মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ফরমালিনমুক্ত রাজনীতি চাই


ফরমালিন শব্দটি কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে এত পরিচিত ছিল না। বর্তমানে কারো কাছে আর শব্দটি অপরিচিত নয়। আম, আপেল, কলা, খেজুর, মালটা, আঙুর, তরমুজ সব ফলেই নাকি ফরমালিন মেশানো হয়। আমি দোকানদারকে বলেছি, আপনি কি এসব ফলে ফরমালিন নিজ হাতেই মেশান? সে উত্তর দিয়েছে, আমাদেরকে মেশাতে হয় না। যা করার মহাজনই তা করে থাকে। আমরা চুনোপুঁটি মহাজনের খোঁজ পাবো কী করে?’ ফলমূলই শুধু নয়, ফরমালিনের মেকআপ নিয়ে এখন মাছও বাজারে বারবনিতার মতো খদ্দেরকে চমক দেখায়। আমরা চমক দেখে পলক না ফেলেই নোট এগিয়ে দিচ্ছি। আমাদের রান্নাঘরে ফরমালিন আসছে। আমরা খাচ্ছি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও খাওয়াচ্ছি। জনগণ ফরমালিনের ধোঁকার কাছে জিম্মি। কর্তাব্যক্তিরা নোটের কাছে জিম্মি। তাদের মনোভাব বোধ হয়, মানুষ খাকÑ খাদ্যের অভাব দূর হোক! একদিন সবাইকেই তো মরতে হবে! দেশের কতজন রাজনৈতিক নেতানেত্রী ফরমালিনযুক্ত তা কি সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বলতে পারে না? যিনি হেডস্যার তাকে অনেক জানতে হয়; তিনি বেশি জানেন বলেই তো হেডমাস্টার হতে পারেন। দেশটা যদি একটা স্কুল হয় তাহলে হেডস্যার কি প্রধানমন্ত্রী নন? তিনি নিজে যখন কাউকে নকল বলেছেন, তখন আমরা বিশ্বাস না করে পারিনি। পরীার হলের নকল নাকি সব শিক ধরতে পারেন না। নিন্দুকেরা বলেন, যেসব শিক অতীতে নকল করে পাস করেছেন তারাই নাকি বেশি নকল ধরতে পারেন। এ দেশের কেউ নকলনবিস, কারো আদ্যোপান্ত নকল। নকলে নকলে নাকাল আমরা আজ বিয়াল্লিশ বছর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে তিনি কি আবারো লিখতেন বিয়াল্লিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি!এই কথা রাখা না রাখার ব্যাপারটা দেশে ঘটছে নকল রাজনীতির কারণে, যে নকল রাজনীতি কথার ফুলঝুরি নামক ফরমালিনের কারণে আমরা ধরতে পারিনি। তাই মতার পালাবদল যখনই ঘটে তখন ফরমালিনের মেকআপ নিয়ে মতাধর দল এ দেশের জনগণকে চমক দেখানোর চেষ্টা করে। বিগত সাড়ে চার বছর আমরা বর্তমান সরকারের প্রধান ও তার মন্ত্রীদের কাছ থেকে ফরমালিনযুক্ত অনেক কথার ফুলঝুরি শুনেছি। কেউ থলের বিড়াল বের করার কথা বলে নিজেই বেড়াল হয়েছেন, কেউ ঝাঁকুনি দিয়ে রানা প্লাজার মতো অট্টালিকা ভূমিসাৎ করার ফর্মুলা আবিষ্কার করেছেন, কেউ জনগণকে কম খেয়ে খাদ্যশস্যের সাশ্রয় করার কথা বলেছেন, কেউ এক বছরে পাঁচ-ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের কল্যাণ করার কথা বলেছেন, কেউ নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে রাবিশ বলে ভেবেছেন, কেউ আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনি দম্পতির হত্যাকারীকে খুঁজে দেয়ার মতো ফরমালিনযুক্ত টাটকা কথা বলেছেন, কেউ বারবার বিদেশে যেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেও তিস্তা ও টিপাইমুখ বাঁধের কোনটাও নাড়াতে পারেননি। আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের কর্ম নয়। সরকারের কর্মটা তাহলে কী? একটি পূর্ণাঙ্গ শিানীতি উপহার দিয়ে শিামন্ত্রী মহোদয় শিা খাতের উন্নতি সম্পর্কে ফরমালিনযুক্ত অনেক লোভনীয় কথা দেশবাসীকে শুনিয়েছেন। তিনি ১৯৮০ সালের মূল্যমানের একশটাকার বাড়িভাড়া পাঁচশটাকা করে ফরমালিনযুক্ত বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, তিনি বেসরকারি শিকদের বাড়িভাড়া পাঁচ গুণ বাড়িয়েছেন। ১৯৮০ সালের একশটাকা আর বর্তমানের পাঁচশটাকার মূল্যমানে বেশি প্রভেদ আছে কি? তাহলে বাড়ালেন কী তিনি? নতুন শিানীতি উপস্থাপন করার পর আবার শিা আইন করার যৌক্তিকতা কী? কোথায় শিকদের জন্য তার স্বতন্ত্র বেতন স্কেল? দরিদ্র শিকদের প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করার আদেশ দিয়ে তিনি শিকদের কিভাবে মঙ্গল করতে চান? আদৌ কি এই টিউশনি বন্ধ করা সম্ভব? আবহমানকালের গৃহশিকতার প্রথা তিনি কী দিয়ে কেন বন্ধ করবেন? গৃহশিকতা যদি না থাকত তাহলে রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষী কি গড়ে তোলা সম্ভব হতো? বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একটু বেশি মাত্রায় ফরমালিন ব্যবহার করেছিলেন। ফলে পদ্মা সেতুর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির বদলে তাতে পচন ধরে ধরাশায়ী হয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর আবার তাদেরকে নতুন ফরমালিন মাখিয়ে নতুনরূপে দফতরবিহীনদোকানে হাজির করা হয়েছে। দফতরবিহীন মন্ত্রীদের কি শপথ নিতে হয় না? তা কি এরা নিয়ে ছিলেন? সরকার গণতন্ত্র রা করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাবাতিল করে দিয়েছে। এ েেত্র সরকার মনে করেছে তাদের দলে যারা আছেন তারাই শুধু এ দেশের খাঁটি নাগরিক। বাকি যারা আছে তারা এ দেশের কেউ নয়। তাই তো যে পদ্ধতির সরকারে বর্তমান সরকার নিজেই নির্বাচিত হয়ে এসেছে, সেই পদ্ধতিকেই তারা অকল্যাণকর বলে বাতিল ঘোষণা করেছেন। যদি বর্তমান সরকার আবার মতায় আর না আসতে পারে, ভবিষ্যতে কি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না? গরজ বড় বালাই। ফরমালিন দেখা যায় না; কিন্তু তার রিঅ্যাকশন অগোচরে চলতেই থাকে। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণও এক ধরনের ফরমালিন। তাদের মতামত চোখে দেখা যায় না; কিন্তু সরকার গঠনের সময় ব্যালটের মাধ্যমে সেই ফরমালিনের বিষক্রিয়া ঠিকই ধরা পড়ে। সেই বিষক্রিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য বর্তমান সরকারের উচিত কোন কোন খাতে ফরমালিন আছে, তা তুলে ধরা দেশের মানুষের কাছে। কারণ দেশের মানুষ আর কোনো ফরমালিনযুক্ত কথা শুনতে চায় না। দেশের মানুষ ফরমালিনমুক্ত কথা চায়, ফরমালিনমুক্ত রাজনীতি, সরকার, প্রশাসন চায়। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads