সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জঙ্গিবাদ, বিএনপি ও আগামী নির্বাচন


বাংলাদেশের রাজনীতির কয়েকটি ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আগ্রহ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ঈদের ছুটির দুই দিন পরই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার আলোচনা থেকে তা-ই প্রমাণিত হয়। সাক্ষাতের দুই দিন আগেই মজিনা দেশ থেকে ফিরে এসেছেন। নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার বিশদ আলোচনা হয়েছে এবং তাকে প্রয়োজনীয় ব্রিফিংও দেয়া হয়েছে। ওই ব্রিফিংয়ের ভিত্তিতেই মজিনা নির্ধারিত ইস্যুগুলো নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলোচনা করেন। খালেদা জিয়ার সাথে এসব ইস্যু নিয়ে আলোচনার কারণ আগামী জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। খালেদা জিয়ার সাথে মজিনার আলোচনার যেসব ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে, তা হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং প্রতিবেশী ভারতের সাথে সম্পর্ক। 
আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার সরকার কিভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করবে এবং দিল্লির সাথে তার সরকারের সম্পর্ক কী হবে, এসবই মজিনা আগাম তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন। অর্থাৎ এসব বিষয়ে মজিনা এক দিকে খালেদা জিয়ার মনোভাব বা নীতিগত অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, অন্য দিকে এসব বিষয়ে তার কাছ থেকে এক ধরনের ওয়াদাও আদায় করেছেন। কারণ খালেদা জিয়া যে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার প্রধান শরিক দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী এবং তিনি ও তার জোট নতুন ইসলামি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন। জামায়াতের আন্দোলনে সহিংসতা ও হেফাজতে ইসলামের উত্থানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পাশ্চাত্য মিত্ররা এবং প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি তথা খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে নতুন করে মূল্যায়ন করছে, এটি এখন আর অস্পষ্ট নয়। খালেদা জিয়া এসব বিষয়ে তার নীতিগত অবস্থান পরিষ্কার করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ তার মিত্ররা আগামী দিনে তার ও তার জোটের ভূমিকাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখবে। এই পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করবে আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। 
খালেদা জিয়ার সাথে ড্যান মজিনার আলোচনায় ভবিষ্যতে ভারতের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। সুতরাং ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব উদ্যোগেই হোক আর ভারতের ইচ্ছাতেই হোক, বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। বহু আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন ও স্থল সীমান্ত চুক্তি নিয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আগামী নির্বাচনে তার কুফলের আশঙ্কায় কিছু দিন আগে উদ্বিগ্ন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লি। শেখ হাসিনার সরকার চাহিবামাত্রদেশের সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করে ট্রানজিটসহ সব সুবিধাই আগ বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতকে। কিন্তু ভারতের প্রতিশ্রুত এক বিলিয়ন ডলার ঋণের একাংশ ছাড়া বাংলাদেশ আর কিছুই পায়নি। ভারত থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানির কথা ছিল, তাও এ সরকারের আমলে অনিশ্চিত। সীমান্তে এখনো কয়েক দিন পরপরই বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশের নাগরিকেরা হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ হতাশা বুকে নিয়েই দীপুমনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু মনমোহন সিং তাকে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি, তবে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন। বলেছেন, ভারত আগামীতে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই দেখতে চায়, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগই সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করুক, এটিই দিল্লির প্রত্যাশা বা ইচ্ছা। এ প্রসঙ্গে নামী-দামি এক বুদ্ধিজীবী বন্ধুর সাথে আমার আলোচনার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার। কিছু দিন আগে এক টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোর পর তিনি আমাকে বললেন : চলেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, একটা রুমে নিরিবিলি বসি। আমাদের জন্য চা-বিস্কুট এলো। আমরা একান্তে কথা বলছি। তিনি বললেন, আমার সাথে তো আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের ওঠা-বসা আছে। তারা জোর দিয়েই বলেন, বিএনপির যতই জনপ্রিয়তা থাক, তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না; কারণ তারা ক্ষমতায় যাক ভারত এটি চায় না। প্রয়োজনে নির্বাচনই হয়তো হবে না। এরপর তিনি বললেন, প্রণব মুখার্জির সাথে দেখা না করে খালেদা জিয়া দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি। হাজার হলেও তিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট... ঢাকায় এসেছেন... আমাদের অতিথি। সৌজন্যের খাতিরে হলেও তার সাথে দেখা করা উচিত ছিল। খালেদা জিয়া যখন দিল্লি গিয়েছিলেন তখন তাকে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়েছে। আদর-আপ্যায়ন করা হয়েছে। যা হোক, বিষয়টি তো দৃষ্টিকটু হয়েছেইÑ বিএনপির জন্য ভালো হয়নি। তিনি উদ্বেগের সাথে আমাকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে বিষয়টি জানাবেন, যাতে তারা দিল্লির সাথে সম্পর্ক ভালো করার উদ্যোগ নেন। যা হোক, বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে তার এ বার্তা আমার পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে পরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দীপুমনির কাছে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার থাকবে বলে যে আশা বা ইচ্ছা পোষণ করেছেন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা খালেদা জিয়ার সাথে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে যে আলোচনা করেছেন; তা আমার ওই বন্ধুর কথাগুলোর গুরুত্বই অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ দিকে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে হতাহতের ইস্যুতে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার’-এর সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধিকারের রিপোর্টে হেফাজতের ওই সমাবেশে ৬১ জন নিহত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার নিহতদের নাম-ঠিকানা চাইলে অধিকারতা দিতে অস্বীকার করে এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব করে, যার কাছে তারা নিহতদের নাম-ঠিকানা পেশ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, যিনি অধিকারের রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে তৎপর ছিলেন তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে সহযোগিতার উদ্দেশ্যেই অধিকার এই মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করেছে। মন্ত্রীর কথা এটিই প্রমাণ করে যে, আদিলুর রহমানকে গ্রেফতারের পেছনে রাজনৈতিক মতলব কাজ করেছে। সরকার দাবি করছে, হেফাজতের সমাবেশে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইস্যুতে এখনো দেশ-বিদেশে বিতর্ক চলছে, তা তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠন করতে সরকারের আপত্তি কেন? সরকার আসলে তার রাজনৈতিক স্বার্থেই এই ইস্যু জিয়েই রাখতে চায়, শেষ করতে চায় না। 
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম সবাই ঈদের পর আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির প্রধান ও একমাত্র দাবি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। জামায়াত স্বাভাবিক কারণেই আন্দোলন করবে দলের অস্তিত্ব ও দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিতে। হেফাজতের ১৩ দফা তো রয়েছেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠন হিসেবে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকার তদন্ত শুরু করেছে। এ তদন্তের রিপোর্ট কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ দিকে আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লার মামলা চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশের পরিবর্তে যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তবে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রীসহ তার একাধিক মন্ত্রী ও দলের নেতা-নেত্রীরা জোর দিয়ে বলেছেন, তাদের সরকারের আমলেই যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায় কার্যকর করা হবে। অর্থাৎ চূড়ান্ত রায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের এই কৌশলের পেছনে অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য জামায়াতকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির আন্দোলনে তারা সরাসরি যুক্ত হতে না পারলেও বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতÑ তাদের সবার আন্দোলনই একমাত্র সরকারের বিরুদ্ধে, সরকারকে অপসারণই তাদের লক্ষ্য। সুতরাং আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজনের যে কৌশলই সরকার নিক না কেন, সব আন্দোলনের স্রোত এক মোহনায় এসে মিশে যাবেÑ আর তা হবে সরকারের বিরুদ্ধে। 
প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেছেন, বাংলাদেশ হবে মিসর। আরব বসন্তের হাওয়ায় সিরিয়া, মিসরে কী ঘটছে, তা আমরা দেখছি। বসন্ত স্নান করছে রক্তবৃষ্টিতে। নীল নদে এখন প্রবাহিত হচ্ছে রক্তিম স্রোত। ফেরাউনের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে, মিসরেও বস্তুত শুরু হয়েছে। তবে দুই যুগ আগে আলজেরিয়ায় যে কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মিসরে। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে। প্রায় এক দশক ধরে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলে এবং দুই লাখ মানুষ নিহত হন। তবে মিসরে ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড এক বছর ক্ষমতায় ছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই এক বছরের মধ্যে তার সরকার বিধ্বস্ত মিসরের উন্নয়নে কোনো কাজই করতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছেÑ মুরসি সরকার কোনো কাজ করতে পারেনি, নাকি তার সরকারকে কাজ করতে দেয়া হয়নি? মুহাম্মদ মুরসিই মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের ওপর কি তার কর্তৃত্ব ছিল? এটি এখন স্পষ্ট যে, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনই মুরসি সরকারের দায়িত্ব পালনে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসি ও তার সরকারের একমাত্র অপরাধ তারা ইসলামপন্থী; যে কারণেই সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হলেও গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা ও আরব মিত্ররা তাকে সামরিক অভ্যুত্থান বলতে নারাজ। বরং বলছে, গণতন্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী জনগণের সহযোগিতায় কাজ করছে। গণতন্ত্র উদ্ধারে অভ্যুত্থান-উত্তর সরকারের যাতে কোনো অর্থকষ্ট না হয়, সে জন্য ওবামা সরকারেরই ইঙ্গিতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ১২ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে। সুতরাং মিসরে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা অনুমান করা যায়। সে গৃহযুদ্ধে আলজেরিয়ার মতো মিসরে কত মানুষকে প্রাণ দিতে হবে, তা আধুনিক মিসরের ফেরাউন জেনারেল আবুল ফাত্তাহ আল সিসি ও তার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোই বলতে পারবে। মিসরের সাড়ে আট কোটি জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ লোক ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে। গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য তাই আড়াই কোটির বেশি লোককে হত্যা অথবা দেশছাড়া করতে হবে। 
মুসা ভাইয়ের কথায় ফিরে আসিÑ কেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি মিসরের মতো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ আগস্ট আবারো বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তার সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতা-নেত্রীরাও একই কথার প্রতিধ্বনি করে আসছেন। আগামী নির্বাচনেও বাংলাদেশে মনমোহন সিংয়ের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার দেখার আকাক্সক্ষা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার উদ্বেগ ও খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে কথিত ইসলামপন্থীদের বিজয়ের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন ও তৎপর। অর্থাৎ বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের উত্থানেরবিষয়টি এখন কেবল দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় নজরদারিতে স্থান পেয়েছে। ধারণা করা যায়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক হলেও, চীনও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে টালমাটাল অবস্থা দেখে উৎকণ্ঠা বোধ করছে। কেননা চীন নীতিগতভাবেই সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা বা মন্তব্য করে না। চীনা রাষ্ট্রদূত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তিনি দুই প্রধান দলকে বৈঠকে বসানোর চেষ্টা করছেন। এর আগেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু চীন বা তার রাষ্ট্রদূত মুখ ফুটে কোনো কথা বলেননি। এখানে বলে রাখা দরকার যে, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক দিকে ভারত-মার্কিন অক্ষশক্তি, অন্য দিকে চীন নিজেদের অবশ্যম্ভাবী স্টেকহোল্ডার মনে করে। ইদানীং জাতিসঙ্ঘও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে ফোনালাপের সময়ও বান কি মুন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। 
শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদীরা যে কত মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রচার করে আসছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে যে তিন বছর বিদেশের মাটি চষে বেড়িয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল এই প্রচারণা। আর যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র, সেহেতু এসব দেশ গোগ্রাসে এ প্রচারণা গলাধকরণ করেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানেসহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছে। দীপুমনি তার এই কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে একাধিকবার বড়াইও করেছেন। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে প্রচার করা হয়েছে জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা হিসেবে। সরকার এই প্রচারণার মাধ্যমে এটিই প্রমাণ করতে চায়Ñ অনেকটা সফলও হয়েছেÑ যে অপরাজনীতিতে লড়াইটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ও মৌলবাদী শক্তির মধ্যে। আজ মিসরে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাই এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও মৌলবাদী শক্তির লড়াই। আমেরিকা ও তার মিত্রদের সহযোগিতায় ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী উৎখাত করেছে মৌলবাদী মুরসি সরকারকে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোটের প্রচারণার কৌশল হচ্ছে এক দিকে বহিঃশক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করা, অন্য দিকে অভ্যন্তরীণভাবে জনমত সংগঠিত করা। বাংলাদেশে জঙ্গিশক্তি তৎপরÑ এই প্রচারণা চালিয়ে তারা ভারত, আমেরিকা ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের খুশি করে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা করছে। আবার একই সাথে রয়েছে এই ইসলামপন্থী শক্তিকেই স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী বলে প্রচারণা চালিয়ে জনগণকে বিভক্ত করা। 
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই প্রচারণা কৌশলকে আরো জোরদার করা হবে। ইতোমধ্যে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের আবিষ্কার করা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের নেতা ও সদস্যদের গ্রেফতার করে মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, সরকারবিরোধী আন্দোলন যত ব্যাপক ও শক্তিশালী হবে; ততই এ ধরনের নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম প্রকাশ করা হতে পারে এবং গ্রেফতার দেখানো হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও আওয়ামী জোটের নেতা-নেত্রীরা তখন আরো জোর গলায় বলতে থাকবেনÑ বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা ক্ষমতায় গেলে দেশে জঙ্গিদের উত্থান ঘটবে, সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে প্রচার করার জন্য হয়তো আরো নানা কৌশল গ্রহণ করা হতে পারে। দেশকে ভয়াবহ সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্দেশ্যে যদি কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়, তা হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন, জামায়াত-শিবিরের অস্তিত্বের আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলন যদি একই সাথে তীব্র আকার ধারণ করেÑ আগামী দেড়-দুই মাসে তা হওয়াই স্বাভাবিকÑ তা হলে সে আন্দোলন আর নিয়মতান্ত্রিক থাকবে না, তা সহিংস রূপ লাভ করতে পারে। সরকার তার কৌশল বাস্তবায়নের জন্য এই আন্দোলনকে একাধারে জঙ্গি ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে দেশে ও বিদেশে প্রচারণা চালাবে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপির নেতৃত্বে জঙ্গি ও মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, এটি তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও জঙ্গিবাদবিরোধী দেশগুলোর কাছে প্রমাণ করাই হবে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। যদি প্রতিবেশী ভারতসহ এসব পশ্চিমা দেশের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হবে; তা হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তা হবে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিজেপি নেতা (ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী) অটল বিহারি বাজপেয়ি মন্তব্য করেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর (তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী) বাবা (জওয়াহেরলাল নেহরু) এক পাকিস্তান সৃষ্টি করেছেন, এখন তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) আরেক পাকিস্তানসৃষ্টি করছেন। এটি এখন আর কেবল বাজপেয়ির কথা নয়, এটি এখন ভারতের সব নেতা-নেত্রীর মনের কথা। পশ্চিমে এক পাকিস্তান আছে, পূর্বে আরেক পাকিস্তানহবে, এটি ভারত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads