রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১২

‘আমি হিন্দু একথা বলার পরও নৃশংসভাবে বিশ্বজিৎকে হত্যা করে ছাত্রলীগ


পুরান ঢাকায় এ যেন ২০০৮ সালের ২৮ অক্টোবরের পুনরাবৃত্তি!

গতকাল রোববার পুরান ঢাকায় সূত্রাপুর এলাকায় ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্বজিৎ দাস (২৮) নামে বিএনপি কর্মী নিহত হয়। ইনসেটে বিশ্বজিৎ এর পাশে ছাত্রলীগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলাম গ্রুপের বাংলা বিভাগের ছাত্র মাহফুজুর রহমান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নূরে আলম মিলন এ হামলার নেতৃত্ব দেয় -সংগ্রাম
এ যেন ২০০৮ সালের ২৮ অক্টোবরের পুনরাবৃত্তি! রড, লাঠি এবং পরে কুপিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২৪ বছর বয়সের এক টগবগে যুবককে। একের পর এক আঘাত সত্তেবও জীবন রক্ষায় বারবার নিজের পরিচয়ও জানালেন তিনি। কিন্তু আক্রমণকারীরা যে সেই লগি-বৈঠার তান্ডব সৃষ্টিকারী। তাই তো মানবিকতা ভুলে পৈশাচিকতায় নির্মম নির্যাতনে মেতে উঠে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা। তার আত্মচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। কিন্তু একটুও দয়া হয়নি পাষন্ড খুনী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের। শিবির বা ছাত্রদল কর্মী সন্দেহে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে গতকাল রোববার প্রকাশ্যে নির্দয়ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নিরীহ তরুণ বিশ্বজিৎ দাসকে। যেই তরুণ কি-না কোনো রাজনীতির ধারে কাছেও ছিল না। তাকেই ‘রাজনৈতিক কর্মী' সন্দেহে বলি হতে হলো। বাঁচার জন্য ‘আমি হিন্দু' পরিচয় দিয়েও রক্ষা পাননি বিশ্বজিৎ দাস।
সময়টা সকাল ৯টা। একজনকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করতে গিয়ে বাসা থেকে বের হলেন পুরান ঢাকার দর্জি ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ। হঠাৎ ককটেল বিম্ফোরণ। এরপর প্রাণভয়ে দৌড়। আশ্রয় নিলেন পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া ডেন্টাল ক্লিনিকে। তখনও কে জানত, এখানেই ঘটবে সেই মর্মন্তুদ, হূদয়বিদারক, নৃশংস ঘটনা। কে জানত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ২০০৮ সালের ন্যায় আবারো নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠবে। ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে গতকাল সকাল পৌনে ৯টার দিকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগ আর বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর বিশ্বজিৎ দাসকে রড-লাঠি আর চাইনিজ কুড়াল দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই তরুণের সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছিল। এরপরও তাকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। বারবার নিজের পরিচয় দিচ্ছিল সে। কিন্তু অনেকটা মৃত্যু নিশ্চিত করেই যেন শান্তি পেল সরকারি দলের সোনার ছেলেরা। রক্তভেজা শরীরে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। সেখানে শিবিরকর্মী সন্দেহে তার চিকিৎসায় চরম অবহেলা করা হয়। এক পর্যায়ে নিভে যায় এ সম্ভাবনাময় তরুণের জীবনপ্রদীপ। হাসপাতালে আর টেলিভিশনে এমন মৃত্যুর দৃশ্য দেখে অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেন। গতকাল সন্ধ্যার পর বিশ্বজিতের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে এক হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নিহত বিশ্বজিৎ শাখারী বাজারের নিউ আমন্ত্রণ টেইলার্সের কর্ণধার ছিলেন।  বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় মাহফুজুর রহমান, নূরে আলম ও সুকান্ত বার্মা শান্তসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ ক্যাডার জড়িত বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। 
এমন মৃত্যু দৃশ্য দেখার পর অনেকের প্রশ্ন- আর কত রাজনীতির বলি হবে একেকটি প্রাণ।  আর কত মায়ের কোল খালি হবে। কী দুর্ভাগ্য বিশ্বজিতের। সরকার সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা আজ কোথায় এমন জিজ্ঞাসা অনেকের। বিশ্বজিতের পরিবারের কান্না আর আহাজারিও যেন কেউ শুনতে পাচ্ছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবারকে সমবেদনা পর্যন্ত জানাতে যায়নি। তবে গতকাল বিকেলেই তার মরদেহ তাকে দেখতে গিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জোটের নেতারা। তিনি এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের শাস্তিও দাবি করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনরা জানান, গতকাল সকাল ৯টায় বিশ্বজিৎ দাস নিজের দোকানে যেতে হূষিকেশ দাস রোডের বাসা থেকে বের হন। পায়ে হেঁটে তিনি যাচ্ছিলেন তিলেতিলে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। বাসার অদুরে বাহাদুরশাহ পার্কে যেতেই সামনে পড়ে অবরোধ সমর্থিত বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একটি মিছিল। এর কিছুক্ষণ পরই সেখানে ধেয়ে আসে জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয় ও কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মিছিল। শুরু হয় আইনজীবীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। ঝামেলা এড়াতে বিশ্বজিৎ বাহাদুর শাহ পার্ক লাগোয়া পানির টাংকির ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। এসময়  বিকট শব্দে পরপর দুটি ককটেল বিম্ফোরিত হয়। সতর্ক বিশ্বজিৎ আতংকে দৌড়ে পাশের ভবনের একটি দোতলা ডেন্টাল ক্লিনিকের সামনে গিয়ে ওঠেন। এরপরই ছাত্রলীগের একটি দল লাঠি ও অস্ত্র হাতে সেখানে যায়। ক্লিনিকে আশ্রয় নেওয়া লোকজনকে  এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে। অনেকে দৌড়ে আর দোতলার রেলিং থেকে লাফিয়ে পালাতে পারলেও বিশ্বজিৎকে ধরে ফেলে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা।  তাকে টেনেহিঁচড়ে, পেটাতে পেটাতে নিচে নামানো হয়। প্রথমে লাঠি, পরে রড তারপরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে শুরু হয় কোপানো। ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে যায় বিশ্বজিতের গায়ের জামা। ডেন্টাল ক্লিনিকের দোতলা বারান্দার ফ্লোর আর সিঁড়িতে লেগে থাকে ছোপছোপ রক্তের দাগ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামাতেই সেখানে তেলের পাম্পের কাছে রড, চাপাতি হাতে এক দল যুবক তেড়ে আসে। তারা ককটেল বিম্ফোরণের সব দোষ চাপিয়ে দেয় বিশ্বজিতের ওপর। আবার শুরু হয় কিল-ঘুষি-লাথি। নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট আর হাতাকাটা গাঢ় নীল রঙের সুয়েটার পড়া এক যুবক বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। সঙ্গে যোগ দেয় মুখে রুমাল বাধা হাতে ধারালো অস্ত্র থাকা অপর এক যুবক। চলতে থাকে কিল-ঘুষি। কাকুতি জানিয়ে নিজের হামলাকারীদের কাছে নিজের নাম আর পেশার পরিচয়ও দেয় বিশ্বজিৎ। তবু থামেনা ওই ক্যাডাররা। রক্তে তার পরনে থাকা জামার রঙটাও পাল্টে যায়। আওয়ামী লীগের লাশের রাজনীতির বলি নিস্তেজ বিশ্বজিৎ পড়ে থাকে পিচ ঢালা পথে।  রক্ত ঝরতে থাকে তার দেহ থেকে। ততক্ষণে উল্লাস করতে করতে কেটে পড়ে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুরো ঘটনার সময় অদুরেই রণসাজে অবস্থায় ছিল পুলিশ আর র‌্যাব সদস্যরা। এগিয়ে আসেনি কেউ।
হাসপাতালে নেয়া বিশ্বজিতকে বহনকারী রিকশা চালক রিপন মিয়া বলেন, রিকশায় ওঠানোর পরও আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন ওই লোক। তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নেয়ার পর চিকিৎসকরাও এগিয়ে আসেনি। অন্তত ২০ মিনিট ধরে জরুরী বিভাগে পড়ে থাকেন ওই ব্যক্তি। শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে ডাক্তাররাও চিকিৎসা করাতে অপারগতা দেখায়। একই অভিযোগ বিশ্বজিতের পরিবারের সদস্যদের। খবর পেয়ে তার স্বজন আর শাঁখারীবাজারের প্রতিবেশি কয়েক ব্যবসায়ী ছুটে যান হাসপাতালে। তাদের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে শুরু হয় চিকিৎসা। শরীরে স্যালাইন পুশ করিয়ে বাম হাতের উপরের দিকের ক্ষত স্থানে সেলাই দেয়া শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পর ৯ টা ৫৫ মিনিটে চিকিৎসক আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘোষণা করে তাকে। মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে একটি তাজা প্রাণ নিভে গেল সরকারি দলের সোনার ছেলেদের দানবীয় নির্মম নির্যাতনে। মর্গে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্বজিতের বা ঘাড়ের নিচে আর পিঠে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। রক্তাক্ত সারা শরীরে রড আর লাঠি দিয়ে পেঠানোর দাগ। 
মৃত্যুর খবরে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেখানে এমন মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনার জানান, কি ঘটেছিল তা তদন্ত ছাড়া তার পক্ষে বলা যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত হবে না। তবে তিনি জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের আশ্বাস দেন। 
৫৩ নম্বর হূষিকেশ দাস রোডের দোতলা ভাড়া বাড়িতে ভাই-ভাবীর সঙ্গে থাকতেন বিশ্বজিৎ। ওই বাসায় কথা হয় বড় ভাই উত্তম দাসের সঙ্গে।  তিনি বলেন, ‘ভাইটাকে অবরোধের সমর্থনকারী বলে যখন পিটিয়ে রক্তাক্ত করছিল, তখন আমার ভাই চিৎকার দিয়ে বলছিল আমি হিন্দু। আমি কোন রাজনীতি করি না। আমি শাঁখারী বাজারে দোকানে যাচ্ছিলাম। আমাকে মারবেন না। তবু কেউ শুনেনি ভাইয়ের চিৎকার।'
ভাবী শুক্লা দাস বলেন, হাসপাতালে নেয়ার পরও বিশ্বজিৎ তার নিজের নাম আর ধর্মের পরিচয় দিয়েছে। তারপরও শিবির ভাবায় দীর্ঘক্ষণ বিনা চিকিৎসায় পড়ে ছিল বিশ্বজিৎ।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্বজিতের মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ার মশুরা গ্রামে পৌঁছে। এসময় পরিবারে বিলাপ আর শোকের মাতম শুরু হয়। বৃদ্ধা বাবা অনন্ত দাস আর মা কল্পনা দাস ছেলের লাশ দেখে বারবার মূর্ছা যান। আর এক মাত্র বোন চন্দনা দাস বিলাপ করে বলতে থাকেন, দুই সপ্তাহ পরেই ভাইয়ের বাড়ি আশার কথা ছিল। তার আগেই আসলো ভাইয়ের নিথর দেহ। বোনের কথা, ‘আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো কেন রাজনীতির নিষ্ঠুরতার কাছে হেরে যাবে।'
এদিকে শরীয়তপুরের স্থানীয় ভোজেশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইসমাইল হক বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বিশ্বজিৎ ঢাকায় থাকে। তবে এলাকায় তার যোগাযোগ ভালো ছিল। তারা সরাসরি কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও পুরো পরিবারটিই আওয়ামী ঘরনার বলে জানান ওই এলাকার চেয়ারম্যান।  

২টি মন্তব্য:

  1. হ্যালো, আপনি একটি ব্যবসা ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহ ঋণ খুঁজছেন
    ইত্যাদি.? আমরা বর্তমানে কোন ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা ঋণ প্রস্তাব করা হয়
    আগ্রহী ব্যক্তি 1 থেকে 30 বছর 2% সুদের হারে.
    নাম:
    জন্ম তারিখ:
    লিঙ্গ:
    বৈবাহিক অবস্থা:
    ঠিকানা:
    শহর:
    দেশ:
    ফোন:
    লোন পরিমাণ:
    ঋণ সময়কাল:
    নিট মাসিক আয়.
    আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: creditsolutionhome@outlook.com

    উত্তরমুছুন
  2. হ্যালো, আপনি একটি ব্যবসা ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহ ঋণ খুঁজছেন
    ইত্যাদি.? আমরা বর্তমানে কোন ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা ঋণ প্রস্তাব করা হয়
    আগ্রহী ব্যক্তি 1 থেকে 30 বছর 2% সুদের হারে.
    নাম:
    জন্ম তারিখ:
    লিঙ্গ:
    বৈবাহিক অবস্থা:
    ঠিকানা:
    শহর:
    দেশ:
    ফোন:
    লোন পরিমাণ:
    ঋণ সময়কাল:
    নিট মাসিক আয়.
    আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: creditsolutionhome@outlook.com

    উত্তরমুছুন

Ads