রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সংঘাত কী অনিবার্য হয়ে উঠছে?


মূলত নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এমন কোন নির্বাচন আওয়ামী লীগ চায় না বা হতে দেবে না যে নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা নিশ্চিত নয়। আর ক্ষমতাকে ঝুঁকিমুক্ত ও নিষ্কন্টক করতেই জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। জনগণকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই তাদের নাকের ডগায় আদালতের রায়ের মূলা  ঝুলানো হয়েছে। বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছে। যারা নৈরাশ্যবাদী নন তারা আশা করছেন যে, হয়তো এক সময় সরকারের বোধোদয় হবে এবং বিরোধীদলের দাবিকে আমলে নিয়ে একটি সর্বজনগ্রাহ্য পন্থায় নির্বাচন করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তারা কেয়ারটেকার সরকারের বিষয়ে সরকারের অনমনীয় মনোভাবকে রাজনৈতিক কৌশল এবং বিরোধী দলকে চাপে রাখার মওকা বলতে অধিক পছন্দ করেন। আবার কেউ কেউ আগাম নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতাকে এই মর্মে নাকচ করে দিয়েছেন যে, এতে জনপ্রশাসনের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে হয়তো সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করাও সম্ভব হবে না। তাই প্রশাসনকে  সরকারের আজ্ঞাবহ রাখতেই নাকি নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে এই অনমনীয়তা এবং শেষ পর্যন্ত সময় ক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
একথা বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তা বাতিল করেনি। ২০১১ সালের জুন মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও বর্তমানে দফতরবিহীন মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে মাত্র আর একটি বিল এনেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। বাবু সেনগুপ্তের কথায় মনে হয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার বিষয়ে দেশে রাজনৈতিক সংকট ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে সরকার হয়তো অবাধ নির্বাচন প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে জনগণকে হতাশ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। ২০১১ সালে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলের খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একেক সময় একেক কথা বলেছেন। তারা কেয়ারটেকার সরকার বিষয়ে অনড় অবস্থানে থাকলেও সকল দলকে নিয়ে নির্বাচন এবং আলোচনার মাধ্যমে চলমান সংকটের সমাধান করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয় আদালতের রায়ের কারণে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন যে, ‘রায়েই সমস্যার সমাধান দেয়া আছে এবং সংবিধানের আলোকেই এক সময় সংকট সমাধান হয়ে যাবে’। এমন কি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বিএনপি’র মত তারা একদলীয় নির্বাচন কখনোই করবে না বরং সব দলের অংশ গ্রহণেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধীদলকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে কম করেননি। দফতরবিহীন মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, নির্বাচনে প্রথম যে দলটি অংশ গ্রহণ করবে সে দলটি হলো বিএনপি। সেনগুপ্ত বাবু ছাড়াও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা একই কথা বলেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রমী ছিলেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাসান মাহমুদ। তিনি এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বিএনপি গাধার মত সুড় সুড় করে সবার আগে নির্বাচনে আসবে’। প্রধান বিরোধী দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বেফাঁস মন্তব্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা হয়তো আওয়ামী লীগ চাচ্ছে না বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিক। তারা মনে করছে বিরোধী দল কোনভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের গণেশ উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে অংশ না নেয় এই জন্য সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিয়েছে। অবশ্য ঘটনার ধারাবাহিকতায় সে কথা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সরকার এতোদিন শুধুমাত্র সময় ক্ষেপণের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংলাপ-আলোচনার কথা বলে আসলেও সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের ভাব-সাব দেখে মনে হয় তারা সংবিধান ও নির্বাচন ইস্যুতে কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজী নয় বরং ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের তৎপরতা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের তাগিদ এবং জাতি সংঘের উদ্যোগও পুরোপুরি ব্যর্থ হতে চলেছে। কোনভাবেই রাজনৈতিক সংকট নিরসনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান কে হবেন এ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট এক নতুন মাত্রা পরিগ্রহ করেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ বিচার মানলেও তাল গাছের মালিকানাটা ছাড়তে মোটেই রাজী হচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ মারাত্মক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ফলে দেশী-বিদেশী এবং জাতিসংঘের উদ্যোগ অনেকটা অকার্যকর ও ব্যর্থ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। এখন শুধু বাকি আছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবার উদ্যোগ। তিনি এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেবেন কী-না তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। তবে তিনি উদ্যোগ নিলে ক্ষমতা পুঁজারী আওয়ামী তাতে কতখানি সাড়া দেবে তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত করে বলার কোন সময় আসেনি। তবে ফলাফল খুব একটা ইতিবাচক হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার চেয়ে অন্য ধরনের পরাজয় বরণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত আছে। প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা দিয়ে নিরাপদ প্রস্থানেও তাদের আপত্তি থাকবে না। শোনা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যেই বিদেশে বাড়ীঘর করে ফেলেছেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেদিকে পাড়ি জমানোর সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধীদলকে ক্ষমতায় আনার আত্মঘাতী ঝুঁকি নিতে মোটেই রাজী নয়। রাজনৈতিক সংকট নিয়ে নির্বাচন কমিশন অতীতে অনেক কথা বললেও তারাও এখন অন্য কথা বলছে। কমিশন সরকার ও বিরোধী পক্ষকে নির্বাচন বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে কোন ভূমিকা রাখবে না বলেও জানিয়েছে। কমিশন মনে করে এটা তাদের কাজ নয়। যেহেতু সরকারপক্ষই রাজনৈতিক সংকটের কোন সম্মানজনক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় না তাই কমিশন কোন অনধিকার করতে রাজী নয়।
বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বড় দুটি দলের মধ্যে সৃষ্ট সংকট সমাধানে গত কয়েক বছর যাবতই নানামুখী উদ্যোগ চলছে। কিন্তু সংকট সমাধানে সরকারি দলের পোড়ামাটি নীতির কারণে তা বারবার হোঁচট খেয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীনদের দেশ ও জনগণ এবং জনমতকে নিয়ে ভাববার কোন সময় নেই। তাদের জন্য যেকোন পন্থায় ক্ষমতা চাই। তাই সরকারি দলের ক্ষমতা লিপ্সার কারণেই এসব উদ্যোগ কোনোভাবেই সফলতার মুখ দেখেনি। স্মরণ করা দরকার যে, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগের অংশ হিসাবে গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসেস হিলারী ক্লিনটন। এছাড়াও জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃত্বে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন দু’বার। মুসলিম বিশ্বের ৮টি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা তৎপর হয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি। এছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা চলছে। রাজনৈতিক প্রশ্নে যাকে কখনোই নাক গলাতে দেখা যায়নি সেই চীনা রাষ্ট্রদূতও এ বিষয়ে উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। এগুলোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতে ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভা-সেমিনারে বাংলাদেশ পরিস্থিতির  ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এসব সেমিনারে আওয়ামী লীগ ও বি এন পি’র নেতারা অংশ নিয়েছেন। উদ্বেগ জানানো হয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর পক্ষ থেকেও। এমনকি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উদ্যোগও বাদ যায়নি। সর্বশেষ ইইউ প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছেন। তারা দেশের প্রধান ৪টি রাজনৈতিক দল, জাতীয় সংসদের স্পিকার, নির্বাচন কমিশনসহ দেশের সুশীল প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং সকল দলের অংশ গ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিবদমান পক্ষগুলোকে তাগিদ দিয়েছেন। এমন কী তারা এও বলেছেন যে, সকল দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচন না হলে তারা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবেন না। এর আগে সংকট সমাধানের বিষয়ে দু’নেত্রীর সাথে ফোনালাপ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব মি. বান কী মুন এবং এ বিষয়ে চিঠি লিখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী। এসব উদ্যোগের বাইরে সুশীল সমাজে গ্রহণযোগ্য দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি দু’বছর ধরে সরকার ও বিরোধী দলকে আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। আর এজন্য সরকারি দলের অহমিকা, ক্ষমতালিপ্সা ও একগুঁয়েমীকে দায়ী করেছেন অভিজ্ঞমহল।
তারা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে বাড়তে এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত গিয়েছে। তবুও সংকট সমাধান না হওয়া কোন ইতিবাচক নয়। এভাবে একের পর এক উদ্যোগ বন্ধ করার ফলাফলও ভালো হবে বলে মনে হয় না। আলোচনার পথ এভাবে বন্ধ হয়ে গেলে একপর্যায়ে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর এর ফলাফল কারো জন্যই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। আর পরিস্থিতি সেদিকেই মোড় নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ মনে করছে, সমঝোতার অর্থই হলো নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান হিসাবে শেখ হাসিনা বাদ যাচ্ছেন। তারা এ ইস্যুতে ছাড় দিলে আম-ছালা দু’ই যাবার আশংকা করছেন এবং এতে ১/১১ পরবর্তী প্রেক্ষাপট তৈরি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা সদ্য ক্ষমতাত্যাগী আওয়ামী লীগের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলেও আশংকা করছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে ১৩ সচিবের বদলিই বর্তমান সংকটের জন্ম দিয়েছে’। তার কথার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে যে, সরকার আওয়ামী প্রশাসন ও তাদের সাজানো বাগানের মাধ্যমেই আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে চাচ্ছে। কোন নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে গণপ্রশাসনের পুনর্বিন্যাস আওয়ামী লীগের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে প্রশাসনকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করার জন্য কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তির হাতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব দিতে নারাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে অনেক ইস্যুর সমাধান সম্ভব মনে করলেও সরকার প্রধান ইস্যুতেই আটকে যাচ্ছে সব আলোচনা। আর এভাবেই বড় দু’টি দলের মধ্যে আলোচনাও স্থবির হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আশা অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত একতরফা ও একদলীয় নির্বাচনের পথেই পা বাড়াচ্ছে। যদিও দলটির অভ্যন্তরে বড় একটি অংশ আলোচনার জন্য এখনও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী রাজী হলে কিছু একটা করার ব্যাপারে তারা এখন আশাবাদী। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের এ অংশটি অতিদ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে তাদের সফলতা নিয়ে মারাত্মক সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় দু’টি দলের মধ্যে আস্থার সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারি দল প্রকৃত অর্থেই আলোচনা চায় কী-না তা নিয়ে বিরোধী দলগুলো বেশ সন্দিহান। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন কী-না তা নিয়ে বিরোধী দলে সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়াও এর আগে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা সংলাপের একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েও সে বিষয়ে মোটেই আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান কে হবেন এ প্রশ্নেই এসব আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। ফলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন বিশ্বাস করতেই রাজী হচ্ছে না যে, সংলাপ বা সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধান করা সম্ভব হবে। ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তাদের ছক অনুযায়ী সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতিই গ্রহণ করছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কী মুনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারি দল তাদের প্রতিনিধি দলকে নিউইয়র্কে পাঠাতে রাজী না হওয়ায় সমঝোতার উদ্যোগটি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। একাধিকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় ‘আলোচনা হচ্ছে না’ মর্মে সংস্থাটির রাজনৈতিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে বিএনপিও এখন নিউইয়র্কে প্রতিনিধি দল পাঠাতে চাচ্ছে না বরং সংসদ থেকে পদত্যাগ করার বিষয় নিয়ে দলের উচ্চ পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। বিএনপি’র সংসদ সদস্যদের পদত্যাগপত্র আগেই থেকে জমা আছে দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। অলআউট আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়া হলে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংলাপের তাগিদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরীর দেয়া চিঠির জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সংলাপে বসতে আপত্তি নেই বলে জানাবেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তবে ওই চিঠির ফলাফলও শূন্য হবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সরকার নতিস্বীকার করবে না বরং বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী একদলীয় নির্বাচনের দিকেই তারা অগ্রসর হচ্ছে। তবে উভয় দলের শীর্ষ নেত্রীকে জন কেরীর পক্ষ থেকে আবারও ফলো আপ চিঠি দেয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই চিঠি চালাচালির বিষয় কোন ইতিবাচক ফল দেবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসুক তা আওয়ামী লীগ চাইছে না। তাদের বিবেচনায় ক্ষমতায় আসা যদি নিশ্চিত না হলো সে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের কী লাভ ?
সরকারি দলের এই একগুঁয়েমীকে বিরোধী দলের ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন অভিজ্ঞ মহল। কারণ, বিগত সাড়ে চার বছরের আওয়ামী শাসনামলে সরকার বিরোধীদলের হাতে অনেক জলন্ত ইস্যু তুলে দিলেও বিরোধী দল সেসব ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে সরকরের বিরুদ্ধে তেমন কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। যদিও বিরোধী দলের পক্ষে জনমত প্রবল ছিল এবং এখনও আছে। সরকার পক্ষ ধরেই নিয়েছে যে, যেহেতু বিগত সাড়ে চার বছরে বিরোধী দল সরকারের উপর্যুপরি ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তাই ভবিষ্যতেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে সরকার পতনের মত কোন জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে বল মনে হয় না। এ বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি এক আলোচনা সভায় বলেছেল, ‘যাদের আন্দোলনের মুরোদ নেই, তারাই বেশি বেশি আস্ফালন করে’। আর একটি ঘটনা সরকারি দলকে বেশ আশান্বিত করেছে তা হলো  ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনা। এ ঘটনাকে আওয়ামী লীগ মডেল হিসাবে নিয়েছে। দেশের সচেতন মহল মনে করেছিল যে, হেফাজতের লক্ষ জনতার সমাবেশকে আওয়ামী লীগ কোনভাবেই মোকাবিলা করতে পারবে না বরং তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েই তাদেরকে সন্তষ্ট করতে হবে। কিন্তু ৫মে গভীর রাতের হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযান, ব্যাপক হতাহতের ঘটনা এবং হেফাজত নেতাকর্মীদের সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করার বিষয়টি সরকার সাফল্য হিসাবেই দেখছে। যদিও এ ঘটনার মাধ্যমে সরকারের জনসমর্থন আশংকাজনক হিসাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু সরকার তো জনমতের কোন তোয়াক্কাই করছে না। তারা ধরেই নিয়েছে যে, জনগণের ভোট নিয়ে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই তারা জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে যদি বিরোধী দলগুলো জোরালো কোন আন্দোলন গড়ে তোলে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। আর সে লক্ষ্যেই সরকার হরতাল বিরোধী আইন তৈরি করতে যাচ্ছে। প্রয়োজনে সরকার হেফাজতের মত বিরোধী দলগুলোর ওপর ক্র্যাক ডাউন চালাবে বলেও আভাস পাওয়া গেছে। আর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে কোনভাবেই ছাড় দিতে রাজী নয়।
আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের এই নেতিবাচক অবস্থানের কারণে সরকার এবং বিরোধী দল এখন রীতিমত মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। সরকার যেকোন মূল্যে একদলীয় ও একতরফা নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। আর বিরোধী দল থেকেও বলা হচ্ছে তারা একদলীয় নির্বাচনে কোনভাবেই অংশ গ্রহণ করবেন না বরং যেকোন মূল্যে তা প্রতিহত করবেন। ফলে উভয় পক্ষের বাক-বিত-ায় রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সে আগুনে আবার ঘি ঢেলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘উন্নয়ন করলে ভোট পাওয়া যায় না এটা আমার মা বুঝতে পারেননি। ভোট পেতে নির্বাচনী চমক দেখানো হবে’। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, ‘বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচন করবোই। পৃথিবীর কোন শক্তিই এ নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। এ নির্বাচন হবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে। আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচন হবে’। অপরদিকে নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংবিধান সংশোধন ছাড়া নির্বাচনের চেষ্টা হলে প্রতিহত করা হবে’। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে সরকার দেশে আবার ১/১১ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হলে সংঘাত অনিবার্য। গণবিষ্ফোরণের মুখে সরকারের পতন হবে’। বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘যেকোন মুহূর্তে আন্দোলন শুরু হবে। আন্দোলন শুরুর ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থান হবে’।
নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থানকে কোনভাবেই ভাল চোখে দেখছেন না অভিজ্ঞ মহল। তারা মনে করছেন উভয় পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণেই সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং সরকারের অতিমাত্রায় ক্ষমতা লিপ্সা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবেই এমন সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধান না হলে দেশে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। যা হতে পারে ১/১১ এর চেয়েও ভয়াবহ। যা কোন পক্ষের জন্যই সুখকর হবে না। তবে ক্ষমতাসীনদের জন্য অধিক ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads