সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সঙ্ঘাত না সমঝোতা


 ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও খ্যাতিমান লেখক উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুদ্ধপরিস্থিতি অনুকূলে এনে ব্রিটেনকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে রার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে দতার কারণে যথেষ্ট প্রশংসিতও হয়েছিলেন। তার পরও সংসদীয় নির্বাচনে পরাজিত হন। পরাজয়ের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ÒPeople has a right to kick me out, that is democracy, that is what we have been struggling for. এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘আমাকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার জনগণের আছে, এটিই গণতন্ত্র। এর জন্যই আমরা দীর্ঘ দিন থেকে সংগ্রাম করে আসছি।এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তিনি ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, উইনস্টন চার্চিলের মতো জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের ত্যাগের বিনিময়ে ব্রিটেন আজ একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বময় সমাদৃত। এ দৃষ্টান্ত যদি আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের েেত্র মূল্যায়ন করি তা হলে বুঝতে পারব, তাদের কথার সাথে কাজের দূরত্ব কত ব্যাপক! অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কোনো রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯৮১ সালে ডেভিড বাটলারসহ অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কর্তৃক ২৮টি রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মূল্যায়িত করার ঘটনাই এর উদাহরণ। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হলো তারই অবিনাশী ফসল। 
সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের প্রধান ল্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যার ভিত্তি হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা-উত্তর প্রতিটি শাসকই এ গণদাবি পূরণে ব্যর্থ। স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তার গতিরোধ করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল ভেঙে এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা এ জাতিকে অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এ মডেলই আজ পাকিস্তানকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়েছে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। 
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন মতার যা প্রধানত নির্বাচনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। সুতরাং নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপে ও অংশগ্রহণমূলক না হয়; তবে এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার বৈধতার সঙ্কটে পড়বে। ফলে অবৈধ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার জনগণ পেয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। দেশ ক্রমে ধাবিত হবে গৃহযুদ্ধের দিকে। একমাত্র দূরদর্শী নেতৃত্বই এ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সম। রাষ্ট্র পরিচালকদের বোধোদয় না হলে এ অনাকাক্সিত ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলও সরকারের অংশ এবং তাদের বিরোধিতা বৈধ। সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা না করে ব্রট মেজরিটির ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতো একটা মীমাংসিত বিষয়কে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন এক সময়, যখন প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিদ্যমান থাকবে। সংসদ সদস্যরা তাদের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। নির্বাচনে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটাবেন। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এটি অনুমান করাও কষ্টকর। কারণ এ েেত্র ভোটদান প্রক্রিয়ার নির্বিঘœতা ও ভোট গণনার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কোনো রাজনৈতিক দল মতাসীন থেকেই সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করার অর্থই হলো রাষ্ট্রীয় মতাবলয়ে কাউকে প্রবেশ করতে না দেয়া। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল। একমাত্র হিটলার কিংবা মুসোলিনির মতো রাষ্ট্রনায়কদের দিয়ে এসব সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করা সম্ভব। কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক দিয়ে এসব সম্ভব নয়। এটি হাস্যকর সিদ্ধান্ত। 
যেসব কারণে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন জনবিচ্ছিন্ন হবে তার কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত; বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রতি দেয়নি। দ্বিতীয়ত; নির্বাচনের সময়ে সরকারপ্রধান ও সংসদ সদস্যদের প্রভাব বিদ্যমান থাকবে। তৃতীয়ত; নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সরকার বৈধতার সঙ্কটে পড়বে। উল্লেখ্য, কমনওয়েলথ ও জাতিসঙ্ঘসহ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেন নির্বাচনে সর্বদলীয় অংশগ্রহণে গুরুত্ব দিচ্ছে। চতুর্থত; সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিক রূপ পাওয়ার পর ও জনমত যাচাই না করে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা বাতিল করে জনগণের বিরুদ্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পঞ্চমত; বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রভাবমুক্ত নয়। দলীয় আদর্শের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছেন। সুতরাং তাকে দিয়ে নিরপে নির্বাচন পরিচালনা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। 
জনমত প্রতিফলিত ব্যবস্থাই গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক সরকার জনমতের সরকার। বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপ অনুযায়ী ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ জনগণ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি। সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে উপো করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরামর্শ না নিয়ে এককভাবে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক ধারাকে গতিরোধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে; যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সঙ্কট ও দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। ক্রমে সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ েেত্র গণভোটের ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। সুতরাং গণতান্ত্রিক ধারাকে যৌক্তিকপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গণদাবিকে সম্মান প্রদর্শন করে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে এর সুফল এক দিন বর্তমান সরকারি দলই ভোগ করবে। এটিই গণতন্ত্রের ব্যবস্থা। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads