শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা মেনে নিন

পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যত দিন রাজনীতি করি, গণভবনেই থাকব।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে অল্প দিন পরই এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। জনগণ আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড পছন্দ করেনি। এর প্রমাণ ২০০১-এর জাতীয় নির্বাচন। শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে জনগণ বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটকে নির্বাচিত করেছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে একদলীয়নির্বাচন করে ওই বছরের মার্চ মাসে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজন করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফলে ৯৬-এর জাতীয় নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দলের পরাজয় ঘটে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন দেখতে চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের বাইরে যাবেন না। তিনি গত ১৮ আগস্ট গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে। সংবিধান থেকে এক চুলও নড়ব না।আওয়ামী লীগের ডিগবাজি খাওয়া রাজনীতি যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ধার ধারে না, তা বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারা যায়। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলা বিহার উড়িষ্যা দখল করে নিলে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলার জনগণের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। তারা শিক্ষাদীক্ষা, জীবিকা ও ব্যবসায়, প্রশাসন ইত্যাদি সব বিষয়ে পিছিয়ে পড়ে। এসব কারণে রাজ্যহারা মুসলমানেরাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। এ অঞ্চলকে ঘোষণা করে দারুল হরববা যুদ্ধকবলিত এলাকা। এ কারণে মুসলমান মাত্রই ইংরেজদের চোখে ছিল বিদ্রোহী প্রজা। নদীবিধৌত এলাকা হওয়ায় অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে পূর্ব বাংলায় ইংরেজ আমলে উন্নয়নের ছোঁয়া খুব কমই লেগেছিল। কলকাতা-কেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুরা ইংরেজ তোষণ ও সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করে উঠে যায় সাফল্যের চূড়ায়। পূর্ব বাংলার গরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক প্রজাসাধারণ নেমে গেল অতলগহ্বরে। পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেয়াসহ প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বড় লাট লর্ড কার্জন বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিভাগ করে পূর্ব বাংলা ও আসামনিয়ে ১৯০৫ সালে গঠন করেন একটি নতুন প্রদেশ। ঢাকা হয় এ প্রদেশের রাজধানী। নতুন প্রদেশ গঠনের কারণে পৌনে দুই শবছরের ব্যবধানে ঐতিহ্যবাহী নগরী ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। মুসলমানেরা এ ঘটনাকে দেখে ভাগ্যোদয়ের প্রথম প্রভাতহিসেবে। তারা শোকরানা নামাজ পড়ে বাংলা ভাগের প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানায়। অন্য দিকে, কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা এ ঘটনাকে চিহ্নিত করেন জাতীয় বিপর্যয়হিসেবে। তারা বিরোধিতা করে স্লোগান দেনÑ ‘বন্দে মাতরম’, যা পরে সাম্প্রদায়িক তাৎপর্য পেয়েছিল। তারা বাংলা বিভাগকে চিত্রিত করে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদরূপে। শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ রদআন্দোলন, এর পুরোভাগে যেমন ছিলেন সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী, অরবিন্দ; তেমনি ছিলেন চরমপন্থী ুদিরাম, এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। ুদিরাম একজন পুলিশের মাথা ফাটিয়ে দেন। ১৯০৮ সালে ৩০ এপ্রিল ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে খুন করার জন্য বোমা মারলে নিহত হন গাড়িতে থাকা মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা। গান্ধী বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বিলাতি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভা। সে সভায় রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত গান আমার সোনার বাংলাপরিবেশন করে ঢাকা-কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলা ও আসামপ্রদেশের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। রাখি বন্ধন দিবসপালন করেন। আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এরপর ১৯৪৭। বাংলার হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের যুক্তির চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে। ১৯৪৭ সাল; ব্রিটিশ শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নামক দুটি রাষ্ট্রে রূপ নেবে। কলকাতা-কেন্দ্রিক কংগ্রেসি বুদ্ধিজীবীরা এবার ইউ টার্ননিয়ে স্লোগান দিলেনÑ ‘ভারত বিভাগ হোক বা না হোক বাংলা বিভাগ হতেই হবে।কোথায় গেল বঙ্গমাতার অঙ্গহানিতে ক্রন্দনরত সন্তানদের সেই কুম্ভিরাশ্রু? ‘টু-ন্যাশন থিওরিতে ভারত ভাগ হবে। স্থির হলো, রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় পরিচিতিতেই ওই রাজ্য ভারত না পাকিস্তান, কোন দেশের সাথে থাকবে সিদ্ধান্ত হবে। রাজ্যের বেশির ভাগ জনগণ যে ডোমিনিয়নে থাকতে চায়, ওই রাজ্য সেই ডোমিনিয়নভুক্ত হবে। সমস্যা দেখা দিলো কাশ্মির ও জুনাগড় নিয়ে। এই দুই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে সম্প্রদায়ের, রাজা সে সম্প্রদায়ের নন। সিদ্ধান্ত হলো, জুনাগড়ের রাজা মুসলমান হলেও যেহেতু এ রাজ্যের বেশির ভাগ প্রজা হিন্দু, সুতরাং জুনাগড় ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু কাশ্মিরের ব্যাপারে হিন্দু নেতারা তাদের এ যুক্তি মানেননি। কাশ্মিরের মহারাজা হিন্দু হলেও বেশির ভাগ প্রজা মুসলমান। সুতরাং কাশ্মির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। প্রতারণা ও গায়ের জোরে কাশ্মির দখল করে নেয় ভারত। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটে যাচাই হবে কাশ্মির কোন রাষ্ট্রের সাথে থাকবে। কিন্তু ৬৫ বছর পরও সেই গণভোট আর হলো না। যা হোক, ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে সংবিধান অনুসারে বিচারপতি কে এম হাসানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার প্রস্তুতি চলে। আওয়ামী লীগ বিচারপতি হাসানকে মানে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহম্মদ। আওয়ামী লীগ তাকেও মানে না। শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে, তারা পক্ষপাতদুষ্ট। অথচ সংবিধানে আর কোনো বিকল্পও নেই। আওয়ামী লীগ ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা বললেন, কিসের সংবিধান? জনগণের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। এটা এখন ডকট্রিন অব নেসেসিটি। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বলছেন, ‘তিনি সংবিধান মানেন, আদালতের রায় মানেন, এর বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।স্মর্তব্য, এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে ঢাকার রাজপথে লাঠি মিছিল হয়েছিল। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কাকে রং হেডেড লেডিউপাধি দিয়েছেন? যে রায়ের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছেন, সেই রায়েই বিচারপতি খায়রুল হক আরো দুবার সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। এখনো সময় আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জাতীয় দাবি মেনে নিন। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে একজনও কি বুদ্ধিমান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রাজ্ঞ লোক নেই যিনি তাদের নেত্রীকে দেশের আসন্ন বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিতে পারেন? সরকারের দুর্নীতি আর ব্যর্থতার কারণে এমনিতেই জনগণ ুব্ধ; তার ওপর তত্ত্বাবধায়কের মতো জাতীয় ইস্যু জনগণের ধৈর্যের অবসান ঘটাতে পারে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads