-পূরণ-ভাগের হিসাব কষে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিভিন্ন পথ খুঁজতে থাকে। আদালত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার নির্দেশনা দেয়া হলে আওয়ামী লীগ এটিকে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আদালতের রায়ের মূল স্পিরিট ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ না করে বিচারকদের নিষ্কলুষ রাখা। আদালতের এই স্পিরিট বাংলাদেশের জনমানুষের জন্য একটি কল্যাণকর দিকনির্দেশনা ছিল। আদালতের দ্বিতীয় যে নির্দেশনা ছিল তা হলো কমপক্ষে আরো দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংশোধন আনার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া।
বাংলাদেশের রাজনীতি আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনগত যোজন-যোজন ব্যবধানের কারণে এ দেশের মানুষেরা এ দু’টি শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ে। অন্যান্য ছোট ছোট দলগুলো বড় দু’টি দলের ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এক দিকে ১৪ দল বিপরীতে ১৮ দলের জোট-মহাজোট গঠনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতি দেউলিয়াপনা প্রকাশিত হয়। তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তি উত্থানের কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না; যেমনটি এক সময় ভাবা হতো কমিউনিস্ট পার্টি অথবা জামায়াতে ইসলামী তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশের মানুষের সামনে আবির্ভূত হবে। জোট-মহাজোট গঠনের মাধ্যমে সে আশা তিরোহিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতাসীন থেকে তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী কমপক্ষে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কতগুলো হঠকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো তথা কথা বলার অধিকার, রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার অধিকার, সমাবেশ করার অধিকার হরণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড ভারতমুখী করাসহ ভারতকে সব ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ করলে তাদের বিনা পরীক্ষায় উচ্চতর চাকরিতে নিয়োগ দেয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা সৃষ্টি করা, রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিনষ্ট করা, ইসলামি মূল্যবোধ ধ্বংস করা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করাসহ সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মাধ্যমে দেশের সব উন্নয়ন পরিবেশ নষ্ট করেছে।
দেশের আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিলেও তার দলীয় ও জোটের অনেক নেতা বিরোধী দলকে আলোচনা ও পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখার প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিপরীতে বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এই দল ও জোটের সব নেতাই এ বিষয়ে পূর্ণ আশাবাদ ব্যক্ত করলেও কঠিন আন্দোলনের মাধ্যমে তা পুনঃপ্রবর্তন করার বাস্তবসম্মত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার বিষয়ে সংলাপের জন্য আহ্বান জানান এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ‘সংলাপ অনুষ্ঠিত না হলে (গৃহ) যুদ্ধ অনিবার্য।’ অর্থাৎ আমাদের রাজনীতি একটি সঙ্ঘাতের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থের কারণে গণতন্ত্রকে হত্যা করে আবার কখনো কখনো গণতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করে। আর সব কিছুই করা হয় গণতন্ত্রের নামে ফাঁকা বুলির মাধ্যমে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় ভোটারের সংখ্যা ছিল আট কোটিরও ওপরে। প্রত্যেকের ভোটের মূল্য সমান। এখানে বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, বিদ্বান, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, চালাক, চতুর আর নির্বোধ, জ্ঞানহীন, বিদ্যাহীন, অনভিজ্ঞ, অবিবেচক সব ভোটের মান সমান। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতম দিক হলেও বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের শিক্ষার হারকে শতভাগে উন্নীত করে এর দুর্বলতা কাটিয়ে দিয়েছে।
একজন অশিক্ষিত, অবিবেচক, নির্বোধ মানুষ দেশ ও জাতির জন্য যতটুকু চিন্তা করবে তার পরিধি হবে খুবই নগণ্য। যে রাষ্ট্র বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্বোধ-জ্ঞানহীন মানুষের সমপর্যায়ে নিয়ে আসে তখন ওই রাষ্ট্রের সেই বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সামনের দিকে না তাকিয়ে পেছনের দিকে তাকাতেই বাধ্য হন। কারণ, তাকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় নির্বোধ ব্যক্তিরা পা ধরে টেনেহিঁচড়ে নামানোর চেষ্টাই করে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী যেমনটি পেছনে তাকাতে বাধ্য হয়ে বলেছেন ‘আমাদের পরিসংখ্যান অনেক আফ্রিকান রাষ্ট্রের পরিসংখ্যানের চেয়ে উন্নত’। যেখানে আমাদের তাকানো উচিত ছিল ইউরোপ-আমেরিকার পরিসংখ্যানের মানের দিকে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত যেসব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা কোনো না কোনোভাবে সরকার কলুষিত করেছে। আমাদের কোনো নির্বাচন কমিশনই রাজনৈতিক সরকারের অধীনে থেকে স্বাধীনভাবে তার দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্তভাবে পালন করতে পারেনি। সম্প্রতি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন বারবার পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবের কারণে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়। বিপরীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করে সরকার তার প্রভাবকে আরো দৃষ্টিকটূ করেছে।
ক্ষমতাসীন সরকার দু’টি বিষয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। যেমনÑ
১. তাদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ডে জনসাধারণ তাদের রাজনৈতিক দর্শন থেকে শুরু করে সব বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের ভরাডুবির সম্ভাবনা সুনিশ্চিত এবং ২. তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনকে সাজালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রভাবে ২০০০ সালের নির্বাচনের মতোও তাদের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যেতে পারে।
এ দু’টি উপলব্ধির ফলে আওয়ামী লীগ সরকার এবারের জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আমাদের সংসদকে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে সাজাতে হলে বিকল্প চিন্তার সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক কোন্দল, হানাহানি, নির্বাচন কেন্দ্র দখল ইত্যাদি বিষয়গুলোও নিরসন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমেই চিন্তা করে আসনটি লাভ করার জন্য তিনি বেশি যোগ্য যার লাঠিয়াল বাহিনী বেশি শক্তিশালী। অর্থের বিনিময়ে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করা যায় বলে ব্যবসায়ীরা নির্বাচনের সময় প্রার্থিতার জন্য দলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এতে করে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনের ময়দান থেকে বিতাড়িত এমনকি নিপীড়িত হন। বাংলাদেশের একজন নিবেদিত কমিউনিস্ট নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা কি আমাদের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রি করে দিয়েছি’?
বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থায় নির্বাচনী এলাকায় দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একজন প্রার্থীকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকেন। হয় তাকে দলীয় আদর্শের আস্থাশীল হতে হয় নতুবা তিনি দলীয় ইশতেহারে প্রভাবান্বিত হন নতুবা তিনি ব্যক্তির সততা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন নতুন বা তিনি প্রার্থীর মাস্তানিজমের কাছে আত্মসমর্পণ করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় এনে ভোট দিয়ে থাকেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে জড়ানো নিষেধ করা হয়েছে। যে বিশ্লেষণ থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান তথা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের যে সাংবিধানিক সুযোগ সৃষ্টি করা হয় তা ছিল বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিবিদরা বিচার বিভাগকে নিজেদের হীন স্বার্থ ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেদের পায়ে যেমন কুড়াল মেরেছে, অনুরূপভাবে বিচার বিভাগ ও রাজনীতিবিদদের হাতে ব্যবহৃত হতে পছন্দ করে জনগণের আস্থা হারিয়েছে। এনজিও নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা বিগত দিনে উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের প্রতিও আজ মানুষের আস্থা রয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ এক সময় যেসব এনজিও ব্যক্তিত্বরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে (জিও) এসে তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণের মতো তুচ্ছ কাজেও জড়িত হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে নতুন ধারনা উপস্থাপন করা সম্ভব, তবে বাস্তবায়ন কঠিন। অতএব রাজিৈনতক বাস্তবতার স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক ধারনাই এখন পর্যন্ত মন্দের ভালো ব্যবস্থা। সেদিকেই ফিরে যাওয়া উচিৎ। অতপর নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করার প্রক্রিয়া শুরু করার সুযোগ আসবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads