শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কোথায়ও আলোর রেখা নেই

ইংরেজি প্রবাদ অনুসারে আমাদের দেশেও একটি কথা এখন খুব প্রচলিত হয়ে গেছে। সেটি হলো, ‘সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে আলোর রেখা।খবরের কাগজগুলো শিরোনাম করে, সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে আলোর রেখা দেখা যায়। কখনো তারা আলো দেখেন। কখনো ওই প্রান্তে একেবারেই গাঢ় অন্ধকার দেখেন। শাসকশ্রেণী জনগণের আলো-অন্ধকারের তোয়াক্কা করে না। জনগণের ভোটেরও তোয়াক্কা করে না। তারা এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে, জনগণ ভোট দিক বা না দিক ক্ষমতায় তারা থাকবেই। বিশ্বব্যাপী স্বৈরশাসকেরা একইভাবে চিন্তা করে এবং প্রায় একইভাবেই তাদের পতনও ঘটে। আমাদের দেশের আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এমনি শত কথা চালু আছে। সরকার বলছে, সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ও তত্ত্বাবধানে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন আজব কথা গণতন্ত্র-অগণতন্ত্র কোনো সমাজেই কেউ কোনো দিন শোনেনি। প্রধানমন্ত্রী যা বলছেন তার পারিষদবর্গ বলছেন তার শতগুণে। কিন্তু এসবের পেছনে জনগণ যে একটা ফ্যাক্টর, সেটি কেউ বিবেচনায় নিতে চাচ্ছে না। আজব সব কথাবার্তা চার দিকে হচ্ছে। কোন কথা থেকে কোন কথা বলি, মেলাতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বলেন নির্বাচন হবে না, বর্তমান সংসদই অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে, তা হলে তার পারিষদবর্গও একেবারে যে একই কথা বলতে থাকবেন, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মন্ত্রী-এমপিদের কথা বাদই দিলাম, অমনি অনির্বাচিত স্পিকার বলে বসলেন, ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় সংসদের স্পিকার শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠানও। তার নিজস্ব বিশেষ মর্যাদা আছে। ব্যক্তির না হোক, প্রতিষ্ঠানের সে মর্যাদা সংরক্ষণ করার মতো যোগ্যতা বর্তমান অনির্বাচিত স্পিকারের নেই বলে জনগণ মনে করতে পারে। থাকার অবশ্য কথাও নয়। কারণ জনগণের কাছে এই স্পিকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। ভোটের লড়াই যে কী কঠিন, সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। সংসদ সদস্য তিনি হয়েছেন মহিলাদের সংরক্ষিত কোটায়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন আর তিনি সংসদ সদস্য হয়ে গেছেন। বর্তমানে ভাগ্যগুণে স্পিকার। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর কথার বাইরে কিছুই বলার ক্ষমতা তার নেই। এমনকি আশঙ্কা হয়, সংসদ ভবনেও প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে চোখের ইশারা করেন, তা হলে বিরোধীদলীয় যেকোনো সংসদ সদস্যকে তিনি বক্তৃতার একেবারে মাঝখানে বসিয়ে দিতে পারেন। অতএব তাকে তো বলতেই হবে, ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচন কমিশন? বর্তমানে এর চেয়ে হাস্যকর প্রতিষ্ঠান বোধ করি দেশে আর নেই। দেশে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন নিজেদের অধিকতর স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তোলার কাজে নিয়োজিত রাখে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কাজী রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন যে নির্বাচন কমিশন রয়েছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিজেদের হাতে সংরক্ষিত ক্ষমতাটুকুও সরকারের পদতলে নিবেদন করে বসেছেন। অর্থাৎ ক্ষেত্রেও কমিশনের একটি জো হুকুমভাব। তাদের পাঁচজনের মধ্যে আবার খুব একটা সমন্বয় নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, কমিশন যেকোনো সময়ে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। আবার অন্য কোনো কমিশনার হয়তো বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা কঠিন ব্যাপার।কেউ কেউ এই কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন কেঁচোজাতীয় প্রাণী বলে অভিহিত করে থাকেন। জাতীয় নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। সংবিধানের ভেতরে যে কত রকম সংশোধনী আনা হয়েছে এ আমলে, তা শুমার করা কঠিন। জাতীয় সংসদে কত ধরনের আইন যে পাস হচ্ছে, জনগণ তারও কোনো খবর রাখে না। আবার সংসদে বসে সরকার কী আইন পাস করল, সেটি জানার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। অথচ এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সরকার ভারতের কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার জন্য একের পর এক গোপন চুক্তি করেছে। তারপর জাতীয় সংসদে আইন করেছে, রাষ্ট্র বিষয়ে সরকার কী চুক্তি করল-না-করল, সেটি সংসদ সদস্যদের জানার অধিকার নেই এবং সংসদেও তা পেশ করা হবে না। চার দশক আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহল বিনিময় এবং সীমান্ত চুক্তি করেছিলেন। বাংলাদেশ তার কথা রাখলেও ভারতীয় সংসদে আজ পর্যন্ত তা অনুমোদন হয়নি। ফলে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সাথে বহুবিধ গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রের মালিক যে জনগণ, তারা সে চুক্তির বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্বের মর্যাদা আছে কি নেই, সে সম্পর্কে জনগণ তো নয়ই, সংসদ সদস্যরাও কিছুই জানতে পারছেন না। আর যারা জনগণের ভোটেসংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই। তারা আছেন মারি তো গণ্ডার, লুটিতো ভাণ্ডার’Ñ নীতিতে। মনে হয়, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকল কি থাকল না, প্রণীত আইনের মাধ্যমে, তার নিজের অধিকারও কেড়ে নেয়া হলো কি হলো না, এসব নিয়েও কেউ কোনো চিন্তাভাবনা করছে না। কোনো আইন বা চুক্তি সম্পর্কে আজ পর্যন্ত সরকারি দলের কোনো সদস্যকে কিছুই জানতে চাইতে দেখলাম না। সবাই বোল্, হরি বোল্বলে করতালি দিলেন। কাগজ দিয়ে টেবিল পেটালেন। আর স্পিকার বললেন, তার মনে হয়েছে, ‘হ্যাঁজয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে, জয়যুক্ত হয়েছে।ব্যস আইন পাস হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন আর থাকে না। এই যে ভারতকে করিডোর দেয়া হলো, আর করিডোর দেয়ার জন্য তিতাস নদীর ওপর দিয়ে বাঁধ দেয়া হলো, জনগণের ভোগান্তি চরম হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনব্যবস্থা বিকল হলো, পরিবেশ হলো বিপর্যস্ত, জনগণ স্থানীয় এমপির কাছ থেকে তার কারণ জানতে পারেনি। সরকারও দায়িত্ব অস্বীকার করল। কে যে এখানে কবে বাঁধ দিলো, সরকারের যেন সেটা জানাই নেই, এমন একটা ভাব দেখা গেল। আর বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থা ও সড়কপথ ভেঙেচুরে একাকার করে ভারী যন্ত্রপাতি এই করিডোর দিয়ে নিয়ে গেল ভারত। বিনিময়ে কোনো মূল্য তো দিলোই না, ক্ষতিপূরণও না। সরকারের এক উপদেষ্টা বললেন, এর জন্য ভারতের কাছে মূল্য চাওয়া অসভ্যতা। তিনিও জনপ্রতিনিধি নন। তা হলে জনগণ তাকে সম্ভবত সভ্যতার বিষয়ে কিছুটা শিক্ষা দিয়ে দিতে পারত। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। লোক দেখানো হলেও বিরোধী দল অংশ নিক বা না নিক, সরকারকে একটা নির্বাচন করতে হবে। বিরোধী দল বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এর বিপরীতে সরকার যা করছে, তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। বিরোধী দল বলছে, যদি সরকার নিদর্লীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করে, তা হলে তারা লাগাতার হরতাল ও রাজপথ, নৌপথ, রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি দেবে। এখন সরকার আইন করার চেষ্টা করছে, কেউ যদি হরতাল ডাকে তা হলে ওই দলের প্রধানের পাঁচ বছর কারাদণ্ড হবে। কিন্তু জনগণ যদি হরতাল করে, তা হলে এই কারাদণ্ড দিয়ে তাদের রোধ করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে সরকার পুরো দেশটাকেই একটি কারাগার বলে ঘোষণা করতে হবে। বিরোধী দল তার অবস্থানে বরাবরই অনড় আছে। এ দিকে সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য আইনের পর আইন করছে। দুদক নামে এক প্রতিষ্ঠান আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন। অভিযোগ আছে, এই কমিশন সরকারের দুর্নীতি হালাল করে দেয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। আর বিরোধী দলের দুর্নীতিপ্রমাণের জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা করে না। কমিশন একেবারে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করে দিয়েছে এই সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। কালো বিড়ালের সুরঞ্জিতকে। আর এখন হলমার্কের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত প্রভাবশালীদের নাম বাদ দিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দিচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের ইচ্ছায় উঠ্বস্। নাম তো বাদ দেয়ারই কথা। আবুল হোসেনকে ডিফেন্ড করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। দুর্নীতির দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পর দিনই তাকে আবার দফতরবিহীন মন্ত্রী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। হলমার্ক দুর্নীতির সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে, এটা কোনো টাকাই না। কিন্তু মাঝে মধ্যে এরা বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে নিতান্তই ছোটগল্প ফাঁদেন। মাঝে মাঝে বলেন, কোকোর দুর্নীতির আট-দশ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়েছে। টাকা কোথা থেকে ফেরত এলো, সে টাকা কার, কোকোর সম্পৃক্তির প্রমাণ কী কিংবা সে টাকা কেমন করে দুদকের হিসাবে জমা হবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাদ দিয়ে, এর কোনো কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু বিরোধী দল বলে কথা। তাদের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন হয় না। সরকারি দলের লোক হলে, অল কিয়ার। এমনি এক পরিস্থিতিতে নির্বাচন এসেছে। বিরোধী দল বরাবর বলে আসছে, তারা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অধীনে নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। এ নিয়ে সংলাপে বসতেও রাজি। পরিস্থিতি জটিল দেখে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তি এবং এদের হাতের ক্রীড়নক জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে এসে হাজির হয়েছে। তারা আলোচনায় বসার প্রস্তাব করছে। তাদের আগ্রহ এত বেশি হওয়ার কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ মুসলমানপ্রধান দেশ। বিরোধী দল অবশ্য ঘর পোড়া গরু। আগের দফায় পাতানো নির্বাচনে গিয়ে তারা দেখেছে, পশ্চিমা দেশগুলোর এসব উদ্যোগ কতটা মতলবি। বর্তমান সরকারের দুঃশাসনে জনগণ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে আছে যে, তারা পারলে এদের এুনি তাড়ায়। জনগণের শক্তি বিশাল। দেশের বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, দেশের নব্বই ভাগ মানুষই চায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিরোধী দলের জন্য এটা বড় একটা শক্তি। এই শক্তি উপেক্ষা করে আপসের পথে যাওয়ার বোধ করি কোনো সুযোগ নেই। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads