শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

আজ জেগেছে সেই জনতা


সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত ১৩ আগস্ট এক জলসায় তার বয়ানে বলেছেন, ‘নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি হলে বিরোধী দলের কোনো লাভ নেই। সংবিধানে সুস্পষ্ট লেখা আছেÑ প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই পদে বহাল থাকবেন।বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নাসিম এ ক্ষেত্রে সংশোধিত বর্তমান সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদভুক্ত ৩ নম্বর উপধারার কথাই সম্ভবত বলতে চেয়েছেন। খুব ভালো বয়ান, তবে বিরোধী দলকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা লম্বা করার এই সংবিধানসম্মত যুক্তি আরো বেশি আছে বর্তমান সংবিধানে। যাতে উনি আরো বেশি খুশি হবেন। ৫৮ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারায় বলা হয়েছেÑ ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় যে কোন সময় কোন মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের (১) দফার (ক) (খ) ও (ঘ) উপ-দফার কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।আরো পুলকিত হওয়ার মতো বিধিও আছে, ৫৮ অনুচ্ছেদের ৫ উপধারায় আরো স্পষ্টÑ এই অনুচ্ছেদে মন্ত্রী বলতে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কী আনন্দ ঘরে ঘরেÑ মহান রাজার ঘরেÑ কাঁসর বাজে সইগোÑ মাদল বাজে সইগো...। একেবারে নির্ভেজাল ডিজিটাল বাকশাল। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মাত্র ১৩ মিনিটে ক্ষমতা সীমাহীন এবং বিরতিহীন করার প্রক্রিয়ায় সংবিধানকে মনের মতো করে সাজিয়ে চূড়ান্ত করেছিলেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন সেই প্রক্রিয়ায় মোহাম্মদ নাসিমের বাবা মরহুম এম মনসুর আলীও ছিলেন। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হলেন, জনগণের সরাসরি ভোটদানের মতো ভোটে এটা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হলো। সংসদ, মন্ত্রিসভা, রাষ্ট্রপতি একই স্বপ্নিল ভোটের রায়ে বর্ধিত মেয়াদ পেল। বাকশাল নামের একমাত্র দল গঠন করা হলো মরহুম শেখ মুজিবকে প্রধান করে। নিষিদ্ধ করা হলো অন্য সব রাজনৈতিক দল। বন্ধ করা হলো সব সংবাদপত্র, শুধু চারটি ছাড়া। তখন কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল কিংবা রেডিও স্টেশন কিংবা অনলাইন সংবাদ সংস্থা ছিল না। ছিল না কোনো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকার ইত্যাদি। যদি থাকত একই পরিণতি হতো নিঃসন্দেহে। রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ সেদিন নিজের আত্মহত্যাও মেনে নিয়েছিল, বিলুপ্ত হয়েছিল দলটি। আর স্বপ্নপুরুষের মতো আরাধ্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবর্তন করলেন। মোহাম্মদ নাসিমের আজকের বয়ানে সে রকম একটা দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কারণ রাতারাতি জায়গা দখল করে চিত্তসুখের বিলবোর্ডগুলো আবার রাতারাতি চোরের মতো করে নামানো হলেও একটা জিনিস কিন্তু আঁচলে বাঁধা চাবির গোছার মতো করে ঘোরানো হচ্ছে মাঝে মধ্যেই ভিশন-২০২১। মোহাম্মদ নাসিমেরা সেই চাবির গোছার ঘূর্ণনে আবর্তিত হচ্ছেন পরম সুখের আবেশে। আবেশ কেটে গেলে দেখবেন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি বয়সী আওয়ামী লীগ এখন ক্ষয়িষ্ণু, মৃতপ্রায়। অথর্ব, যার কোনো কর্মক্ষমতা নেই, অন্যের সাহায্য নিয়ে সরকার ও দল চালাতে হয়। কচিকাঁচা খুঁজতে হয় নীতিনির্ধারণী ফোরাম সাজাতে; কমিউনিস্টরা টর্চ না জ্বালালে পথ চলতে পারে না। ১৯৭২-১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জবাই করে, গুলি করে হত্যার প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নকারী গণবাহিনীর নেতারাও এখন আওয়ামী লীগের এবং সরকারের ভরসাস্থল। মাইকের সামনে দিনরাত রাজাকারকে শাপশাপান্ত করে ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে রাজাকার পরিবার ছাড়া কাউকে পছন্দ হয় না। ধর্মনিরপেক্ষ ভান ধরে দল এবং সরকারে সারাক্ষণ আওয়াজ তোলে আবার স্বীকৃত অঙ্গসংগঠন হয় আওয়ামী ওলামা লীগ। পারিবারিক উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব ছাড়া কাউকে আস্থায় আনা যায় না আবার তাদেরকে একমাত্র বাংলাদেশী নাগরিকও বানানো যায় না। মাঝে মাঝে দেশে এলে প্রত্যাবর্তন দিবস হয়, না হলে সারা বছর পালন দিবস’-এর ক্যালেন্ডারে তো কয়েকটা তারিখ ফাঁকা থেকে যায়। আর এই প্রত্যাবর্তন ও বিতৃষ্ণায় ভরে যায় অপ্রয়োজনীয়, হালকা রাজনৈতিক কথাবার্তার কারণে। তবুও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একান্ত বলয় (কিচেন ক্যাবিনেট)-এর সদস্য হওয়ার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হচ্ছে আমূল আনুগত্য। উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া অসংখ্য তারবার্তার সুনির্দিষ্ট একটি সঙ্কলন হচ্ছে প্রথমা প্রকাশনকর্তৃক সঙ্কলিত গ্রন্থ উইকিলিকস-এ বাংলাদেশ’, যেখানে কনফিডেনসিয়াল শ্রেণীর এক তারবার্তায় ঢাকা থেকে জেমস এফ মরিয়ার্টি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে জানানÑ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে পরামর্শ নেয়ার ক্ষেত্রে পুত্র জয়ের চেয়ে বোন রেহানার ওপরই নির্ভরশীল বেশি। তার পুত্র দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন বলে অতিমাত্রায় আমেরিকান হয়ে গেছেন, যার পক্ষে বাংলাদেশকে বোঝা কঠিন বলে বিশ্বাস। আবার হাসিনা ও রেহেনা উভয়েরই দীর্ঘ দিনের আস্থাভাজন ব্যক্তি মি. গওহর রিজভী। হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্টে (কেএসজি) জয়ের ভর্তিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০৭ সালে জেনারেল মইনের হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতা দান এবং মইনের সাথে জয়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করেন, যার ফলে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা মুক্তি পান। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটনে হাসিনা ও রেহেনার সাথে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গোলাম কাদের ও হোসেন জিল্লুরের সাথে সাক্ষাৎকালেও গওহর রিজভী উপস্থিত ছিলেন। নিরাপত্তা বিষয়ে এবং ভারত-বাংলাদেশবিষয়ক ক্ষেত্রেও গওহর রিজভী একান্ত বিশ্বস্ত। রিজভী এক সময়ে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে তার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক রয়েছে। আবার দুর্নীতিবাজ হিসেবে খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও এইচ টি ইমাম একজন বিশ্বস্ত উপদেষ্টা। সৈয়দ আশরাফ অত্যন্ত বিশ্বস্ত। মইন-ফখরের সময় হাসিনার কারাবন্দীকালীন দলের ঐক্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে আশরাফের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশ্বস্ত তালিকায় রয়েছেন মতিয়া চৌধুরী। কনফিডেনসিয়াল তারবার্তায় অবিশ্বস্তদের বিতাড়ন কলামে বলা হয়েছে, অনড় আনুগত্য প্রদর্শন না করার কারণে আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। আসাদুজ্জামান নূর ও সাবের হোসেন চৌধুরীকেও নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। একই শ্রেণীর তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি মন্তব্য করেছেনÑ মনোনীত উপদেষ্টাদের দেখে মনে হয় ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এমনকি অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যতই তার প্রারম্ভিক চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে ততই মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য হাসিনা যে স্বপ্ন দেখেন, তা বাস্তবায়নের জন্য তার প্রতি আনুগত্যই যথেষ্ট হবে না। এত দিন পর তাই কি প্রমাণ হচ্ছে না প্রতি পদে পদে? যোগাযোগ, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, সেচ মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, অর্থ, আইন ও বিচার, নৌপরিবহন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট? আর তাই কিছু হলেই তা বিরোধী দলের দোষ। শেয়ার মার্কেট, কুইক রেন্টাল, ডেসটিনি, হলমার্ক, কালো বিড়াল, পদ্মা সেতু, জিএসপি বাতিল, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, সাগর-রুনি হত্যা, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য গুম, হত্যা সব দায় বিরোধী দলের। এমনকি মওসুমি মেঘের বজ্রপাতে কারো মৃত্যু হলেও নাকি দায় বিরোধী দলের। যা কিছুই হারায় গিন্নি বলেন কেষ্ট বেটাই চোর। আর কিছু না পারলেও মহাজোটের মন্ত্রী-নেতারা দলনেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রমাণে মহাতৎপর। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার দৌড়ে বিশ্বসেরা দৌড়বিদ উসাই বোল্টও বোধহয় হার মানবেন। আর এতে নিগৃহীত, ত্যক্ত-বিরক্ত জনগণ, তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় নিঃশঙ্কচিত্তে মুক্ত পরিবেশে তাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের। সেটাতে ভাটির টানে নৌকা যে কোন চোরাবালিতে আটকে যাবে, সে আশঙ্কায় মোহাম্মদ নাসিমরা এখন বর্তমান সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানোর মতো দাম্ভিক স্বপ্নও দেখছেন। ভালো, স্বপ্নে বিরিয়ানি খেলে কেউ তো আর বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। তবে বাস্তব বড় নির্মম। অসংখ্য উদাহরণ দেশে এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিশেষ করে বয়সে বুড়ো আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা তো সঙ্গত কারণেই বেশি। বর্তমান আওয়ামী ইচ্ছা পূরণের সংশোধিত সংবিধানেও কিন্তু ৭ অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছেÑ প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসন সকল ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশ নেয়া নিশ্চিত হবে। সুতরাং ডিজিটাল কায়দার বাকশাল প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্ন দেখবেন না। পরিণতি শুভ হয় না। অতীতে হয়নিÑ ভবিষ্যতেও হবে না। ১৯৬৯-এ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। প্রায় ১১ বছর দাপটের সাথে ক্ষমতায় থেকে বিদায়ী ভাষণে বলতে বাধ্য হয়েছিলেনÑ 'I can't preside over the Destruction of Democracy of my Country.' ঠাণ্ডা মাথায় তাকান দেশের দিকে, দেশের মানুষের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন, রক্ষা করুন সংবিধানের রক্ষকের দায়িত্ব। ভক্ষক হলে বেজে উঠবে সেই দ্রোহী গণসঙ্গীতÑ ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারাÑ আজ জেগেছে এই জনতা 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads