মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাইরে...


সরকারের সময় একেবারে শেষ। বিদায়ের ঘণ্টা যে বেজেছে, সেটি টের পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সম্ভবত সড়ক পরিবহণমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কয়েক দিন আগে বলেছেন যে, মধ্যরাতে অন্ধকারের পথিক যেমন উচ্চ কণ্ঠে গান গায়, তেমনি উচ্চ কণ্ঠে শেখ হাসিনা তার সরকারের জয়জয়কার করছেন। আর এলোপাতাড়ি তার সরকারের বাইরে যারা আছেন, তাদের নানা ভাষায় গালাগাল করছেন।
শেখ হাসিনার সরকারের নরহত্যা আর লুণ্ঠনের কাহিনী এখন বিশ্বব্যাপী বিদিত। কিন্তু তিনি থেমে নেই। নির্বাচনী সকল আচরণবিধি লঙ্ঘন করে তিনি ঘর থেকে বের হয়েছেন। আর সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা, বিশাল লটবহর, বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। বিধি অনুযায়ী নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে কেউ এ ধরনের প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। প্রচারণা চালাতে পারে না। এটা রোধ করতে কে পারতো? নির্বাচন কমিশন। সে রকম নামের যে প্রতিষ্ঠান এখনও আমাদের দেশে আছে, তাদের জন্য বড় মায়া হয়। তারা দু’হাত, দু’পা-বিহীন অথচ জীবন্ত। এবং কী আশ্চর্য, মানুষ হিসেবে বেঁচে আছেন।
আমরা তাদের করুণা করি না। মনে হয়, ছোট্ট কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুকে যেভাবে মানুষ আদর করে, সেভাবে আদর করি। টেলিভিশনে একজন দু’হাত, দু’পা-হারা মানুষের সামগ্রিক জীবনের গল্প দেখলাম। বড় কষ্ট হয়। কিন্তু মায়া করছে না কেউ? আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, পিতা-মাতা, পাড়া-প্রতিবেশী, সকলেই তাকে খুব মায়া করছে। বয়সও হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অঙ্গহীন নির্বাচন কমিশন যদি এমন থাকে, তাহলে কোলে-চড়ে-থাকা সেই মানুষটির পক্ষে আর কী-ই বা বলা সম্ভব? হাত-পা-বিহীন নির্বাচন কমিশন এখন সরকারের কোলে চড়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করছে। এবং এর যে বেহায়া প্রধান তার ছবি নিয়ে অসংখ্য কার্টুন হচ্ছে। মানুষ ভালবেসে তাকে কোলে তো তুলে নিচ্ছেই না, বরং এমনকি, তার মুখে থুতু মারছে। আর এই ব্যক্তিত্বহীন বেহায়া লোকটি তা পরম সহিষ্ণুতায় গায়ে মেখে হজম করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচন নিয়ে অনেক ধরনের তেলেসমাতি কা- হয়েছে। কিন্তু এমন হস্তপদহীন নির্বাচন কমিশন সম্ভবত কোনোদিনই আবির্ভূত হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটি নির্বাচন কমিশন তৈরী হয়েছে, যারা নিজেরা নিজেদের হাত-পা কেটে ডালায় তুলে সরকারকে উপহার দিয়েছে। এই প্রথম এক ব্যক্তিত্বহীন, মর্যাদাহীন লোক বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের প্রধান হয়েছেন।
আমি মাঝেমধ্যেই আমার লেখায় লালন ফকির, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ছড়া, গল্প-কল্পকাহিনী, কবিতা, উপন্যাস উদ্ধৃত করি। কেউ কেউ এর সমালোচনা করেন। কেউ কেউ ভূয়সী প্রশংসা করেন। আবার কেউ কেউ গালি দেন। যারা গালি দেন, সাধারণত তাদের গালির জবাব দেই। বলি, আমার লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। এর বাইরে আর কিছু বলবারও নেই। বলিও না।
কিন্তু আজকেও লালন ফকিরের একটি গান উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। সেটি হলো, ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর’, বাড়ির পাশে আরশী নগর/ সেথা পড়শী বসত করে,/ এক ঘর পড়শী বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।/গেরামবেড়ে অগাধ পানি/ নাই কিনারা, নাই তরণী পাড়ে,/ বাঞ্ছা করি দেখবো তারে/ কেমনে সেথা যাইরে/ আমি কেমনে সেথা যাইরে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/ কী বলবো পড়শীরও কথা/ হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাইরে/ খনিক থাকে শূন্যের উপর/ খনিক ভাসে নীরে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’
এসব গান শুনলে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আমার উপর যার পর নাই বিরক্ত হয়ে আমাকে গাল দেয়। এই যে গাল দেয়, কিংবা গাল দেয় না, কেউ কেউ মুখে বলে আমি ভুল করেছি, তাদের সবার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয়, কোথায় যেন আমরা তাদের সত্যি সত্যি প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারিনি। এ আমার পাপ। এ আমার শাসকদের পাপ।
লালন শাহের গান এই জন্য উদ্ধৃত করেছি যে, এইসব তরুণ-তরুণী এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি লালনের গান শোনে। এরা সব জিগজ্যাগ, ড্যাংডুং শোনে। ড্যাংডুং গানে অভ্যস্ত। তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। একই সঙ্গে যদি তারা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে চোখ মেলে দেখে! তাদের ভেতরেও দূরদৃষ্টি জাগিয়ে তোলা দরকার। এই প্রজন্মের অনেকেই নির্বাচন বা নির্বাচন কমিশন, এদের দায়দায়িত্বÑ এসব বিষয়ে খুব একটা সচেতন বলে মনে হয় না। কিন্তু এই প্রজন্মের জন্য প্রশাসন, গণতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই বাংলাদেশে এখন আমরা যারা বেঁচে আছি, এক সময় না এক সময় তারা গত হয়ে যাব। নতুন যে প্রজন্ম তারাই হবে দেশের কর্ণধার। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তাবে। সেখানে গিয়ে তারা দেখবে গণতন্ত্র যেমন তাদের জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন। প্রয়োজন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা। আর প্রয়োজন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য গঠিত একটি সুশৃঙ্খল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাই নতুন প্রজন্ম যদি এখন থেকেই সে ব্যাপারে সজাগ না থাকে তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যখন তাদের কাঁধে এসে পড়বে, তখন তারা হবে সম্পূর্ণরূপে দিশেহারা।
এই যে সরকার বলছে সংসদও থাকবে, মন্ত্রিসভাও থাকবে, তার মধ্য দিয়েই আর একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি একেবারেই অকল্পনীয় ব্যাপার। আর ধারণা করি, সরকার ছাড়া আর কোন পাগলেও এ ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাবে না। যদি না যায়, তাহলে এখনই চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে, দেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। গণতন্ত্র সুনিশ্চিতকরণ আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব তরুণ সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে। যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এখন আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি, সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা একদিন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তখন হিমশিম খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
২০০৮ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৭৩ সালের পর এমন নির্বাচন বাংলাদেশে আর কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। একেবারেই পাতানো, একেবারেই জোর-জবরদস্তিমূলক। শেখ হাসিনা সরকার এখন বলছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আর কখনো ফিরিয়ে আনা হবে না। এ ব্যবস্থা বড় খারাপ। কিন্তু ২০০৮ সালে যে সরকারের অধীনে আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন, সে সরকারও ছিলো তার ভাষায় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অবৈধ হয় তাহলে সেই সরকারের অধীনে নির্বাচিতরাও ততোধিক অবৈধ। সে দৃষ্টিতে বর্তমান সরকারও সম্পূর্ণ অবৈধ সরকার।
এখন গপ্পো শুনছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে বাঘে খাবে। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এই ১৫ বছর তো কাউকে কোন বাঘকে খেতে দেখলাম না। সব কিছুতো ঠিকঠাকই চলছিলো। এই সময়ের সরকারগুলো একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা ছিলো এমন দাবি আমি করতে চাই না। তখনো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিক থেকে দেশ স্বর্গরাজ্য ছিলো না। সেসময় দেশে দুর্নীতি ছিলো। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও ছিলো। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে, অর্থনৈতিকভাবে দেশ ধীরে ধীরে এগিয়েও যাচ্ছিলো।
সরকার বললো, কেউ যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে তাহলে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। কিন্তু মঈন-ফখরুদ্দিনরা অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল করেছিলো। শেখ হাসিনা তখন সেটাকে তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। এবং সে সরকারকে দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, ঐ সরকার যা কিছু করবে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তিনি তা বৈধ করে দেবেন। সেই অসাংবিধানিক সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। এবং আশ্চর্য এই যে, তাদের সকল কর্মকা- বৈধ করেছেন। আর তাদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি। তাহলে এখন কেনো এতো ভয়।
সে ভয়ের প্রধান কারণ সরকারের পর্বত প্রমাণ দুর্নীতি, নির্বিচারে মানুষ খুন, সর্বগ্রাসী লুন্ঠন যা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ক্ষমতা থেকে যদি বিদায় হতে হয়, তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এই সমস্ত অপকর্মের জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। সে কারণে শেখ হাসিনা সরকার কিছুতেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে চাইছেন না। কিন্তু ক্ষমতা তো অনন্তকাল স্থায়ী হয় না। একদিন না একদিন ক্ষমতা তাদের ছাড়তেই হবে।  তখন অবশ্যই তার দোসর ও সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। দুই একজন স্বৈরশাসক পালিয়ে পার পেলেও সবাই পার পাবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads