বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

‘ঝড়ের কাক’ সরকার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে



সিরাজুর রহমান
ঝড় যে উঠেছে সে কথা কাউকে বলে দিতে হয় না। এমনকি অন্ধ-বধিরকেও না। গাছগুলো নুয়ে ও ভেঙে পড়ছে, শোঁ শোঁ শব্দ আত্মাকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলছে। ঘরবাড়ির চাল, দেয়াল আর জানালাগুলো বিকট শব্দে আর্তনাদ করছে। অসংখ্য পশু ও পাখি (প্রায়ই বহু মানুষও) মারা যায় ঝড়ে। কাকগুলোর আত্মরক্ষার সে কী মর্মান্তিক প্রয়াস!
আওয়ামী লীগ সরকার যে এখন ঝড়ে পড়েছে এবং নেতাদের অবস্থা যে ঝড়ের কাকের মতো, সেটা তাদের উল্টাপাল্টা অসংলগ্ন ও অর্থহীন কথাবার্তা থেকে সবাই বুঝতে পারে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথাই ধরুন। রেলে চাকরিবাণিজ্য, মাঝরাতে এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা ইত্যাদি কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিছুকাল মাথা ঢাকা দিয়ে থাকলে হয়তো কখনো কেলেঙ্কারির স্মৃতি মানুষ ভুলেও যেতে পারত।
দুই কারণে সেটা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর খুবই দুরবস্থা। সমর্থনের খড়কুটোও এখন তার জন্য জরুরি। তাই পেছনের দরজা দিয়ে তিনি সুরঞ্জিতকে আবার মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনলেন। সুরঞ্জিত অকৃতজ্ঞ নন। নুন খেলে গুণ গাইতেই হয়। মাথা ঢাকা দেয়ার পরিবর্তে তিনি স্বভাবসুলভ ‘বকোয়াজ’ শুরু করতেও বিলম্ব করলেন না। এটাও তিনি ভুলে গেলেন যে তার নেত্রী প্রায়ই বলে ও প্রমাণ করে থাকেন যে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’।
সুরঞ্জিত জোরগলায় বলেছেন, আগামী বছরই যুদ্ধাপরাধীদের সবার ফাঁসি হবে। একে-দুয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রীই বারবার করে বলছেন সে কথা। আগামী বছর বর্তমান সংসদ আর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ‘রাজনৈতিক শত্রুদের’ তার আগেই খতম করার তাগিদ সহজেই বোধগম্য। প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে তার আগে বিচারপ্রক্রিয়া কি শেষ হবে? কানা ছেলের পদ্মলোচন নাম রাখার মতো গোঁজামিলের ট্রাইব্যুনাল গড়ে তার নাম দেয়া হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক’। সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা তো বটেই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনবিশারদেরা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো তখন থেকে বলে আসছেনÑ এ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক তো নয়ই, সম্পূর্ণ বৈধও নয়।
লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট সম্প্রতি সে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (বর্তমানে পদত্যাগকারী, আশির দশকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সক্রিয় কর্মী) নিজামুল হক নাসিম বহু ঘণ্টা ধরে বিদেশে তার বন্ধুর সাথে ট্রাইব্যুনালের কাজকর্ম, কলাকৌশল, সম্ভাব্য রায় এবং ঠিকাদার দিয়ে সে রায় লেখানোর সম্ভাবনা নিয়ে স্কাইপে এবং ই-মেইলে পরামর্শ করেছেন। আইন সম্বন্ধে স্বল্পতম জ্ঞানও যাদের আছে তারা অবশ্যই জানেন, কোনো চলমান মামলার রায় কী হবে, আগে থেকে বলে দেয়া বিপজ্জনক। এই একই কথা বলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের বিদায়ী চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিমের ধমক খেয়েছিলেন। এখন আবার আদালত অবমাননার দায়ে সুরঞ্জিতেরও কৈফিয়ত চেয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারপতি নাসিম ব্রাসেলসে তার বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘সরকারের গেছে মাথা খারাপ হইয়া। কেবল রায় চায়।’ অর্থাৎ তিনি বলে দিলেন যে ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর সরকারের অসম্ভব চাপ আছে। বর্তমান সরকারের আমলে কেউই ন্যায়বিচার আশা করে না। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক সময়সূচি অনুযায়ী সরকারের সুবিধাজনক রায় আদায়ের জন্য চাপ দেয়া যে কত ন্যক্কারজনক এবং বিচার
শব্দটির অপমান, সেটা কাউকে বলে দেয়ার প্রয়োজন হবে না।
দেশে ও বিদেশে অনেকেই বলেছেনÑ এ বিচার বিচার নয়, এ বিচার রাজনৈতিক শত্রুদের ঘায়েল করার ফন্দি। ট্রাইব্যুনালের ওপর সরকারের চাপ আরো একবার সেটা প্রমাণ করে। অবশ্য বাহ্যতই প্রমাণের এখন আর প্রয়োজন নেই। সরকার মামলা করেছে শুধু রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন ছাড়া সবাই জামায়াতে ইসলামী-দলীয়। আওয়ামী লীগে ভিড়ে গিয়ে যারা যুদ্ধাপরাধ থেকে গা বাঁচাচ্ছেন সেসব মুজিব কোট (আসলে সেটা জওয়াহের লাল নেহরু কোট) পরিহিত রাজাকার ও আলবদরদের কারো নাম নেই অভিযুক্তদের তালিকায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে ডুকরে কান্না ছাড়া বিচারের আর কী করার আছে?
নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের পর ট্রাইব্যুনালের কাজ আবার শুরু হয়েছে। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার যে তাদের রাজনৈতিক সময়সীমার মধ্যে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী রায় দানের নির্দেশও দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালকে। তা না হলে তারা কী করে জানেন যে এসব জটিল মামলার বিচার আগামী বছরের মধ্যেই শেষ হবে, অভিযুক্তরা সবাই দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং অভিযুক্ত সবাইকেই ফাঁসির দণ্ড দেয়া হবে? নাকি তারা স্থির করে ফেলেছেন, ট্রাইব্যুনালের রায় পাওয়া না গেলেও অভিযুক্তদের তারা ফাঁসিকাষ্ঠে লটকাবেন?
 বাংলাদেশের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
উইকিলিকস হাজার হাজার মার্কিন কূটনৈতিক দলিল ফাঁস করে দিয়েছিল। সারা বিশ্বের শত শত পত্রিকা সেসব বিবরণ প্রকাশ করেছে। সাধারণভাবেই মিডিয়ায় অজস্র বিবরণ প্রচারিত হয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রে আমার দেশ পত্রিকা ইকোনমিস্টের বিবরণের কিছু অংশ প্রকাশ করেছিল। সরকার ভয়ানক ক্ষেপে গেছে এ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। আদ্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার ভাঙা বাঁশ দিয়ে তাকে পেটানোর চেষ্টা হচ্ছে। ভদ্রলোক নিজের পত্রিকার অপিসে ‘রাজনৈতিক’ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। মাহমুদুর রহমানের ওপর সরকারের, জাতক্রোধ পুরনো কাসুন্দি। হাই কমান্ডের স্বজনদের দুর্নীতির খবর ছাপার সাহস দেখিয়ে সেই যে তিনি কোপে পড়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন; ‘সে ট্র্যাডিশন চিরদিন সমানে চলছে’। কিন্তু এ দিকে বিশ্বব্যাপী মাহমুদুর রহমানের ‘ইমেজ’ যে সরকারের জাতশত্রু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে, সে খবর কি তারা রাখেন?
প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের পরিবারের সবাইকে চোর বলেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং সারা বিশ্ব চোর বলে তার সরকারকে। চোখের চামড়া বোধ করি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি আশা করছেন, এখনো তিনি দেশের মানুষকে প্রতারিত করতে পারবেন। তিনি দাবি করছেন, খালেদা জিয়ার দুর্নীতির জন্যই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর টাকা দিচ্ছে না। তিনি বলেনÑ আওয়ামী লীগে দুর্নীতি নেই, দুর্নীতি আছে শুধু বিএনপিতে। কিন্তু তার বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেন যে ‘কিছু কিছু’ দুর্নীতি আছে সরকারে। আসলে এরা সবাই ঝড়ের কাক। ঝড়ে পালকগুলো খসে খসে পড়ছে, হয়তো ডানাও গেছে ভেঙে। কিন্তু কাক এখনো আশা করে ঝড়ের সাথে লড়াই করে উল্টো দিকে চলে যাবে সে।
প্রধানমন্ত্রী অজান্তে হলেও লোক হাসাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতাদের ‘তেল’ দিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। খালেদা আগেও দিল্লি গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, এবং একাধিকবার। সমানে সমানে তিনি ভারতের নেতাদের সাথে দুই দেশের স্বার্থ নিয়ে আলাপ করেছেন। ভারতীয় নেতারা এবার তাকে রাষ্ট্র-সফরে ডেকেছিলেন এ কারণে যে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা র ও ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী নির্বাচন হলে চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন খালেদা জিয়া। আগেভাগে তারা সুসম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সুসম্পর্ক বাংলাদেশেরও কাম্য। কিন্তু খালেদা জিয়া বলে এসেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু ভারতকে দেয়া হবে না। তিনি বলেছেন, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকারপ্রধান গোপনে যেসব দাসখতের চুক্তি করে এসেছিলেন দিল্লি গিয়ে, সেগুলো সংসদে পেশ করা হবে; সংসদ অনুমোদন করলে তবেই শুধু কার্যকর করা যাবে, অন্যথায় নয়।
ব্যাপারটা আসলে খুবই পরিষ্কার। ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে’ এ সরকার গঠিত
হয়েছিল। ভবিষ্যতেও ভারত অনুগ্রহ করে তাদের গদিতে বহাল রাখবে, এ আশায় ভারতের প্রতি নতজানু নীতি মেনে চলেছেন, ভারতকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকা এবং ভৌগোলিক সম্পদ অবাধে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে এসেছেন। এখন দেখছেন যে তাদের ‘আমও গেল ছালাও গেল’। ভারত এখন খালেদাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। বিচিত্র নয় যে তার কথাবার্তাগুলো ঈর্ষাতুর পরিত্যক্ত সতীনের বিলাপের মতোই করুণ শোনাচ্ছে।
 নিজের পায়ে কুড়াল মারছে ওরা
খালেদা জিয়াকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন মতিয়া চৌধুরী। আত্মসমর্পণ? কার কাছে? কী কারণে? দায়িত্বহীনের মতো কথাবার্তা বলে মতিয়া ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে হুঁশিয়ারি পেয়েছেন। সেটা অনেকটা হাতে মৃদু একটা থাপ্পড়ের মতো। মনে হচ্ছে তাতেও তার আক্কেল হয়নি। এবার আরো দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি খালেদাকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। মতিয়া কৃষিমন্ত্রী। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের কোনো সাধারণ চাষি-বউ ও রকম না ভেবেচিন্তে ওরকম কথা বলবেন।
বুদ্ধিহীনতায় মতিয়ার সাথে টেক্কা দিচ্ছেন মাহবুব-উল আলম হানিফসহ আরো দু-একজন। তারা বিএনপিকে ‘টোপ’ দিতে চেয়েছেন, বলেছেন জামায়াতকে পরিত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে ঐক্যজোট করতে রাজি হবে। মূর্খ আর কাকে বলে! আওয়ামী লীগ যে ১৯৯৬ সালে জামায়াতের সাথে জোট বেঁধে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবিতে আন্দোলন করেছিল, হরতাল আর সন্ত্রাস করে দেশ অচল করে দিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন করে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল, এবং তার পরেই লাথি মেরে জামায়াতকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল; সেসব কথা কি বিএনপি ভুলে গেছে? তা ছাড়া দেশ এখন খালেদা জিয়া আর বিএনপির পেছনে ঐক্যবদ্ধ। আজ হোক কাল হোক, খালেদা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো এবারো গণতন্ত্র এনে দেবেন দেশকে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের নৌকা মাস্তুল পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ নৌকার সাথে গাঁট বেঁধে নিজের ভরাডুবি বিএনপি কেন করতে যাবে?
সরকারের অবস্থা সত্যি সত্যিই ঝোড়ো কাকের মতো। ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে সে! প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা যার যা খুশি উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছেন, আর আশা করছেন যে নির্যাতন চালিয়ে আত্মরক্ষা করবেন তারা। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রমুখ হাজার হাজার বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে; বিনা বিচারে এবং বিনা জামিনে আটক রাখা হচ্ছে। নিজের জানা ইতিহাসও ভালো করে শেখেননি তারা। আইয়ুব খান আর ইয়াহিয়া খানেরা দফায় দফায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে, আজেবাজে মামলায় ফাঁসিয়ে তাকে কিংবদন্তি বানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের অনেক লোক ইতিহাস পড়েছেন, ইতিহাস জানেন। ব্রিটিশরা গান্ধী-নেহরু থেকে শুরু করে হাজার হাজার কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করেছে, জেলে পুরেছে। আন্দোলন থেমে থাকেনি। আর জেল খেটে খেটে ছোট নেতারাও বড় নেতা হয়েছেন। ব্রিটিশ এখন তাদের ও তাদের উত্তরসূরিদের তোয়াজ করে চলে। তাদের সাম্রাজ্য অস্ত গেছে সেই কত কাল আগে! অথচ আওয়ামী লীগও সে পথেই চলেছে। তারা বুঝতে পারছে না যে নিজের পায়ে তারা কুড়াল মারছে।
(লন্ডন, ২৫.১২.১২)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads