বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নিজের সাথে কথা বলাই এখন সময়ের দাবি


আমরা অনেকের সাথেই কথা বলি, কথা বলি পক্ষের ও বিপক্ষের লোকদের সাথেও। কিন্তু কথা বলি না নিজের সাথে। এর চাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার আর কি হতে পারে? নিজের সাথে কথা না বলার কারণে আমরা মানুষ হিসেবে নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারি না, মূল্যায়ন করতে পারি না নিজের কর্মকা-কেও। যে নিজেকে ও নিজের কর্মকা-কে মূল্যায়ন করতে পারে না সে অন্যের কর্মকা-ের মূল্যায়ন করার যোগ্যতা রাখে কি? অথচ আমরা এমন মানুষরাই প্রতিদিন কত মানুষের কর্মকা-ের শুধু সমালোচনাই নয়, নিন্দাবাদও করে চলেছি। এমন অবস্থা জীবনের কিংবা সমাজের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্তরে সীমাবদ্ধ নয়। ব্লেম-গেম ও নিন্দাবাদের ঝড়  আজ সর্বব্যাপী। আত্মসমালোচনা, আত্মগঠন, সঙ্গত সমালোচনা, সৎ পরামর্শ ও শুভ কামনার যেন দুর্ভিক্ষ চলছে দেশে। এ প্রসঙ্গে দলমত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, সরকার কিংবা বিরোধীদল সবাইকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। এমন বক্তব্যের উদ্দেশ্য কিন্তু হতাশা ছড়ানো নয়। মানুষ হিসেবে আমাদের কর্মকা- আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে বিষয়টি উপলব্ধির মাধ্যমে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিবেকের আহ্বানে সাড়া দেয়ার সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যেই এমন আলোচনার অবতারণা।
বর্তমান সময়ে শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বৈঠকখানাসহ প্রায় সর্বত্র প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক আলোচনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রতিযেগিতামূলক এই বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে এ জাতির হাতে যেন কোনো কাজ নেই। রাজনৈতিক বিতর্ক ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোই যেন এখন আমাদের জন্য সবচাইতে বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় কোনো জাতি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। আমরা জানি আমাদের দেশে রাজনীতির মূল বিষয়টাই হয়ে উঠেছে নির্বাচন। রাজনীতির যে দেশ ও জাতির কল্যাণে আরো বহু দায়িত্ব রয়েছে সে কথা যেন আমরা ভুলে গেছি। জনগণও যেন ভোট্রে দিনে একদিনের গণতন্ত্রকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন এক অবস্থায় আমরা একটি জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি। অথচ নির্বাচনটা কোন পদ্ধতিতে হবে, কিভাবে হবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। এসব নিয়ে এখন চলছে অবজ্ঞা, হুমকি-ধমকি ও বিদ্বেষের নানা তৎপরতা। ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, সংঘাত ও সংঘর্ষ যেন সামনে অপেক্ষা করছে জাতির জন্য। জনগণও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে নানা আতঙ্কের মধ্যে জীবন যাপন করছে। এমন পরিস্থিতির জন্য তো জনগণ কাউকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায় না। জনগণ চায় শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা, চায় জীবন মানের উন্নয়ন। কিন্তু আমাদের শাসক কিংবা রাজনীতিবিদরা জনগণকে তেমন কিছু উপহার দিতে সমর্থ হয়নি। এর মূল কারণ, দেশের ক্ষমতাবানরা অনেকের সাথে অনেক কথা বললেও তারা নিজের সাথে কথা বলেন না, তারা বিবেকের তালা খুলতে চান না।
পত্র-পত্রিকায় এখন নির্বাচন নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সরকার ও বিরোধীদলের কর্মকা- নিয়েও চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। তবে জনগণের মধ্যে এখন যে উদ্বেগটা বিরাজ করছে, তা হলো সামনের নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে হবে কিনা, নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে কিনা? এমনটি না হলে তো নির্বাচনের পরে শান্তির বদলে আবার দেখা দিবে সংঘাত-সংঘর্ষের ডামাডোল। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের অথবা সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে যখনই নির্বাচন হোক, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীরা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। কারণ, আইনে নির্বাচনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের কথা বলা নেই। এ কারণে নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জন্য অসম অবস্থা তৈরি হবে। নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের যে প্রস্তাব করেছে তাতেও নির্বাচনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা বা সুযোগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিধান রাখা হয়নি। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বিদ্যমান আইনে নির্বাচন করতে গেলে মন্ত্রীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণই কেবল নয়, মন্ত্রিসভার আকার বড় না ছোট হবে, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা নির্বাহী ক্ষমতা কতটা প্রয়োগ করতে পারবেন, তারা একান্ত সচিব বা সহকারী সচিব পদে কাউকে রাখতে পারবেন কিনা, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন থাকবে, সংসদ সদস্যদের মর্যাদা কোন পর্যায়ের হবে এই বিষয়গুলো নির্বাচনী আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এই জন্য আরপিওতে সংশোধনী আনতে হবে। সেই সংশোধনীর আলোকে আচরণ বিধিও সংশোধন করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এসব সমস্যা নিয়ে তাৎপর্যমূলক কোনো আলোচনা হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কর্মপরিধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে না। এতে সরকারি দলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা পাবেন। বৈষম্যের শিকার হবেন বিরোধী দলের প্রার্থীরা। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে বিরোধী দল একটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে কেমন করে? আমাদের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা-সামর্থ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে জনগণকে কতটা নিশ্চিত করতে পারবে তা নিয়েও ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন জেগেছে। শক্ত হাতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য তো ক্ষমতার প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের  নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পক্ষে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ফলে নির্বাচন কমিশন নিয়েও পর্যবেক্ষকদের মনে আছে নানা প্রশ্ন।
আমরা জানি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবিতে আওয়ামী লীগ কঠোর আন্দোলন করেছিল, দিনের পর দিন হরতাল ডেকেছিল। আন্দোলনের ফলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিয়েছিল। কয়েক মাস আগেও আওামী লীগসহ সরকারি ঘরানার লোকজন এমনকি মন্ত্রী বাহাদুররা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এমন কী যে হয়ে গেল, সরকারসহ আওয়ামী লীগের লোকজন এখন তাদেরই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা শুনতেই চাইছে না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কিছুটা নমনীয় হয়ে এখন বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শব্দে তাদের এলার্জি থাকলে তারা একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। কিন্তু একথাও মানতে নারাজ সরকার। তাদের একটাই কথাÑ নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। তাই পর্যবেক্ষক মহলে এখন প্রশ্ন জেগেছে,ক্রমবর্ধমান অনাস্থার পরিবেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন কি সম্ভব? আজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ কি বিএনপির অধীনে নির্বাচনে যেত?
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার হয়তো ভেবেছে, সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন করলে তারা জিতে যেতে পারে। আর আওয়ামী লীগের মতো বিশাল সংগঠন তো পাশে রয়েছেই। কিন্তু  এই হিসেবে তারা একটু ভুল করেছেন। তারা জনগণের স্বাভাবিক কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের বিষয়টি বিবেচনায় আনেননি। গত ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদলের যে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে তা থেকেও বোধহয় তারা তেমন কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। আর বর্তমান শাসকদল তাদের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে, সে বিষয়টিও আমলে আনতে তারা ভুলে গেছেন। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে দলীয় ঘরানার লোকজন যে অঙ্ক করছেন তাতেও রয়েছে গরমিলের সম্ভাবনা। প্রথম আলোর ৮ সেপ্টেম্বরের একটি রিপোর্টে উল্লেখ  করা হয়েছে: নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় দেখানো হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে চলছে সাংগঠনিক অস্থিরতা। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সক্রিয়তার অভাব, অনৈক্য আর বিভেদে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। বেশির ভাগ এলাকায় সংসদ সদস্য বনাম তৃণমূল নেতা-কর্মী, সুবিধাভোগী বনাম সুবিধাবঞ্চিত নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। মূলদল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যেও সমন্বয় নেই। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকা- সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো উদ্যোগ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকায় দলের মাঠ পর্যায়ে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এছাড়া সরকারের ভেতরেও আছে অনৈক্য। মন্ত্রী বনাম উপদেষ্টার ঠা-া লড়াই, অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্ক কেলেঙ্কারি মিলে ক্ষমতার সাড়ে চার বছরে এসে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার হ্রাসের বিষয়টি দলীয় নেতারাও স্বীকার করেন। এই অবস্থায় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝাতে দলের সভাপতিম-লীর একজন সদস্য মন্তব্য করেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগেই মনে হয় দল হেরে বসে আছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন। আরও ভাল হয়, জনমতের ব্যারোমিটারগুলোর ইতোমধ্যে সরকার ও শাসকদলের প্রতি যে বার্তা প্রদান করেছে তারা যদি তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তবে যথার্থ উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন নিজের সাথে কথা বলা। সরকারের ও দলের কর্তাব্যক্তিরা নিজের সাথে কথা বলার দায়িত্ব পালনে সমর্থ হলে তারা সহজেই বুঝতে পারবেন যে, ক্ষমতার দাপট কিংবা ছলচাতুরির মাধ্যমে জনসমর্থন লাভ করা যায় না, বিজয়ও অর্জন করা যায় না। মানুষকে এবং দলকে নিজেদের কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মফল কখনও এনে দেয় বিজয়, কখনও এনে দেয় পরাজয়। এই স্বাভাবিক বিষয়টি মেনে নেয়ার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। আর স্বাভাবিক এ বিষয়টি যারা মানতে চান না তাদের জন্য অপেক্ষা করে বিপর্যয়, এটাই ইতিহাসের সত্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads