শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সুর পাল্টাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী


প্রধানমন্ত্রী এবং তার সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়সহ অন্য ক্ষমতাসীনদের বিশেষ কিছু কথা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা চলছে। সবকিছুর পেছনে প্রধান ব্যক্তি হিসেবে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। সন্দেহ নেই, দৃশ্যত তিনিই এখনও বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বিরোধী দলকে পিটিয়ে বেড়ানো ও গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরা থেকে নিজের দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ এবং নির্বাচন কমিশনকেও হুকুমের দাস বানানো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার কথাই এখনও শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত ও পালিত হচ্ছে। তার হুকুমেই দেশের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করানো হয়েছে। নামে পঞ্চদশ বা সংখ্যার দিক থেকে একটি মাত্র মনে হলেও সে নামের আড়ালে অসংখ্য বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করেছেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা তো বাতিল করেছেনই, আরও অনেক কিছুই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বড়কথা, সংবিধানের কোনো পরিবর্তন বা সংশোধনের চেষ্টাকেও অসম্ভব করে ফেলেছেন তিনি। এরই মধ্যে বলেছেন, সংবিধান আর সংশোধন করা হবে না। ওই সংবিধানের ভিত্তিতেই এখন চলছে নতুন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নানামুখী তৎপরতা। ঠিক এ পর্যন্ত এসেই এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি গণচীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র দৃশ্যপটে এসে গেছে। দৃশ্যপটে এসেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এবং সবশেষে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য সবার দেয়া পরামর্শের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছেন। তার কঠোর নেতিবাচক মনোভাব এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্যের কারণে সমঝোতার সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। দেশও এগিয়ে চলেছে অনিবার্য সংঘাতের দিকে।
ঘটনাপ্রবাহে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য এবং নির্বাচনমুখী তৎপরতা এসেছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে। তিনি যে সংশোধনের আড়ালে পরিপূর্ণরূপে ‘আওয়ামী’ বানিয়ে ফেলা সংবিধান থেকে ‘এক চুলও’ নড়বেন না সে কথাটা এতদিনে সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। অন্যসব বক্তৃতা ও তৎপরতার মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রী আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ সৃষ্টি করে চলেছেন। দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন নেতারা সরকারি খরচে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে চলেছেন। জনগণকে দিয়ে হাত উঠিয়ে অঙ্গীকারও করাচ্ছেন তারা। বলা দরকার, আগে এটা আইনত নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু ‘মেরুদ-হীন’ ও ‘অথর্ব’ হিসেবে চিহ্নিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছায় নির্বাচনী আচরণবিধিতে সংশোধনী এনেছে, যাতে পদ ও ক্ষমতা না ছেড়েই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নির্বাচনে অংশ নিতে ও প্রচারণা চালাতে পারেন। এ ধরনের বিধানের কারণে বহুল আলোচিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, ক্ষমতাসীনদের জন্য কারচুপি এমনকি ভোট ডাকাতি করাও ‘আইনসিদ্ধ’ হয়ে উঠছে। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিকসহ বিশিষ্টজনরা কিন্তু সঠিকভাবেই বলে চলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আসলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করছে। একই কারণে এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশাই করা যায় না।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কিন্তু কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। উদাহরণ দেয়ার জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে দেয়া তার বক্তৃতার উল্লেখ করা যায়। প্রধানমন্ত্রী সেদিন আবারও তামাশা করেছেন বিরোধী দলের নেত্রীর সঙ্গে। এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার দরকার চোখের ডাক্তার দেখানো। প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কেন বিরোধী দলের নেত্রীর জন্য দরদে উথলে উঠেছেন তার কারণও জানিয়েছেন তিনি। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সড়ক-মহাসড়ক, উড়াল সেতু, ব্রিজ-কালভার্টসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেয়ার তথ্য উলে¬খ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার সরকার এত যে উন্নয়ন করেছে এবং এখনও করে চলেছে তার সবকিছু সবাই দেখছে কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না শুধু বিরোধী দলের নেত্রী। এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে, খালেদা জিয়ার চোখ খারাপ হয়ে গেছে। তার এখন ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ দেখানো দরকার। প্রসঙ্গক্রমে কিছু ফিরিস্তিও দিয়েছেন তিনি। যেমন বলেছেন, তারা অচিরেই ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের ‘মালিক’ হতে যাচ্ছেন। ২০২০ সালের মধ্যে তার সরকার ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে বলেও জানান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণার পুনরাবৃত্তি তো করেছেনই, তার দলকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখার জন্যও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ভয় দেখাতে গিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় এলে উন্নয়নের জোয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে জঙ্গিরা। নতুন নতুন ‘হাওয়া ভবন’ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করা হবে। সব টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। আরও কিছু বিষয়েও উচ্চস্বরেই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এসবের মধ্যে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তার বক্তব্য শুনে স্তম্ভিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। কারণ তিনি বলেছেন, এই সময়ের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নাকি অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক ভালো!
উপলক্ষ প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলেও ১৮ সেপ্টেম্বরের ওই বক্তৃতায় উন্নয়ন সম্পর্কে যথারীতি আরও অনেক গালগল্পই শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি আলোচিত হয়েছে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তার দেয়া চোখ দেখানোর পরামর্শ। ক্ষমতায় রয়েছেন, পুলিশ ও প্রশাসনকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন এবং বিরোধী মতাদর্শের গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরে প্রচারণাও চালাচ্ছেন যথেচ্ছভাবেই। সুতরাং যা খুশি তিনি বলতেই পারেন। অন্যদিকে সত্য কিন্তু ঠিক তেমন নয় যেমনটা প্রধানমন্ত্রী জোর করে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছেন। বিদ্যুতের কথাই ধরা যাক। বলা দরকার, ‘এক যে ছিল’ ধরনের গল্পের মতো এখনও, মইন উদের দু’বছরের অবৈধ শাসনসহ দীর্ঘ প্রায় পৌনে সাত বছর পরও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো সে তথ্য জানার ব্যাপারে মানুষের মনে কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। মানুষ বরং জানতে ও দেখতে চায়, শেখ হাসিনার সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কতটা গড় উল্টিয়েছে। এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান কিন্তু মোটেও এমন নয় যা সহজে বা খালি চোখে দেখা ও বিশ্বাস করা যাবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই সেদিন পর্যন্ত পাঁচ হাজার দুইশ’ মেগাওয়াটের গল্প শুনিয়ে এসেছেন। কিছুদিন পর্যন্ত ছয় হাজার মেগাওয়াটের কথা বলতে বলতে এবার বলেছেন ছয় হাজার সাতশ’ মেগাওয়াটের কথা। এই পরিমাণ নিয়েও মানুষ বাঁকা কথাই বলে বেড়াচ্ছে। মানুষের জন্য সে সুযোগটুকু আবার প্রধানমন্ত্রীর সুপুত্রই তৈরি করে দিয়েছেন। নিজের মা যেখানে ছয় হাজারের ঘর পেরিয়ে যাওয়ার সাহস করেননি সজীব ওয়াজেদ জয় সেখানে এক লাফে সম্প্রতি সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াটের গল্প শুনিয়ে দিয়েছেন।
হতেই পারে, পুত্রের মান-সম্মান রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেও পাঁচ-সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে রাতারাতি ছয় হাজার সাতশ’ মেগাওয়াটে উঠতে হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের ভোগান্তি কিন্তু যথারীতি বেড়েই চলেছে। এখনও লোডশেডিং চলছে যখন-তখন। কোথাও কোথাও একনাগাড়ে ছয় থেকে আটঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে জনগণের। ওদিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। প্রধানমন্ত্রী ও তার সুপুত্রের কথা সত্য হলে এভাবে লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কারণ, উৎপাদনই শুধু বাড়েনি, ক্ষমতাসীনদের একই সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ হতে দেখা যাচ্ছে। এই দেখতে পারার জন্য কাউকে চোখের ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছেন না। পর্যায়ক্রমে সরকার বিদ্যুতের দামও যথেষ্টই বাড়িয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের খাতে বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহকদের আটশ’-এক হাজার টাকার স্থলে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সংকট থেকে রেহাই তো মেলেইনি, উপরন্তু লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা মানুষকে দিশেহারা করে ফেলেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও যে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর গালগল্প শুনিয়ে থাকেন সে বিদ্যুৎ তাহলে যাচ্ছেটা কোথায়? পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাস্তবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে দলীয় লোকজনকে ব্যবসা পাইয়ে দেয়ার এবং তাদের পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই শুধু করা হয়েছে। কারণ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হয় দেড় থেকে দুই টাকার মতো সেখানে তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যয় ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এজন্যই একদিকে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে অন্যদিকে দলীয় লোকজনকে বছরে ভর্তুকি দিচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার পরও সংকটের সমাধান হচ্ছে না। মাঝখান দিয়ে দলীয় লোকজনের স্বার্থে ভর্তুকির টাকা গুনতে হচ্ছে বলে সরকারকে ফার্নেস অয়েলসহ জ্বালানি তেলের দামও বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে শিল্পের উৎপাদনই শুধু ব্যাহত হচ্ছে না, জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিবহনের ব্যয়ও। বেড়ে যাচ্ছে চাষাবাদের খরচও। একই কারণে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্যও।
এভাবে খাত ধরে ধরে উন্নয়নের পর্যালোচনা করতে গেলে প্রধানমন্ত্রীকে কিন্তু চুপসে যেতে হবে। তা সত্ত্বেও একদিকে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার মতো দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীকে চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে নতুন পর্যায়ে প্রতারণার কৌশল হিসেবে দু-একদিন পরপরই উন্মোচন করে চলেছেন নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কোনো কোনোদিন একই অনুষ্ঠানে তিনি ১৫-২০টি পর্যন্ত ভিত্তিপ্রস্তরের ওপর থেকে রঙিন কাপড় সরিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, খালেদা জিয়া না দেখলেও জনগণ কিন্তু সবই দেখছে ঠিকঠাকমতো। জনগণ শুধু দেখছেই না, তারা যে অন্তরালের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বুঝতে পারছে তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীকে হাড়ে হাড়েই পেতে হবে। সে জন্য সম্ভবত বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হবে না!
আপত্তি উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর অন্যসব বক্তৃতার কারণেও। তিনি এমনকি সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায়ও বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটকে দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গি-সন্ত্রাসী বানিয়ে চলেছেন। বলে বেড়াচ্ছেন, বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোটকে ভোট দিলে বাংলাদেশ নাকি তালেবান রাষ্ট্র হয়ে যাবে! এটুকু বলেই থেমে যাচ্ছেন না শেখ হাসিনা। তিনি আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার জন্য অঙ্গীকারও করাচ্ছেন। নিজেদের সাফল্যের গালগল্প শোনাতে গিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তো প্রত্যাখ্যান করছেনই, একই সঙ্গে এ ঘোষণারও পুনরাবৃত্তি করছেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ এবং তার সরকারের অধীনেই। প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি খরচে নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়টি আবারও প্রাধান্যে এসেছে। একযোগে উঠেছে নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগও। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, নির্বাচন কমিশনের কর্তা ব্যক্তিরাও আওয়ামী লীগকে আবারও জিতিয়ে আনার জন্য ‘আদা-জল খেয়ে’ নেমে পড়েছেন! বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন অবস্থা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ এবং নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আদৌ অনুকূল বা সমর্থনযোগ্য নয়। এর ফলে রাজনৈতিক সংকটও কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
নিবন্ধের এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিপক্ষ বেগম খালেদা জিয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরানো দরকার। প্রধানমন্ত্রীর একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টা তুঙ্গে উঠলেও খালেদা জিয়া কিন্তু সরকারের জন্য সমঝোতার দরোজা খোলা রেখেছেন। সর্বশেষ গত ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর রংপুর ও রাজশাহীর বিশাল দু’টি জনসমাবেশে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান বজায় রাখলেও খালেদা জিয়া এখনও রাজপথে নেমে আসার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানাননি। সমাবেশে দু’টিতে তিনি বলেছেন, জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সরকার রাজি হলে যে কোনো সময় তারা এ বিষয়ে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত রয়েছেন। আর যদি সংবিধান সংশোধন এবং নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান যুক্ত না করা হয় তাহলে প্রচ- আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এখনও যদি নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব আসে তাহলে বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোট আলোচনায় অংশ নিতে রাজি আছে। গণতন্ত্রসম্মত সে পথে পা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী একতরফা নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানলে ক্ষমতাসীনদের বিদায় তো নিতে হবেই, তারা পালানোর পথও খুঁজে পাবেন না বলে সাবধান করে দিয়েছেন তিনি।
রংপুর ও রাজশাহীর সমাবেশ দু’টিতে খালেদা জিয়া আরও কিছু বিষয়ে বললেও দ্রুত ঘনীভূত হয়ে ওঠা রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার। উচ্চ আদালতের দেয়া একটি বিতর্কিত রায়ের একটি মাত্র অংশের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন বহুল আলোচিত বলে সে সম্পর্কে পুনরাবৃত্তিতে যাওয়ার নিশ্চয়ই দরকার পড়ে না। এখানে বরং অন্য দু’টি তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। প্রথম তথ্যটি হলো, সংকট কাটিয়ে ওঠার সদিচ্ছা রয়েছে বলে খালেদা জিয়া তার দাবিতে অনেক ছাড় দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হুবহু পুনর্বহাল করার পরিবর্তে তিনি বলেছেন নির্বাচনকালীন সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় হতে হবে এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল রেখে যে নামেই কোনো সরকার করা হোক না কেন সে সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী যথারীতি ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছেন। তিনি এমনকি এই ঘোষণা পর্যন্ত দিয়ে বসেছেন যে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে তারা সংবিধান থেকে ‘এক চুল’ও নড়বেন না। এর মধ্য দিয়ে আর যা-ই হোক, সমঝোতামুখী সামান্য ইচ্ছারও প্রকাশ ঘটেনি। সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে এই কঠোর মনোভাব ও অবস্থানের কারণে। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি গণচীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষে নেয়া সমঝোতার চেষ্টা সফল হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের পরামর্শের প্রতিও উপেক্ষা দেখিয়েছেন। আগেও বলা হয়েছে, মূলত প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর নেতিবাচক মনোভাব এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্যের পরিণতিতে সমঝোতার সব উদ্যোগই শুধু ব্যর্থ হয়নি, রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও দ্রুত অবনতি ঘটছে। সে কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ আহ্বানকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশা করছেন, জাতিসংঘের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সকল মহলের আহ্বান ও পরামর্শের প্রতি প্রধানমন্ত্রী সম্মান দেখাবেন এবং সংঘাত এড়িয়ে দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করবেন। বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের ব্যাপারে ন্যূনতম সদিচ্ছা থাকলেও ক্ষমতাসীনদের উচিত খালেদা জিয়ার দেয়া শেষ সুযোগটুকুকে কাজে লাগানো। না হলে বিদায় তো নিতেই হবে, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর এ সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ বাণীটিও সত্য হয়ে উঠতে পারেÑক্ষমতাসীনরা পালানোর পথ খুঁজতে বাধ্য হবেন। সে পথ তারা যে খুঁজে পাবেনই তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads