মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জনগণ যা পেয়েছে সরকার তা-ই দিয়েছে


 সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিভিন্ন জনসভায় দেশের সার্বিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে জনগণ কিছু পায় আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে সব লুটে নেয়। তিনি আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে জনগণকে কিছু দেয়ার জন্য আর বিএনপি ক্ষমতায় আসে চুরি-ডাকাতি, লুটপাট করার জন্য, তার প্রমাণ বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই ছেলে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, জনগণ যা চেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে। সেই সাথে তিনি যা দিয়েছেন তার বিনিময়ে নৌকা মার্কায় আবারো ভোট চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, নৌকায় ভোট দিলে তিনি দেশকে সোনার বাংলা করে দেবেন। কথায় বলে, নিজের ঢোল নিজে পেটানো যায় না। তবুও নিজেদের প্রশংসা প্রধানমন্ত্রী এখন নিজেই শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর যে চেয়ার, সে চেয়ারে বসে অন্য সব মন্ত্রীর মতো সে কথা প্রধানমন্ত্রীর মুখে মানায় না। তাহলে যে চেয়ারটার অমর্যাদা হয়। কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এ কথা দ্বারা প্রধানমন্ত্রী শুধু ইসলামই নয়; সব ধর্মের লোকের সাথে চালাকি করেছেন। কারণ ধর্ম যার যার উৎসবও তার তার। ধর্মীয় উৎসব পালন করা মানে ধর্মের অনুষঙ্গ পালন করাকেই বোঝায়। তবে হ্যাঁ, জাতীয় উৎসবগুলো সবার হতে পারে; যেমন ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের উৎসব; দল-মত নির্বিশেষে সবার উৎসব। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে; তবে জনগণ যেন ভুলে না যায়, সে জন্য প্রতি দিন দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। তার মানে কি প্রধানমন্ত্রী এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, অতীতে বিএনপি-জামায়াত জনগণের গলা টিপে ধরেছিল সেটা যেন জনগণ ভুলে না যায়; সে জন্য আওয়ামী লীগও বিশ্বজিৎদেরকে খুন করেছে? প্রধানমন্ত্রীর এটা ভাবা উচিত হবে না যে, জনসাধারণ আপনাদের ভাষার মর্ম উদঘাটন করতে পারে না। কিছু দিন আগে তিনি সুধীসমাজের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞানী-গুণী, সুধীসমাজ দিয়ে দেশ চলে না। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে যে কেউ বলবে, তাহলে এ জন্য কি আবুল হোসেনদের মতো চোর-ডাকাতদের দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন তিনি? এ জন্য কি ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডারদের দিয়ে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন? শীর্ষ নেতানেত্রীর আরো সংযত হয়ে কথা বলা উচিত এবং সব বিষয়ে মন্তব্য না করাই বাঞ্ছনীয়। জনগণ হয়তো এত দিন ভুলেই গেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই রাত ১১টায় দেশের বারোটা বাজিয়েছেন। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে ঘড়ির কাঁটাকে যখন রাত ১১টা থেকে ১২টায় নিয়ে গেলেন তখনই জনগণ ভেবেছিল দেশের বারোটা এবার বাজতে শুরু করল। প্রধানমন্ত্রী দিনবদলের স্লেøাগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। সত্যিই তো দিন বদলেছে। সত্যিই তিনি দিন বদলে দিয়েছেন। তবে জনগণের নয়, ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তারা এখন প্রত্যেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত। অবশ্য জনগণকেও দুহাত ভরে দিয়েছেন। বদলে দিয়েছেন সামাজিক চিত্রকে অসামাজিকতার আবরণে। সাংকাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিজ বাসায় খুন হলেন; ‘তারা যে কারো বেডরুম পাহারা দিতে আসেননিপ্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে দেশে বিতর্কের ঝড় তুলে দিলেন। আওয়ামী সরকার বুকটা উজাড় করে দিয়েছেন খুন, গুম, হত্যা আর ধর্ষণে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণে সেঞ্চুরি করা ছাত্রলীগ নেতাকে চাকরি দিয়ে ধর্ষিতা নারীদের প্রতি বিশেষভাবে অসম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে জনগণের ঘাড়ে দেনার দায় চাপিয়েছেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির নাটক উপহার দিয়েছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রেলের কালো বিড়াল ধরে দিয়েছেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অরাজকতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ১০ হাজার টাকার দোয়েল ল্যাপটপ স্কুলের ছেলেমেয়েদের হাতে দিতে চেয়ে সেটা ডিজিটাল কায়দায় বন্ধ করে দিয়েছেন। গরিব-দুঃখীদের ১০ টাকা মূল্যে চাল খাওয়াতে চেয়ে ৩০ টাকায় খাওয়ালেন। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার নাম করে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ঘুষের লাখ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন দিয়েছেন। শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়েছেন। দেশের আলেম-ওলামাদের সভা-সমাবেশ বন্ধ করে তাদের জেলখানায় দিয়েছেন। ৫ মে শান্তিপ্রিয় নিরীহ হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের ওপর রাতের অন্ধকারে অতর্কিতভাবে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার হেফাজত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেদের লোকজন দিয়ে পবিত্র কুরআন শরিফে আগুন লাগিয়ে হেফাজত, জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের ওপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন। ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য মানুষকে গুম করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বেতনভাতার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর পাগলা কুকুর তাড়ানো পিপার স্প্রে দিয়ে প্রাণে মেরে দিলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে বিনাবিচারে ছেড়ে দিয়েছেন। জামায়ত-শিবির দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। মস্কোপন্থী লোকদেরকে হরতাল করার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন আবার অন্য দলের হরতাল ডাকা নিয়ে প্রশ্ন তুেলছেন। কয়েক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কী দিলেন না প্রধানমন্ত্রী? সবই তো দিলেন। শুধু দেননি রোহিঙ্গা মুসলিমদের এ দেশে আশ্রয়। পাত্তাই দেননি সাগর-রুনি হত্যার দাবিতে আন্দোলনরত সাংবাদিকদের। নির্বাচনী ইশতেহারে দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বদলে দিয়েছেন। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গায়ের জোরে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছে করলে অবশ্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন; সংবিধানে এ ব্যবস্থাও সংযোজন করতে পারতেন; সেটা না করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি হয়তো খানিকটা সম্মান দিয়েছেন। এখন সংবিধান থেকে এক চুলও সরবেন না; এ চুল তত্ত্ব দিয়ে ভুল করে দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনদের পরামর্শ নিয়ে দেশে খাল কেটে কুমির নিয়ে আসার রাস্তা পরিষ্কার করে দিলেন। এত কিছু দেয়ার পেছনে হয়তো বাংলাদেশের জনগণের ওপর প্রধানমন্ত্রী তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আর একবার ভোট দিলে তিনি কি বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করবেন না বিরানভূমি বানাবেন জনগণ সেটা হয়তো সহজেই উপলব্ধি করতে পারছে। একটা দেশকে সোনার দেশ বানাতে বারবার ক্ষমতায় আসতে হয় না। কারণ সকাল দেখলেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। বিএনপি-জামায়াত জোট দেশের জনসাধারণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি বলেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সুযোগ হয়তো পেয়েছিল। সেই আওয়ামী লীগও বারবার জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপরিপন্থী কর্মকাণ্ডের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত থেকেছে। এখান থেকে বিএনপিরও শিক্ষা নেয়া উচিত যে, জনগণ আর ধোঁকার রাজনীতিকে বিশ্বাস করতে চায় না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুঃশাসন পর্যালোচনা করে জনগণ যদি তৃতীয় কোনো শক্তিকে আমন্ত্রণ জানায়; তাহলে দেশের এবং দোষের বড় কিছু হবে এটা জনগণ হয়তো মনে করে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads