শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু


সমগ্র জাতি এখন বিস্ময়ে বিমূঢ়। প্রধানমন্ত্রী আসলে কি চাচ্ছেন? দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ যেখানে তত্ত্বাবধায়ক অথবা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে সেখানে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন করার জন্য একগুঁয়েমির সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকদিন আগে সচিবদের বৈঠকে তিনি যা বলেছেন তারপর নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে, আওয়ামী লীগের কোন কথা থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে আগামী ২৭শে অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৪শে জানুয়ারী পর্যন্ত এই ৩ মাস জাতীয় সংসদ বহাল থাকবে ঠিকই, কিন্তু তার কোন অধিবেশন বসবে না। বর্তমান মন্ত্রীসভা বহাল থাকবে ঠিকই, কিন্তু তার আকার ছোট হবে। মন্ত্রীসভা নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। তারা শুধু রুটিন কাজ সারবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দেননি অথবা কোন তফসিল ঘোষণা করেন নি, তৎসত্বেও তিনি যে পরোক্ষ ভাবে একটি নির্বাচনী সূচি দিয়েছেন সেটা বুঝতে আর ভুল হয় না। অবশ্য নির্বাচনের তারিখ বা তফসিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করার কথা নয়। এটি ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২৭ শে জানুয়ারী। সুতরাং বর্তমান সরকারের মেয়াদও কোন অবস্থায় ২৭ শে জানুয়ারি পার হতে পারবে না। এই পটভূমিতে বর্তমান সংসদকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অকার্যকর রাখার সিদ্ধান্তে এটি ধরে নেয়া যায় যে, ২৪ শে জানুয়ারী বা তার আগেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কারণ এই সরকার কর্তৃক আনীত পঞ্চদশ সংশোধনী মোতাবেক মেয়াদ অবসানের কারণে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয় তাহলে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। আর মেয়াদ শেষ হওয়া ব্যতীত অন্য কোন কারণে যদি সংসদ ভেঙ্গে যায় তাহলে ভেঙ্গে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এখন মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৩ মাস সংসদকে অকার্যকর করার ফলে ধারণা করা যায় যে উক্ত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রশ্নে কোন দ্বিমত থাকার কথা ছিল না। কিন্তু ঝামেলা হয়েছে আরেকটি বিষয় নিয়ে। যেহেতু নির্বাচন কালে সংসদ বহাল থাকবে তাই এমপিরা এমপিই থাকবেন আর মন্ত্রীরা মন্ত্রী থাকবেন। কোন ব্যক্তি এমপি থাকা অবস্থায় আবার ঐ একই পদ অর্থাৎ এমপি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কিভাবে ? মন্ত্রীরা মন্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কিভাবে ? প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কিভাবে ? যারা “খবাবষ চষধুরহম ঋরবষফ” বলে গতবার প্রচুর নসিহত করেছিলেন সেই আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন খামোশ কেন ? তারা বড় দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য বার বার বলে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকা, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতগণকে পাত্তাই দেননি। বিদেশী রাষ্ট্র সমূহ চেয়েছিলো যে সব দলের অংশগ্রহণে এবং সব দলের সমান সুযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের এই কথারও কোন মূল্য দেননি শেখ হাসিনা। কিন্তু এসব কোন কথাতেই এবং কোন সুপারিশকেই আমলে নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নির্বাচন করবেন পঞ্চদশ সংশোধনীর অধীনেই। সেজন্যই তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশন ২৭ শে অক্টোবর থেকে ৩ মাসের জন্য বন্ধ রেখেছেন।
॥দুই॥
প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার ফলে বিএনপির সমস্ত আশা ভরসা নস্যাৎ হয়ে গেলো। সরকার কিছুটা ছাড় দিতে পারে, এই আশায় বিএনপি এবং তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজপথের সমস্ত আন্দোলন স্থগিত রেখেছেন। এই দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারকে তিনি একাধিকবার সময় দিয়েছেন। সেই ২০১০ সালে সরকারকে দেয়া ২ মাস সময়ের মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া ক্ষমতাসীন সরকারকে ছাড় দেয়া শুরু করেন। সর্বশেষ বলা হয়েছিলো যে, ঈদুল ফিতরের মধ্যে যদি সরকার দাবি দাওয়া মেনে না নেয়, তাহলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ঈদুল ফিতর চলে গেছে। কোন আন্দোলন গড়ে ওঠা তো দূরের কথা, বিএনপির তরফ থেকে একটি হরতালও অনুষ্ঠান করা হয়নি। অতঃপর পুনরায় সময় দেয়া হয়েছে ঈদুল আযহা পর্যন্ত। এর মধ্যে দাবি না মানলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে আবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এবারে এ সময় দেয়ার ৩-৪ দিন পরেই আওয়ামী সরকার তার কড়া উত্তর দিয়েছে। তারা বিএনপির দাবি এবং সময় সীমা তাৎক্ষণিক ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপি তথা ১৮ দলের এই দাবির জবাবে ৩ মাসের জন্য সংসদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, সরকার শুধুমাত্র রুটিনে কাজ করবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি টাকায় হেলিকপ্টারযোগে নির্বাচনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি নির্বাচনী বিধির মারাত্মক লঙ্ঘন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সরকারের একশত ভাগ তল্পিবাহক। সরকারের অঢেল পয়সায় হেলিকপ্টারযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচারণাকে নির্বাচন কমিশন এই বলে জাস্টিফাই করছেন যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে মন্ত্রীদের চলা ফেরার ক্ষেত্রে নির্বাচনী আচরণ বিধি প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং এই সরকারকে আর পায় কে। এখন তারা রাষ্ট্রীয় ফাংশনে গিয়ে ফ্রি স্টাইলে কথা বার্তা বলা শুরু করেছেন।
এদের মধ্যে সকলকে টেক্কা মেরেছেন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। গত ৬ ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ইংরেজী দৈনিক নিউ এজে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক তিনি বলেছেন যে, “দেশের যত গণ মাধ্যমের মালিক রয়েছেন তারা সকলে লুন্ঠিত অর্থ দিয়ে এসব গণ মাধ্যমের মালিক হয়েছেন। তারা দেশে অস্থিতিশীলতা দেখতে চায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষে টেক্সটাইলস ও গার্মেন্টসের ওপর অনুষ্ঠিত তিনটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী বক্তৃতায় বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তার স্বাভাবিক বক্তৃতা থেকে বিচ্যুত হয়ে অকস্মাৎ গণ মাধ্যমের ওপর আক্রমণ চালান। তিনি বলেন, গণ মাধ্যমের এসব লুটেরা মালিক দেশে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। তাই আজ আর দেশে গণ মাধ্যমের স্বাধীনতার কোন প্রয়োজন নাই।” লতিফ সিদ্দিকীর এই কথাকে হালকা ভাবে নেয়ার কোন উপায় নাই। তিনি কয়েক ডজন মন্ত্রীর মধ্যে যদি অন্যতম মন্ত্রী হতেন তাহলে তার বক্তব্যকেও হয়তো উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য। আর প্রেসিডিয়াম হলো যে কোন দলের সর্বোচ্চ স্তর বা নীতি নির্ধারণী বডি। সেই প্রেসিডিয়াম মেম্বার হলেন লতিফ সিদ্দিকী।
লতিফ সিদ্দিকীর এই বল্গাহীন উক্তি এটিই প্রথম নয়। ইতোপূর্বে মাত্র কয়েকদিন আগে সম্ভবত শেখ মুজিবের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে বাংলা চীন মৈত্রী সমিতির হলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় চরম উস্কানি মূলক বক্তব্য দেন এই মন্ত্রী। তিনি ঐ সভায় বলেন যে, হরতাল রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। কাজেই যারা হরতাল করে তাদেরকে ঘরে ঘরে যেয়ে হত্যা করা উচিৎ। এই কাজটি করার জন্য তিনি যুবলীগের কর্মী বৃন্দকে উস্কে দেন। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, যে সভায় তিনি এই বক্তৃতা করেন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ রক্তপাত ঘটানোর এমন উস্কানি মূলক আহ্বানের পরেও প্রধানমন্ত্রী একটি কথাও বলেননি।
ইনিই সেই লতিফ সিদ্দিকী যিনি মাত্র কয়েক দিন আগে আরেকটি সভায় বাংলাদেশের গর্ব, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী ইউনূসকে জেল খানায় ভরতেন। ঐ একই সভায় তিনি তার আপন ভাই কাদের সিদ্দিকীকে রাজাকার বলে অভিহিত করেন। অথচ সেই কাদের সিদ্দিকীই হলেন বঙ্গবীর। লতিফ সিদ্দিকী কিন্তু বঙ্গবীর নন। মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর বীরত্ব গাঁথা উপাখ্যানের মতো ছড়িয়ে আছে সারা বাংলায়। এসব লোককে যখন রাষ্ট্রদ্রোহী এবং রাজাকার বলা হয় তখন তাৎক্ষণিক উত্তেজনার বশে বলা হয় বলে মনে হয় না। এসবের পেছনে নিশ্চয়ই কোন গভীর দূরভিসন্ধি রয়েছে।
॥তিন॥
কি সেই গভীর দূরভিসন্ধি ? সেই দূরভিসন্ধি বুঝতে হলে লতিফ সিদ্দিকীর একটি উক্তি খেয়াল করতে হবে। তিনি বলেছেন যে, আজ আর দেশে গণ মাধ্যমের স্বাধীনতার কোন প্রয়োজন নাই। এ কথাটি তিনি মুখ ফস্কে বলে ফেলেছেন বলে মনে হয় না। তার এ কথার সাথে যদি নির্বাচন সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ সমূহকে যুক্ত করা যায় তাহলে তাদের মতলব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। জাতীয় সংসদকে বহাল রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রী যে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন  সেই নির্বাচনে যে বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোট যুক্ত হবে না, সেটি প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানেন। তার পরেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে অনড়। এর একটি মাত্র কারণই আছে বলে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহ করছেন। আর সেটি হলো, শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ধীরে ধীরে এক দলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার সমস্ত আলামত এখন স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। সমস্ত ইসলামী দলকে অতিরিক্ত আইজি শহীদুল হকের মাধ্যমে ঢালাও ভাবে জঙ্গি বলে অপবাদ দেয়া হয়েছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এভাবে বলতে গেলে প্রায় সমস্ত বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করা অথবা বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোকে দেশে আসতে দেয়া হচ্ছে না। এলেই তাদেরক গ্রেফতার করা হবে। বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। সরকার চায়, কোন না কোন বাহানায় বেগম জিয়াকে শাস্তি দেয়া এবং নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা।
এসব করে তারা এমন একটি নির্বাচন করতে চায় যেখানে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া যাবে। আর নির্বাচনে জিতে বিএনপির ওপর আরও দমন নীতি চালানো হবে। এভাবে দলটি যখন নিবীর্য হয়ে পড়বে তখন দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করা হবে। এই পরিকল্পনা ধরেই এগোচ্ছে সরকার। তবে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে গেছে বলে তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে মাত্র। অন্যথায় আর সব কিছু ঠিক আছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads