বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

নিজের বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপানোর হাস্যকর চেষ্টা

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথায় কান না দেয়াই আমি সঠিক বিবেচনা করেছি। তার কথায় হাসা বা কাঁদার তো প্রশ্নই ওঠেনি। তিনি গত শুক্রবার কুষ্টিয়ায় এক প্রাথমিক স্কুলের ভবন উদ্বোধনের সময় এমন একটা উক্তি করেছেন, যাতে ঢাকার আদিবাসীদের একটা রসিকতা অপরিহার্য রকম প্রযোজ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সে রসিকতা হচ্ছে, ‘ঘোড়ায় হুনলে হাসবো। সম্ভাব্য যাত্রী অসম্ভব রকম হাস্যকর এবং অবাস্তব ভাড়া দিতে চাইলে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান নাকি এ মন্তব্য করতÑ আস্তে কন সাব, ঘোড়ায় হুনলে হাসবো 
হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘মহাজোট সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না।এ বক্তৃতা দেয়ার আগে তথ্যমন্ত্রী বোধ হয় সে দিনের কোনো পত্রিকার প্রথম পাতায়ও চোখ বুলাননি। কেননা সে দিনের সব পত্রিকায় একটা বড় খবর ছিল ক্যানাডার আদালত পদ্মা সেতু দুর্নীতির দায়ে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। প্রকাশিত সংবাদে আরো বলা হয়েছে, এ মামলায় আরো তদন্ত চলছে এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে। 
জোসেফ গোয়েবলসের সমগোত্রীয় বলে বর্ণনা করে আমি হাসানুল হক ইনুকে গৌরব দিতে চাই না, কেননা তাকে আমি গোয়েবলসের সমগোত্রীয় প্রতিভাধর বিবেচনা করি না। তবে চেষ্টার জন্য তাকে হয়তো সান্ত্বনা পুরস্কার দিতে হবে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, বারবার উচ্চারিত হলে লোকে মিথ্যাকেও সত্যি বলে বিশ্বাস করবে। সে হিসেবে তাকে বড়জোর পাতি গোয়েবলের সাথে তুলনীয় বলা যেতে পারে। নইলে ইনু কী করে আশা করতে পারেন যে পদ্মা সেতু নিয়ে বিগত দেড়-দুই বছরের কেলেঙ্কারিগুলো সাধারণ মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? আরো একটা বিষয়। বিগত নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের তালিকা প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সরকার যদি এতই দুর্নীতিবিরোধী হবে তাহলে সে প্রতিশ্রুতি কেন গিলে খাওয়া হলো? 
গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারের তাণ্ডবকে বর্তমান সরকার ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরে বাঁচাতে চাওয়ার মতো বেপরোয়া প্রচেষ্টা হিসেবে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনের পর দিন বলে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নতি হয়, সাধারণ মানুষের ভাগ্য খুলে যায়, আর বিএনপি ক্ষমতা পেলে দেশে আকাল আসে, বিদেশে দেশের কুখ্যাতি রটে। তার এই শেষ দাবিটাই খতিয়ে দেখা যাক। বিচারবহির্ভূত হত্যার দরুন এই সরকারের মেয়াদের শুরু থেকেই দেশে দেশে হাসিনা সরকারের দুর্নাম রটেছে, এই অবৈধ হত্যা বন্ধ করার জন্য বহু দেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জরুরি দাবি জানিয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম হয়ে যাওয়ারও বহু সমালোচনা হয়েছে বিশ্বজোড়া। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশের সংসদ থেকে ইলিয়াস আলীর মুক্তি দাবি করেছে। কিন্তু বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সব অনুরোধ-উপরোধ অরণ্যে রোদনের শামিল হয়েছে। 
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক সেতুর অর্থায়ন করতে অস্বীকার করেছে। একই সাথে জাপান এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ সব দাতা দেশ ও সংস্থা সেতু নির্মাণের টাকা দিতে অস্বীকার করেছে। বিকল্প অর্থায়ন সংগ্রহের সব সরকারি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে এসে পরবর্তী মেয়াদে নিজস্ব সম্পদে সেতু নির্মাণ, কিছু মাটি কাটার কাজ এবং সেনাবাহিনীকে দিয়ে সেতু তৈরি করানো প্রভৃতি নানা কথা বলে ভোটদাতাদের প্রতারণা করার চেষ্টা হচ্ছে। 

সরকারের ভয়ের আসল কারণ 
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিতে জড়িতদের নামের তালিকা দিয়েছে সরকারকে, বলেছে এদের বিচার ও শাস্তি হলে বিশ্বব্যাংক আবার সেতুর অর্থায়ন করবে। কিন্তু তালিকার কোনো কোনো ব্যক্তির বিচার করতে সরকার কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। তারা ভয় করছে তাহলে এ দুর্নীতিতে সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ ব্যক্তিদের দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু এখানেই ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি হচ্ছে না। বিষয়টি কানাডার পুলিশ তাদের দেশে, বাংলাদেশে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে তদন্ত করছে। দুর্নীতিবাজ সরকার হিসেবে বাংলাদেশের নাম প্রায় প্রতিদিনই বিশ্বমিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে। 
সমালোচনা আছে, শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকারি অর্থ ব্যয় করে আমলা ও কূটনীতিকদের দিয়ে তদবির করিয়ে ডজনখানেক অনারারি ডিগ্রি কিনেছিলেন। এবারে ক্ষমতা পেয়ে তিনি একটা নোবেল পুরস্কার কেনার জন্য অনুরূপভাবে আমলা ও কূটনীতিকদের দেশে দেশে পাঠিয়েছিলেন। তাদের তদবিরে কোনো ফল হয়নি। অন্য দিকে গ্রামীণ ব্যাংক বাবদ আদর্শস্থানীয় ুদ্রঋণ প্রকল্পের সাফল্য বিবেচনা করে নোবেল কমিটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তি পুরস্কার দিয়েছে। দেশ-বিদেশে ইউনূসের প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক অঙ্গরাজ্য এবং পশ্চিম গোলার্ধের আরো কয়েকটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে ুদ্রঋণ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। কয়েকটি দেশ ইউনূসকে সম্মানিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাকে প্রেসিডেন্টের পদক এবং কংগ্রেসনাল সুবর্ণ পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে। 
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে হয়তো এত কিছু হজম করা সম্ভব ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস এবং ড. ইউনূসকে হেনস্তা ও হয়রানি করার এমন কোনো হেন উপায় নেই যা তিনি ও তার সরকার করেনি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিনটন, তার স্ত্রী ও বারাক ওবামার প্রথম মেয়াদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা না দিতে নিজে প্রধানমন্ত্রীকে বারবার অনুরোধ করেছেন। হিলারি কিনটন কয়েকবার হাসিনাকে টেলিফোন করেছেন, অনুরোধ জানাতে ঢাকাতেও এসেছিলেন। মার্কিন সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরো বিভিন্ন দেশের সরকারও অনুরূপ অনুরোধ করেছে। কিন্তু ঈর্ষা ও প্রতিহিংসা দুরারোগ্য টিউমারের মতো এ সরকারের মস্তিষ্কে গেড়ে বসেছে। মনে হচ্ছে সে ব্যাধি থেকে তার আর পরিত্রাণ নেই। এ দিকে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আচরণে সারা বিশ্বে ছি ছি পড়ে গেছে। 
বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস তৈরী পোশাক শিল্প। কিন্তু শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকে এ শিল্পের ওপর যেন বিধাতার অভিশাপ নেমে এসেছে। কারখানায় শ্রমিকদের প্রাণের নিরাপত্তা বিধান এবং বেতন ও চাকরির শর্ত উন্নয়নের জন্য বিদেশী ক্রেতারা এবং মার্কিন সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক বছর ধরে চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার কিছুই করেনি সে ব্যাপারে। তার দ্বিতীয় দফার শাসনকালে কয়েক শগার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কয়েক শঅগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন কারখানায়, শত শত শ্রমিক মারা গেছে। শ্রমিকদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ প্রভৃতি নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সরকার নিষ্ক্রিয় কেন? 
কারখানা মালিকদের সাথে সরকারের অতিমাত্রিক হৃদ্যতা সরকারি নিষ্ক্রিয়তার বড় কারণ। মালিকেরা সরকারকে আর কী কী ভাবে সাহায্য করে বলা যাবে না, কিন্তু কারখানা শ্রমিকদের দিয়ে সরকারি দলের সভা সমাবেশে উপস্থিতি বড় করে দেখানো সবার চোখের সামনেই হচ্ছে। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডিরও সেটাই ছিল প্রত্যক্ষ কারণ। সরকারের নারী সমাবেশে কারখানাগুলোর নারীশ্রমিকদের হাজির করানোর জন্য মালিকদের ওপর চাপ এসেছিল। সে জন্যই ছুটির দিন হলেও শ্রমিকদের কাজে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। তা না হলে সে হাজার দেড়েক শ্রমিক প্রাণে বেঁচে যেতে পারত। 
এত বড় ট্র্যাজেডির পরেও বাংলাদেশ সরকারের সম্বিৎ ফিরে আসেনি। মাত্র গত রোববার ও সোমবারও দাবি আদায়ের জন্য প্রতিবাদকারী শ্রমিকদের ওপর পুলিশ হামলা করেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সম্বন্ধে একটা প্যানোরমা অনুষ্ঠান প্রচার করেছে বিবিসি টেলিভিশন মাত্র গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে। কারখানা মালিকদের দুর্নীতি ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রতি তাদের উপেক্ষার বহু দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে অনুষ্ঠানে। বহু পাঠক প্রায়ই আমাকে জানাচ্ছেন, অসন্তোষ, বিক্ষোভ, পুলিশি সন্ত্রাস ও ট্র্যাজেডির ডামাডোলের মধ্যে বহু পোশাক কারখানার মালিকানা চলে যাচ্ছে ভারতীয়দের হাতে। ভারতীয়রা বিনা ভিসায় এসে বাংলাদেশে থাকছে এবং সেসব কারখানা চালাচ্ছে। 
রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পর থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের প্রাণের নিরাপত্তা, তাদের ইউনিয়ন করার অধিকার, বেঁচে থাকার মতো মাইনে দেয়া ইত্যাদি নানা ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু উদ্যোগগুলো কারখানা মালিক কিংবা বাংলাদেশ সরকার করছে না, করছে বিদেশী ক্রেতারা। সেসব খবর বিদেশী মিডিয়ায় দিনের পর দিন ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। এটা যদি বাংলাদেশ সরকার তাদের গালে চপেটাঘাত মনে না করে তাহলে অপমান আর কাকে বলে বুঝে ওঠা কঠিন। এখন আবার শোনা যাচ্ছে বর্তমান সরকারের একজন ধিকৃত ও ঘৃণিত মন্ত্রীকে পোশাকশ্রমিকদের নেতা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে বলেই মনে হয়। 

বিশ্বের গালে হাসিনার চপেটাঘাত 
একমাত্র ভারত ছাড়া পৃথিবীতে বোধ হয় এমন কোনো দেশ নেই যারা সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনপদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য সংলাপ করার তাগিদ দেয়নি শেখ হাসিনাকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো বারবার সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘও এখন সে চেষ্টায় যোগ দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের রাজনৈতিক সহকারী ঢাকায় এসে চার দিন ছিলেন। তার চাপে সরকার বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সংলাপে বসতে রাজি হয়েছিল। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিবকে বলেছিলেন যে সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে তারা অবিলম্বে বিএনপি নেতৃত্বকে চিঠি লিখবেন। কিন্তু তিনি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা সে প্রতিশ্রুতি গিলে খেয়েছেন। 
বান কি মুন নিজে টেলিফোন করেছেন দুই নেত্রীকে। তার কোনো সুপ্রভাব সরকারে ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে হয়েছে বলে মনে হয় না। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চিঠি লিখেছেন শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রীকে। খালেদা জিয়া গত সপ্তাহে অনুকূল সাড়া দিয়ে সে চিঠির জবাব দিয়েছেন। শেখ হাসিনা জবাব দিয়েছেন বলে শুনিনি। এসব খবর বিশ্বের মিডিয়ায় দিনের পর প্রচার হচ্ছে। তার পরও কেউ যদি বলে যে বর্তমান সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সম্মানের আসন আছে তাহলে তাকে বেহায়া না বলে উপায় থাকবে না। 
প্রধানমন্ত্রী আজকাল এত বেশি বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন যে খেই রাখা কঠিন। তবে একটা সাধারণ সুর আছে সে সব বক্তব্যের মধ্যে : মিয়ার গায়ে গন্ধ নেইএবং যত দোষ নন্দ ঘোষ’Ñ তার, তার সরকার এবং আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই, সব দোষ বিএনপির। তবে বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকের বুঝতে অসুবিধা হবে না যে নিজের এবং নিজের দলে যা যা দোষ তিনি লক্ষ করছেন সব কিছুই তিনি চাপিয়ে দিচ্ছেন খালেদা জিয়া, তার সাবেক তিন সরকার এবং বিএনপির ওপর। 
যেমন প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে বলেছেন উড়ে এসে জুড়ে বসা দল। প্রধানমন্ত্রী কি নিজের এবং নিজের পরিবারের দৃষ্টান্তই দিচ্ছেন ঘুরিয়ে? যেমন সাত-আট বছর বিদেশে থেকে উড়ে এসে তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান হলেন? যেমন কদিন পরপরই গরিব দেশের ব্যয়ে শ-দেড় শচেলাচামুণ্ডা নিয়ে বিদেশে না গেলে তার ভালো লাগে না? অথবা যেমন তার ছেলে জয় আজীবন বিদেশে কাটালেন এবং এখন মাঝে মধ্যে সপ্তাহখানেকের জন্য আমেরিকা থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশে বিপ্লব করতে এবং বাংলাদেশের নেতা হতে চাইছেন? 
শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কথাবার্তা কি আপনাদেরও সেই পুরনো গল্পটার কথা মনে পড়িয়ে দেয় না? সেই যে কুচক্রী মামলাবাজ বুড়োটা মরার আগে ছেলেদের বলে দিয়ে গিয়েছিল তাকে কবর না দিয়ে যেন গলায় দড়ি দিয়ে পাশের বাড়ির বাগানের একটা গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাহলে লোকে মনে করবে পাশের বাড়ির লোকেরা তাকে মেরে গলায় দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে এবং পুলিশ সে বাড়ির লোকদের হয়রানি করবে। 

তথ্যকে তিনি সুগম করছেন, না হত্যা? 
লিখতে শুরু করেছিলাম তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর প্রসঙ্গ দিয়ে। তাকে তথ্য-হন্তা বলা কি অন্যায় হবে? বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে দেশ ও সমাজে যেসব অন্যায় হয়, সেগুলো প্রতিকারের আশায় লোকচুর সামনে তুলে ধরা সাংবাদিকের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। সাংবাদিকের কর্তব্য সমাপন এবং তথ্য সঞ্চালন সুগম করা তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব হওয়া উচিত। কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের ব্যাপারে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছিল এবং সরকারের ভেতরের ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা তাতে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সাংবাদিক দম্পতি রুনি আর সাগর সে দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করছিলেন। গভীর রাতে নিজেদের শোবার ঘরে এবং পাঁচ বছরের ছেলের চোখের সামনে তারা খুন হলেন, তার ল্যাপটপটা নিয়ে গেল খুনিরা। দেড় বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু খুনের রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কি কিছু করেছেন সে সম্বন্ধে? অথবা বর্তমান সরকারের আমলে ১৮ জন সাংবাদিক হত্যা এবং বহু সাংবাদিকের নির্যাতন সম্বন্ধে? 
বরং দেখা যাচ্ছে প্রধান নির্যাতক হচ্ছে সরকার। চারজন নাস্তিক ব্লগার দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল। কোনো প্রতিকার করেনি সরকার, বরং জামাই আদরে লালন করছিল তাদের। মাহমুদুর রহমান তার সম্পাদিত আমার দেশ পত্রিকায় ইসলামদ্রোহিতার খবর প্রকাশ করেছিলেন। কোনো বিচার ছাড়াই মাহমুদুর রহমান প্রায় ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করছেন, রিমান্ডের নামে তার ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আমার দেশ পত্রিকায় তালা লাগানো হয়েছে, অন্য কোনো মুদ্রণালয়ে এ পত্রিকা প্রকাশ সরকার অসম্ভব করে দিয়েছে। 
৩০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল গত ৫ মে শাপলা চত্বরে। এটা যদি সংবাদ না হয় হলে সংবাদ আর কাকে বলব? কিন্তু সরকারের আজ্ঞাবহ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সে সংবাদ প্রচার করেনি। প্রচার করেছিল মাত্র দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টেলিভিশন। সম্প্রচারের মাঝপথেই সরকার এ দুটি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। 
সোনার বাংলাদেশ নামে একটা ব্লগ বাংলাদেশের জন্য বিরল একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তারা সব মহলের অনুসারী কলামিস্টদের রচনাগুলো অবিকৃতভাবে প্রচার করে যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের তথ্যনীতি হচ্ছে সত্য প্রচারের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে শুধু নিজেদের গোয়েবলসীয় মিথ্যাগুলো প্রচার করা। হাসানুল হক ইনুর মন্ত্রণালয় সেনার বাংলাদেশ ব্লগটা বন্ধ করে দিয়েছে। আরো কোনো কোনো ব্লগও বন্ধ করে দেয়া বলে শুনেছি। তথ্য সঞ্চালনের পথ সুগম করা যদি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব হয় তাহলে হাসানুল হক ইনুকে কেন তথ্য-হন্তা বলা যাবে না? 

কোথায় সিরাজ শিকদার 
হাসানুল হক ইন্যু জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অন্যতম নেতা ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন, লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগে এসে সাক্ষাৎকারও দিয়ে গেছেন। সে জন্য তাকে তখন শ্রদ্ধা করতাম। পরবর্তীকালে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ফিকে হতে হতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনীর হাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছেন। শুনেছি তাদের বেশির ভাগই ছিলেন জাসদ দলীয়। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘লাল ঘোড়া দাবাইয়া দিব। তার পরপরই জাসদ নেতা সিরাজ শিকদার মাথার পেছন দিকে একটি মাত্র গুলির আঘাতে মারা যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তারপর আত্মপ্রসাদের সুরে বলেছিলেন, ‘কোথায় সিরাজ সিকদার?’ 
জাসদের অন্যতম নেতা হিসেবে হাসানুল হক ইনু সেসব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন বলে শুনেছেন কেউ? অথবা সিরাজ শিকদারের হত্যার বিচার দাবি? অন্য দিকে কর্নেল তাহেরের কোর্টমার্শাল (সামরিক আদালতে বিচার) হয়েছিল ৩৮ বছর আগে। সে বিচার সম্বন্ধে তদন্তে আগ্রহের কমতি ছিল না ইনুর। এসবের পুরস্কার হিসেবেই কি তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন? নাকি মন্ত্রী হওয়ার আশায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ সোচ্চার হয়নি? হাসানুল হক ইনু বলেছেন, লন্ডনে তার ওপর হামলা আসলে মিডিয়ার ওপরই হামলা। বাংলাদেশের মিডিয়াকে তিনি নিজের সাথে সমার্থক বিবেচনা করছেন। শেখ মুজিব নিজেকে বাংলাদেশ ভাবতেন। শেখ হাসিনার কাজকর্মে মনে হয় তিনিও সেটাই ভাবেন। দেখা যাচ্ছে হাসানুল হক ইনুকেও সে একই ব্যাধিতে পেয়ে বসেছে। যে যায় লঙ্কা, সেই হয় রাবণ 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads