বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ন্যাড়া বেলতলায় দু’বার যায় না


দারুণ সুদর্শন ছেলেটি। বিবিসির হিন্দি অনুষ্ঠানে খণ্ডকালীন ব্রডকাস্টার ছিল। মেয়েটিও খুবই সুন্দরী। হিন্দি বিভাগে টাইপিস্ট হয়ে এসেছিল। কাছাকাছি বসে কাজ, সর্বক্ষণ দেখাশোনা। পরস্পরের প্রেমে মজে যেতে ওদের দেরি হয়নি। কোনো কোনো প্রেম পরিণয়ে সমাপ্তি পায়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। বছর না পেরোতেই ওরা বিয়ে করল। অন্যরা প্রশংসায় ফেটে পড়লেন। আহা, মণি-কাঞ্চন সংযোগ যেন! 
প্রেমে ভাটা পড়তেও বেশি বিলম্ব হয়নি। দেখা গেল, ওরা আর একসাথে চলাফেরা করে না সব সময়। মৃদু গুঞ্জনও শুরু হয়ে গেল। প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয় দুজনের। ছেলেটি নাকি বউকে পেটায় প্রায়ই। এই করেই চলছিল এক বছরের বেশি দিন। একদিন শুনলাম, মেয়েটি কাজে ইস্তফা দিয়েছে এবং ভারতে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে। আরো কিছু দিন যায়। ওদের ঘনিষ্ঠজনেরা বলাবলি শুরু করলÑ ছেলেটি নাকি বিরহে উন্মাদপ্রায়, বউকে আবার ফেরত পেতে চায়। প্রতিদিনই ফোন করে বউকে। কিছু দিন পর সেও চলে গেল ভারতে। 
ছেলেটির সাথে এরপর আমার দেখা কয়েক বছর পরে। দিল্লিতে দূরদর্শনের মহাপরিচালকের অফিসে। আমি গেছি সৌজন্য সাক্ষাতে, আর সে এসেছে ব্যবসায়িক তদবিরে। বউয়ের সাথে সমঝোতা আর হয়নি। একবারের অভিজ্ঞতাই মেয়েটির জন্য যথেষ্ট হয়েছে। সাবেক স্বামীকে সে আর দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে চায়নি। ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা আর স্বামীর নৃশংসতাকে ক্ষমা করতে সে রাজি ছিল না। শেষে বউ তাকে ডিভোর্স করে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। ছেলে চলে গেল বলিউডে। সেখানে সে ছায়াছবি তৈরি করেছে। নায়ক তার হারানো প্রেম ফিরে পাওয়ার জন্য যেসব অসম্ভব কাণ্ডকারখানা করেছে সে কাহিনী। দূরদর্শনে ধারাবাহিকভাবে সে ছবি প্রদর্শনের তদবির করতে এসেছে। আর হ্যাঁ, ছবির নাম দিয়েছে ফির একবার 
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুমুল উৎসাহে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছেন, যদিও নির্বাচন আদৌ হবে কি না সে ব্যাপারে অনেকেরই সন্দেহ। শেখ হাসিনার প্রচারাভিযানের মূল কথাও যেন ফির একবার। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি বলছেন আরো একবার ভোট দিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী করতে। তাহলে কী করবেন তিনি? প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। তিনি পদ্মায় সেতু তৈরি করবেন (ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে যে সেতু তৈরির কাজ চার বছর বন্ধ), ২০০৮ সালে দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির যেগুলো অপূর্ণ আছে (প্রায় সব প্রতিশ্রুতি পালনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে) সেগুলো পূর্ণ করবেন এবং পূর্ণ গণতন্ত্রের চর্চা করবেন। কার্যত প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করে নিলেন, এত দিন যে পন্থায় তিনি দেশ শাসন করেছেন সেটা গণতন্ত্রসম্মত ছিল না। 

পদে পদে গণতন্ত্রের বিরোধিতা 
খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। ৯ বছর ধরে যেভাবে তিনি লে. জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন (যার অধিকাংশ সময় হাসিনা এরশাদকে সমর্থন দিয়েছেন) কৃতজ্ঞ জাতি সে জন্য ভোট দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করেছিল। বিশ্বের বহু দেশের পর্যবেক্ষক এসেছিলেন সে নির্বাচন দেখতে। দেখে তারা চমৎকৃত হয়েছেন; কিন্তু শেখ হাসিনা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যে নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি সেটা আবার কিসের নির্বাচন হলো? তিনি সংসদ বর্জন করলেন, রাজনীতিকে পথে টেনে নামালেন, ১৭৩ দিন হরতাল করলেন, নির্বিবাদে খালেদা জিয়াকে দেশের কাজ করার সুযোগ দিতে তিনি অস্বীকার করলেন। 
শেষতক তিনি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দলে টেনে আন্দোলন শুরু করে দিলেন। অত্যন্ত সহিংস আর রক্তক্ষয়ী ছিল সেই আন্দোলন। বহু মানুষ মারা গেছে, জখম হয়েছে আরো বেশি। সড়ক, সেতু ও বন্দর অবরোধ করা হয়েছে; রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধান অনুযায়ী খালেদা জিয়া নির্বাচন দিয়েছিলেন এবং জয়লাভও করেন। আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সে নির্বাচন বর্জন করে, তাদের সহিংস আন্দোলন আরো রক্তঝরা হয়ে ওঠে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার আশায় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি চালু করে। সে বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্বল্প ব্যবধানে আওয়ামী লীগ একক গরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সংসদ সদস্যের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। 
সে নির্বাচনে ভোটারদের বিবেচনা ছিল দ্বিমুখী। তারা আশা করেছিল, শেখ হাসিনা শান্ত হবেন, দেশে শান্তিপূর্ণ আর গণতান্ত্রিক শাসন চালু হবে। শত হলেও শেখ মুজিবের মেয়ে তো! কিন্তু রাজনীতিতে তারা যে স্থায়ী অশান্তির বীজ বপন করলেন, ভোটারেরা তখন বুঝতে পারেনি। মুজিবের কন্যার জন্য তাদের সহানুভূতি যে স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতালোভেরই জন্ম দেবে, বুঝে ওঠা তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। 
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা স্থায়ী করার দিকে মনোযোগ দিলেন। ক্যাডারদের গডফাদারেরা দেশজোড়া ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের, ঢাকার মোফাজ্জল হোসেন মায়া এবং নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের নাম মানুষ তখন ত্রাসের সাথে স্মরণ করেছে। সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রসঙ্গ তোলায় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের ওপর ক্রুদ্ধ হন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনি একটির বদলে দশটি লাশ ফেলারতাগিদ দিয়েছিলেন, তাদের পুরুষত্ব নিয়ে বিদ্রƒপ করেন। ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধান কোনো দেশে প্রকাশ্যে এজাতীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। 

হাসিনার বিজয় নির্বাচনের শর্ত নয় 
এখন প্রমাণিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতার কোনো দাম নেই আওয়ামী লীগের ক্ষমতালিপ্সার কাছে। তিনি যেন বলতে চান, আমি যা করি তোমরা সেটা করতে পারবে না। আর তিনি গদি না পেলে অন্য কাউকে দেশ শাসন করতে দেবেন না। ২০০৬ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেছিল। আওয়ামী লীগ জানত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। শেখ হাসিনা লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলনের ডাক দিলেন কার্যত সংবিধানকে হত্যা করার লক্ষ্যে। রাজধানীর রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে এক ডজন মানুষ হত্যা করা হয়। আবারো সড়ক ও বন্দর অবরোধ, রেললাইন উপড়ে ফেলা, এমনকি রাষ্ট্রপতিকে গণভবনে কার্যত বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়। 
পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের যোগসাজশে এবং ভারতীয় হাইকমিশনার ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ষড়যন্ত্রে (বাংলাদেশের দুজন পত্রিকা সম্পাদকসহ) একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকার চালু হয়। খালেদা জিয়াকে বিদেশে নির্বাসিত করার এবং বিএনপিকে ভেঙে দেয়ার সব রকম চেষ্টা হয়েছিল সে সরকারের আমলে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন স্বাভাবিক ছিল না। বিদেশীদের যোগসাজশে দেশজোড়া একটা মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। 
কী করেছেন শেখ হাসিনা এই দ্বিতীয় মেয়াদে? নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১০ টাকা কেজি দরে মানুষকে চাল দেবেন, দুর্নীতি দমন করা হবে এবং মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণ মিডিয়ায় প্রকাশ করা হবে, রাতারাতি বিদ্যুৎ সঙ্কটের অবসান এবং পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর একটাও পূরণ করা হয়নি। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের তালিকা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি গোড়াতেই পরিত্যক্ত হয়। সরকারের এবং তাদের ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতি করার ওপেন জেনারেল লাইসেন্সইযেন দিয়ে দেয়া হলো। 

দুর্নীতির ফাদার-মাদার 
প্রথমে শেয়ারবাজার লুট করে ৩৫ লাখ পরিবারকে ফতুর করে দেয়া হয়, পণ্যের বাজারকে মন্ত্রী ও তাদের স্বজনদের সিন্ডিকেটের ফাঁদে ফেলে মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেয়া হয়, সরকারের কাছের জনেরা ডেসটিনি, হলমার্ক ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সাধারণ মানুষের আমানত লুট করে নিরাপদেই আছেন, মন্ত্রী এবং তাদের পারিবারিক ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো কুইক রেন্টালকেলেঙ্কারিতে ২০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। কিন্তু দুর্নীতির ফাদার-মাদার বিশ্বের মানুষ দেখেছে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে। 
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেছেন, বিশ্বব্যাংক কোনো টাকাই দেয়নি, দুর্নীতি হলো কী করে? তার কথায় বিরল কিছু সত্যতা অবশ্যই আছে। বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে সেই আশ্বাসে কানাডার এসএনসি লাভালিন কোম্পানি দুর্নীতির ভাগবাটোয়ারা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাময়িকভাবেআগাম দেয়া ৩৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের অনুমোদন ছাড়া এ টাকা লাভালিন কোম্পানিকে ধার দেয়া তো সম্ভব নয়। তাহলে এই দুজন কর্মকর্তাও কি দায় এড়াতে পারেন? 
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজদের নামের তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল। বলেছিল, এদের বিচার ও শাস্তি হলে তারা আবার পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কিছুতেই দুর্নীতিবাজদের পালের গোদা হিসেবে সমালোচিত, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন সম্বন্ধে তদন্ত কিংবা তার বিচার করতে রাজি হয়নি; বরং শেখ হাসিনা আবুল হোসেনকে প্রকৃত দেশপ্রেমিকবলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। আবুল হোসেন কার হয়ে প্রক্সিতে দুর্নীতি করছিলেন সে সম্বন্ধে দেশের মানুষের কৌতূহল বেড়েই চলেছে। হাসিনা বলছেন, আবার গদি পেলে তিনি সেতুটি তৈরি করবেন। কিন্তু আগেরবারে যে সেতু তৈরি হলো না, সে দায়িত্ব কে নেবে? 
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হত্যা ও নির্যাতন। বস্তুত এ বাবদ তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে নথিভুক্ত হয়েছে। ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে সরকারের শত শত বিরোধী ও সমালোচককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সরকারের দলীয়কৃত পুলিশ ও র‌্যাব শতাধিক মানুষকে গুম ও হত্যা করেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে সেই যে ১৭ মাস আগে বনানী থেকে ধরে নিয়ে গেল, তারপর তার আর কোনো খোঁজ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। 
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ড দানের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে প্রতিবাদ উঠেছিল, সেটা দমন করতে বহু প্রাণ বিনষ্ট করা হয়েছে। সর্বোপরি গত ৬ মে অতি ভোরে শাপলা চত্বরের দমনাভিযানে বহু নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সরকার ও তাদের দলীয়কৃত পুলিশ অতি বিলম্বে হত্যার কথা অস্বীকার করলেও তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করছে না। বিশ্বমিডিয়ায় ও ব্লগে সে ঘটনার বহু ভিডিও ছবি দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা বিরোধী দলগুলোর যেসব নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে, সেগুলো তো আছেই। সরকার যত দিন এসব গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইবে না, তত দিন বাংলাদেশের কোনো মানুষ আবার এ সরকারকে গদি দেয়ার কথা ভাবতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। 
শেখ হাসিনার উক্তিগুলো আন্তরিক নয় বলেই একেক দিন একেক সুরে কথা বলছেন। বিগত কয়েক দিনে পুলিশ বাহিনীকে যেসব পরামর্শ তিনি দিয়েছেন, তার অর্থ উপলব্ধি করা কি সাধারণ বুদ্ধির মানুষের পক্ষে সম্ভব? আবার গদি পেলে তিনি গণতন্ত্র দেবেন। এর অর্থ দাঁড়ায়, গত দুই দফায় গণতন্ত্র তিনি দেননি। সেটা অবশ্যই সত্যি কথা। কিন্তু আবার গদি পেলে তিনি যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়? দু-দুবার তিনি বাংলাদেশের মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। ভবিষ্যতে যে আবার তিনি তা করবেন না তার প্রমাণ কী? দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক দাবি অনুসারে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির নির্বাচন দিতে অস্বীকার করে তিনি প্রমাণ করে চলেছেন যে, তার গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। নইলে তিনি তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির জন্য জাতির দাবি মেনে নিতেন, তাহলে শান্তিতে দেশে নির্বাচন হতে পারত। 
এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ হাসিনা আমেরিকা থেকে যুবরাজজয়কে আমদানি করেছেন। কিছু দিন আগে জয় প্রায় ঘোষণাই করেছিলেন যে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। প্রশ্ন উঠছিল, আওয়ামী লীগ জয়ী হবে বলে তার কাছে তথ্য আছে, এ কথা বলে তিনি আরো একটি মাস্টারপ্ল্যানের ইঙ্গিত দিয়েছেন কি? তারপর হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় চলে গেলেন। প্রশ্ন উঠল, তার এই আকস্মিক অন্তর্ধানের সাথে ৯ সেপ্টেম্বর কানাডার আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার প্রি-হিয়ারিংয়ের তারিখের কোনো সম্পর্ক আছে কি? আবার হঠাৎ করেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হলেন। এবারে প্রশ্ন উঠছেÑ ওই প্রি-হিয়ারিং ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যাওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না।
এ যাবৎ যেসব কথাবার্তা তিনি বলেছেন তাতে তার আনাড়িপনাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? তার মা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, এ দেশ সম্বন্ধে তার প্রকৃত জ্ঞান এখানেই সীমিত বলে সন্দেহ হচ্ছে। না জেনেশুনে উল্টাপাল্টা দাবি করছেন তিনি। তার নানার হত্যাকাণ্ডের পর নাকি শুধুই মাদরাসা তৈরি হচ্ছে, সেকুলার স্কুল নয়Ñ তার এ দাবি অবাস্তব কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা এই সময়ের মধ্যে সেকুলার স্কুলের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। 
জয় বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মসজিদে পাঠাচ্ছেন। তবে নামাজ আদায় করার জন্য নয়। তার মা এবং আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে মসজিদে যাতে বিরূপ কথাবার্তা কিংবা খুতবা পড়া না হয় সেটা তিনি নিশ্চিত করতে চান। ক্যাডারদের স্বভাব অনুযায়ী মাথা ফাটাফাটি হবে, নাকি শুধুই ভীতি প্রদর্শন করা হবে, সেটা শুধু ভবিষ্যতেই বলা যাবে। জয় আরো বলেছেন, মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা হ্রাস করার জন্য তিনি ইতোমধ্যে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান। তারা ধর্মপ্রাণ। ভয় দেখিয়ে মসজিদের মুসল্লি ও মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা হ্রাস করাকে অবশ্যই ইসলাম ধর্মের ওপর আরো একটি আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হবে। 
আমার যত দূর জানা, একমাত্র হিটলারের আমলেই মানুষের পছন্দ-অপছন্দের ওপর এ ধরনের আঘাত এসেছিল। হাইনরিখ হিটলারের স্টর্মস্ট্রুপার বাহিনী লাখ লাখ কপি বই পুড়িয়েছিল এ লক্ষ্যে। এ সরকার আল্লাহ-রাসূল সা: ও ইসলামবিরোধী ব্লগারদের সংরক্ষণ দিয়েছিল। অতি বিলম্বে গ্রেফতার করা হলেও তাদের জামিন দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়ায় মাহমুদুর রহমানকে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় বিনা বিচারে জেলে রেখে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, আমার দেশ পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। 
ধর্মবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করতে আন্দোলন করেছিল হেফাজতে ইসলামনামে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের গাঁওগেরামের বিশ্বাসী মানুষ। রাতের আঁধারে শাপলা চত্বরে ঘুমিয়ে থাকা সেই লাখ মানুষের ওপর নির্বিচারে এক লাখ ৫২ হাজার গুলি চালিয়েছিল সরকারের বাহিনী। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসকে নির্বাসিত করে, সন্ত্রাস দমনের নামে হাজার হাজার দাড়ি-টুপি পরা মুসলমানকে জেলজুলুম দিয়ে এবং শেষতক শাপলা চত্বরে হত্যা চালিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ইসলামের অবমাননা করেছে বলে ধর্মপ্রাণ মানুষ মনে করে। তার ওপর সজীব ওয়াজেদ জয়ের সর্বশেষ কুকীর্তিগুলো বাংলাদেশের মানুষের গোদের উপর বিষফোঁড়া বলেই মনে হবে। 

জয় বনাম ববি 
শেখ হাসিনা আসলে বাংলাদেশের মানুষকে চিনতে পারেননি। তার পুত্রের তো চিনতে পারার কথা নয়। জয়ের শৈশব কেটেছে বাবা-মায়ের সাথে জার্মানিতে, তারপর মা ও খালার সাথে দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তারপর আমেরিকায় গিয়ে তিনি মার্কিন রমণীকে বিয়ে করেন। তিনি মায়ের চেয়েও বেশি এগিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেনÑ ভাবটা এমন, আওয়ামী লীগকে আবার গদি দেয়া হলে যে যা চাইবে দিয়ে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের ভেতরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য তিনি নন। প্রকাশ্যে কেউ কেউ এবং গোপনে অনেকেই বলছেন, জয়ের চেয়ে শেখ রেহানার পুত্র রিজওয়ান মুজিব সিদ্দিক (ডাকনাম ববি) ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য অধিকতর যোগ্য। 
বাংলা প্রবাদ অনুযায়ী, সাত বছরে যার বুদ্ধি হয় না, সত্তর বছরেও তার বুদ্ধি হয় না। এ কথা সবাই বুঝবেন, ১০ বছর গদিতে থেকে যারা সুশাসন করতে পারেনি, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পালনে ব্যর্থ হয়েছে, দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অনেকখানি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে; আরো পাঁচ বছরের জন্য তাদের ক্ষমতা দেয়া হলে বাংলাদেশ আরো অনেক বেশি বিপন্ন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ আরো একটি সিকিম হয়ে যেতে পারে। সে জন্যই এ সরকারকে গদিতে রাখতে ভারতের এত আগ্রহ। সে জন্যই তারা নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন চায়। ফরমালিন ইনজেকশন দিয়ে বর্তমান সংসদ আর বর্তমান মন্ত্রিসভা দিয়ে গদি আঁকড়ে রাখাই আওয়ামী লীগ ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। সে জন্যই কি সংসদ ভেঙে দিতে সরকারের এত আপত্তি? 
বাংলা প্রবাদে হিতোপদেশ আছেÑ ন্যাড়া বেলতলায় দুবার যায় না। যাদের মাথায় চুল নেই, গাছ থেকে বেল মাথায় পড়লে তারা বেশি ব্যথা পায়। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বড় ব্যথা। বিশ্বাসভঙ্গ আর অত্যাচার-নির্যাতন আওয়ামী লীগের দুই দফার শাসনের বিষাদের কাহিনী। এই দল দ্বিতীয়বার ক্ষমতা পেতে চায়, ভাবতেই তাদের আতঙ্ক হচ্ছে। ভোট দিয়ে তারা কখনোই তাদের আবার গদিতে বসাবে না। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads