শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সেকালে রাজার নীতি-একালের রাজনীতি


প্রাচীন ও মধ্যযুগে গোত্রীয় জনবল ও অস্ত্রবলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা, দখল, লুটপাট এবং সম্প্রসারণের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল সম্পদ আহরণে পরিধির ব্যাপ্তি। রাজনীতি ছিল রাজধর্মের জয়জয়কার। রাজনীতি বলতে রাজার নিজের নীতি আর আইন বলতে ছিল রাজ আজ্ঞা শিরোধার্য। এর ব্যত্যয় বা বিরোধিতার পরিণামে হতো ক্রুশ, শিরñেদ নয়তো নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভোগ-বিলাস আর সুখ-সমৃদ্ধি সবই ছিল রাজা, তার পরিবার, বংশধর ও অমাত্যদের। কিছু না কিছু পাওয়ার আশায় জয়ধ্বনিতে চাটুকার আর দর্শনে ছিল ভোগান্তির প্রজাবর্গ। রাজাই তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করত এবং উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত বংশপরম্পরা তারাই রাজত্ব করত। আপন আপন স্বার্থের বশে রাজ্য রক্ষায় অমাত্যরা সচেষ্ট থাকলেও পাওয়া না পাওয়ার বঞ্চনায় বৈরিতা থাকত সুযোগের অপেক্ষায় অদৃশ্যমান। কদাচিত গণ-অভ্যুত্থান ঘটলেও রাজতন্ত্রের ঘটেনি অবসান। বরং শাসন ও শোষণের সহায়ক স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সামন্ততন্ত্র। রাজায় রাজায় যুদ্ধে চরম দুঃখ-দুর্দশার কবলে পড়ত সাধারণ মানুষ। তাই প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস তার ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন, যাতে তারা রাজকার্যে পদ গ্রহণ করে এ অবস্থার অবসান করতে পারে। কিন্তু পার্থিব জগতে যেন এই ভোগ্য স্বর্গসুখের লালসায় সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে পিতা-পুত্র ও ভাই-ভাইয়ের রক্তারক্তিরও নজির ছিল না ইতিহাস বিবর্জিত। আধুনিক যুগে জনগণকে ধোঁকা দিতে অপপ্রচার এক কৌশল হলেও সেকালে তা ছিল না। বরং অন্ধ বিশ্বাসের প্রচার-প্রচারণায় প্রজাদের আনুগত্য লাভ করা হতো। পৃথিবীতে রাজাই ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধি বলে বিশ্বাসের রাজতন্ত্র কালের বিবর্তন ধারায় বিবর্তিত হতে হতে আজ প্রায় হয়েছে বিলুপ্ত। রাজ্যের পরিবর্তে আজ হয়েছে রাষ্ট্র; প্রজার পরিবর্তে নাগরিক আর রাজ-শাসনের পরিবর্তে হয়েছে নাগরিক শাসন। এ জন্য শাসক নির্বাচনে সচেতন-অসচেতন, চরিত্রহীন-চরিত্রবান, স্বার্থহীন-স্বার্থপর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এবং বিত্তহীন-বিত্তবান নির্বিশেষে সব নাগরিককে প্রদেয় সম-অধিকারের নাম হয়েছে গণ+তন্ত্র। অর্থাৎ জনগণের তন্ত্র, যা আধুনিক পণ্ডিতদের মতে কিছু ত্রুটিপূর্ণ এবং জনগণের চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল। সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি সমভাগে ভোগের প্রয়াসে এতে স্বীকৃত হয়েছে আইনের সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ এর চোখে সবাই সমান। কিন্তু উন্নয়নশীল অনেক দেশেই নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে এটা যেন হয়ে যায় এক কথার কথা। অসম যোগ্যতার সমনির্বাচনী অধিকারের পাশাপাশি রত্তি, আনি, গ্রাম, তোলা ও কিলো পরিমাপের অসম বিত্তের সমতা হয়েছে অস্বীকৃত। ফলে এমন রকমারি শ্রেণীভুক্ত সমাজে সুবিধাভোগী শ্রেণীর শোষণের স্বার্থে কেতাবি আইনের সমতা বিঘিœত হওয়াই যেন এক অনাকাক্সিত বাস্তবতা। গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য অলিভার ক্রমওয়েল ১৬৫০ সালে স্পিকারের কাছে লিখেছিলেন, 'Be pleased to reform the abuses of all professions; and if there be anyone that makes many men poor to make a few rich, that suits not a commonwealth.' (অনুগ্রহ করে সব পেশার অপব্যবহারগুলো সংশোধন করুন। অনেককে গরিব করার মাধ্যমে কতককে ধনী করার যদি কেউ থাকে, তবে তা সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য উপযুক্ত নয়) তখনো ইংল্যান্ডে রাজ-ইচ্ছার গণতন্ত্র চলতে ছিল। তাই কোন যুগের গণতন্ত্রকে আমরা গণতন্ত্র বলে চালাতে চাচ্ছি আর অনুকরণেওবা আমরা কী শিখেছি? আজ কেন আমাদেরও রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজের অনেককেই রাজনীতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি তুলতে হচ্ছে? রাজ্যে নিদারুণ দারিদ্র্য থাকলেও লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে তার প্রাসাদে সোনার থালায় খাওয়া-দাওয়া হতো। তৎপরবর্তী দিনেও ধনী লোকেরা সোনার থালায়ই খেতেন। উৎসবের দিনে যিনি যত বেশি সোনার থালা বের করতেন তিনিই বেশি মর্যাদা লাভ করতেন। রাজধানী গৌড়ে লুটপাট শুরু হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণের (আ: ১৪৯৩-৪ খ্রি.) কয়েক দিন পরেই অনেককে হত্যা করে তা বন্ধ করেন। পরে মাটির নিচে অনুসন্ধান করে তিনি এক হাজার ৩০০ সোনার থালাসহ বহু গুপ্তধন পেয়েছিলেন বলে শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায়ের বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল নামক বইয়ের ১২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে। প্রায় এমন বিত্ত-বৈভবের নজির যে আমাদের জনগণের তন্ত্রেও হতে পারে তা অবিশ্বাসের কোনো হেতু নেই। প্রায় সাড়ে তেইশ শবছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লুটো বলেছিলেন `National greatness lies not in wealth and dominion, but in intellect and character.' (জাতীয় মহত্ত্ব নির্ভর করে বুদ্ধি ও চরিত্রের ওপরÑ ধনদৌলত ও আধিপত্যে নয়)। শ্রী কালিদাস রায়ের বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় প্রথম খণ্ডের ২৫২ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত বঙ্কিম চন্দ্রের প্রায় দেড় শবছর আগের মন্তব্যটি হলো, ‘বাঙালার দুর্গতির মূলে বাঙালির দুর্মতি।এই দুর্মতিই কি আমাদের বৈশিষ্ট্য? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিক জীবনে সবার একমাত্র কাম্য সুশাসন ও শোষণমুক্ত সমাজ, যা দুরূহ হওয়ার কারণ বিত্তের কাছে নৈতিকতার আত্মসমর্পণ। সহজলভ্য বিত্তের সহায়করূপে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রত্যাশায় রাজনীতিতে বিনিয়োগ এবং দলীয় আদলে পেশির পৃষ্ঠপোষকতা সেকালীয় রাজার নীতির এবং রাজপথও যুদ্ধের ময়দানের আধুনিক রূপান্তর বৈকি।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads