রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ভারতের নতুন প্রতিবেশী তত্ত্ব


ভারতীয় অর্থনীতির ওপর বিরাজমান কালোছায়া এবং রাজনৈতিক ডামাডোল  আমাদেরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছে যে, উপমহাদেশীয় একান্ত প্রতিবেশী দেশসমূহে চলমান অদৃষ্টপূর্ব ঝঞ্ঝা’র দিকে তাকানোর সুযোগও  আমরা পাচ্ছি না।
বিপুল সংখ্যক সাধারণ তথা তুচ্ছ (ড়ৎফরহধৎু) বাংলাদেশী  সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার দাবিতে ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছে। এর জবাবে ইসলামী জঙ্গিরা হিংসাত্মক ভীতি ছড়িয়ে প্রতিশোধের অভিযানে নেমেছে । অন্যদিকে তাদের পাকিস্তানী দোসররা সব সংখ্যালঘুর ওপর আরেকটি গণহত্যা চালানোর মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে, যেখানে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা অবিরাম আক্রমণের শিকার। শ্রীলংকা সরকার তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সামরিক বিজয়ের পর দ্বীপটির তামিল জনগণকে রাজনৈতিক আত্তীকরণের উদ্যোগ গ্রহণের কোন সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না । মালদ্বীপে অবৈধ শাসকচক্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করেছে।
মনে হয় ভারতের এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা নেই যে উপমহাদেশে তার স্বার্থ রক্ষার্থে তাকে কোন কাজটি অবশ্যই করতে হবে। অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে যদি মালদ্বীপের দ্বিধাগ্রস্ত শাসকচক্র নতুন দিল্লীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল  করে কিংবা আমাদের  কূটনীতিকদের সাথে যে  বোঝাপড়া করেছিল তা হতে সরে দাঁড়ায় । আরো ক্ষতি হতে পারে যদি বাংলাদেশের আন্দোলনরত বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সফররত ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সাথে পূর্ব-নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন। (নিতিন পেই’এর এ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, ৭ মার্চ (২০১৩), আর ভারতীয় প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি তিনদিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন পরের দিন (৮ মার্চ)। বেগম জিয়া প্রণবের সাথে তার বৈঠক বাতিল করেন।) এগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভ্রান্তি, কূটনৈতিক ব্যর্থতা কিংবা আমলাদের অদক্ষতার হেতু হিসেবে বিবেচনা করা যথার্থ হবে না,  যদিও নতুন দিল্লী এসব হতে পুরোপুরি  মুক্ত হতেও পারবে না।
বাস্তবে নতুন দিল্লীর প্রতিবেশীদের সাথে বোঝাপড়ার নীতি-কৌশল বেশ কিছু সময় থেকে কার্যকর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। সত্তর দশকের ইন্দিরা ডক্ট্রিন বহির্শক্তির সাথে মিত্রতা স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোকে বারণ করতে চেয়েছিল। এ ডক্ট্রিন ১৯৯০-এর দশকে গুজরাল ডক্ট্রিনের সূত্রপাত ঘটায়, যা সামঞ্জস্যবিহীন ‘ছাড়’ এবং একে অপরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও  সমঝোতা অর্জন সম্ভব বলে মনে করে।  ২০১০ সনের মধ্যে ভারত তার ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীদের, এমনকি ক্ষুদ্রতম প্রতিবেশীদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে তাদের সাথে  সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়।
ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বীকৃতি প্রদান একটি উত্তম পদক্ষেপ, যার প্রেক্ষিতে আমাদের সার্বভৌম প্রতিবেশীরা আঞ্চলিক  শক্তিগুলোকে ব্যবহার করবে তাদের জাতীয় স্বার্থকে ত্বরান্বিত করতে। অবশ্য নতুন দিল্লী নব-পর্যায়ে এর নিজস্ব উপমহাদেশীয় নীতি-কৌশল নির্ধারণ করেনি। আমাদের প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আমাদের সামনে একটি নতুন ডক্ট্রিন থাকা জরুরি। তেমনি একটি রূপরেখা নিম্নরূপ হতে পারে।
প্রথমত: ভারতকে অবশ্যই এর  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি অব্যাহত রাখতে হবে যাতে ভারত উপমহাদেশের  অর্থনীতির চালিকাশক্তিরূপে তার অবস্থান অক্ষুণœ রাখতে পারে। তাকে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দ্বার অবশ্যই উন্মুক্ত রাখতে হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের সম্পদ বৃদ্ধিকরণ, প্রেষণা প্রদান এবং রাজনৈতিক মোড়ল তথা এলিট (বষরঃবং) শ্রেণী ও সাধারণ মানুষ ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। এমন প্রত্যাশা একটি প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতির অনুকূলে অনুপ্রেরণা যোগাবে এবং যা সমৃদ্ধির এমন একটি কার্যকর অনুপ্রেরণাময়ী সুযোগ হিসেবে  আবির্ভূত হবে, যেটি স্বভাবত আরও ব্যাপকভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আবেদনময়ী আবহের উন্মোচন ঘটাবে। ভারতের সাথে ব্যবসা করে আপনি যদি সমৃদ্ধি অর্জন করতে থাকেন তাহলে আপনি অবশ্যই চাইবেন না আপনার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি স্লথ হয়ে যাক।
দ্বিতীয়ত: ভারতকে অবশ্যই লজ্জার হেতু থাকা সত্ত্বেও নির্লজ্জভাবে প্রতিবেশী দেশসমূহের ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহকে এমনভাবে সমর্থন-সহযোগিতা প্রদান করতে হবে, যাতে ভারত-বিরোধী দলগুলো তাদের অবস্থান ধরে রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে । অবশ্য এমন কিছু ভারত-বিরোধী থেকেই যাবে, যাদেরকে ভারত-বিরোধিতা হতে ফেরানো যাবে না। তথাপি নতুন দিল্লী  যদি বিরতিহীনভাবে ভারতপন্থীদের প্রতি সমর্থন-সহযোগিতার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখে, তবে ভারতের বশে আসে না, এমন দলগুলো তাদের কোন অনুসারীই খুঁজে পাবে না এবং সেগুলো দুর্বল হতে হতে প্রান্তিক সীমানায় পৌঁছবে। ভারতপন্থী দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদেরকে রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করতে হবে এবং ক্ষমতা গ্রহণে সক্ষম হলে পুরস্কার হিসেবে তাদের অনুকূলে সার্বিক ক্ষেত্রে ‘ছাড়’ দিতে হবে।
এ ডক্ট্রিন আগে থেকেই প্রয়োগ করা হলে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করাকে নতুন দিল্লী এতো সহজে নীরবে সয়ে যেতো না । এবং তা হলে জিএমআর গ্রুপকে বিমান বন্দর চুক্তি হারানোর প্রক্রিয়া প্রতিহত করা যেতো। যদি এটা এখানো প্রয়োগ করা হয়, যা অবশ্যই করা উচিত, তা হলে নতুন দিল্লী ওয়াহিদ চক্রের কাছে দাবি করতে পারে যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নাশিদকে তার ক্ষমতায় পুনঃস্থাপিত করা হোক।
এ ডক্ট্রিন আরো ইঙ্গিত দেয় যে, ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানকে জোরদার করতে  ২০১১ সনের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ট্রানজিটের বিনিময়ে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন-সংক্রান্ত চুক্তির মাধ্যমে অসাধারণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সত্যি কথা বলতে কি ইউনাইটেড এ্যালায়েন্স প্রগ্রেসিভ সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলেও এটা চালিয়ে নেয়ার মতো উদ্যোগ নেয়নি।
শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সঙ্কটের দুঃসময়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফর শেখ হাসিনার জন্য বিরাট সহায়ক ছিল। ভারতকে এখন অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে  নেতৃত্ব দিতে হবে  এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কাছে এ মর্মে বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে হবে যে, এর সদস্যরা আরো একবার মানুষ হত্যা করে সট্কে পড়তে পারবে না।
জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ, বেলুচিস্তান কিংবা সিন্ধুর চেয়ে পশ্চিম এশিয়া যেকোন কারণেই হোক অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ভারত নেতৃত্ব গ্রহণ না করলে এসব অঞ্চলের কোনটির ব্যাপারেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন ধরনের উৎসাহ দেখাবে না।
এ ডক্ট্রিন কিংবা অন্য যে কোনো ডক্ট্র্রিনের সাফল্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওপর। (তা বিঘিœত হলে, অর্থাৎ) সাম্প্রতিকতম এবং পরিকল্পিত (projected) ৫% প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হলে কৌশলগত বিষয়গুলো বাস্তবায়িত করার  জন্য মারাত্মক দুশ্চিন্তার কারণ সৃষ্টি হতে পারে। প্রবৃদ্ধি হোঁচট খেলে নতুন দিল্লী অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী অন্যান্য শক্তির কাছে তার উদ্দেশ্য পূরণের শক্তি হারাতে শুরু করবে, যা প্রতিবেশী ওয়াহিদদের কিংবা খালেদা জিয়াদেরকে ভারতের অভীষ্ট লক্ষ্যকে  মোকাবেলা করতে প্রলুব্ধ করতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads