মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ঐশীদের মিছিল বন্ধ হোক

বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল, ঐশীর বাবা-মা নিহত হয়েছেন। আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-বিশ্লেষণের কশাঘাতে জর্জরিত ছিলাম আমি। ঘটনাটি প্রায় গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। জন্মদাতা বাবা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তাদেরই আত্মজা ঐশী রহমান। এ পর্যন্ত জানা মতে, এ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি ব্যক্ত করেছে ঐশী, অত্যন্ত সোজা সাপটাভাবে। সঙ্গী দুজন বন্ধুর কথা বললেও তাদের পুরোপুরি পরিচয় নিয়ে পুলিশ বিভাগ এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। এ ঘটনায় প্রতিটি মায়েরই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। যে মা ১০ মাস গর্ভে ধারণ করে তাকে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখিয়েছিলেন সেই মায়ের দেহেই সে অবলীলায় ১১টি আঘাত হেনেছিল। আর বাবাকে অপেক্ষাকৃত কম। তারা আজ নেই। ঘটনা বিশ্লেষণে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। এ লোমহর্ষক পৈশাচিক ঘটনার নৃশংস বর্ণনা যত কম হয় ততই মঙ্গল হবে। আমাদের ভাবতে হবে কেন এমন হলো? কেন এমন হচ্ছে? এ সীমাহীন ভীতি ও পাপের শুরু-ই বা কোথায় আর শেষ-ই বা কোথায়? এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের মতামত, চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর সুচিন্তিত অভিমত পড়েছি, জেনেছি। অনেকেই এ ভয়াবহ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার যৌক্তিক পথনির্দেশনাও দিয়েছেন। তবুও একজন মা হিসেবে আমার বুকের রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সর্বত্রই আজ ধ্বংসের সদম্ভ পদক্ষেপ, ভাঙনের শেষ দৃশ্যটি আমরা অবলোকন করছি। বিশ্বে মানব সৃষ্টির সাথে সাথেই সৃষ্টি হয়েছিল পরিবারতন্ত্র। জীবন আবর্তিত হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ছিল পরিবার। পরিবারের পরিধি বলতে ১০০ বছর আগেও মানুষ বুঝতো বাবা-মা, তাদের বাবা-মা ভাইবোন, বাবা-মায়ের ভাইবোন অর্থাৎ উভয় দিকের অধস্তন সবাইকে নিয়ে এক বিরাট অবকাঠামো। আরো থাকত দরিদ্র আত্মীয়স্বজন ও পোষ্য। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরাই জানত কে কেমন আছে। উপমহাদেশের হিন্দু মুসলিম সব পরিবারেই এই বন্ধন দৃষ্টিগোচর হতো। আর্থিক অভাব বিদ্যমান থাকলেও ভক্তি শ্রদ্ধা স্নেহ-মায়া মমতা ছিল বিদ্যমান। এসবের ছিল না কোনো কমতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাশ্চাত্য জগৎ তাদের পরিবারকে ভেঙে খান খান করে ফেলে, গড়ে তোলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা। ধ্বংস করে পারিবারিক বন্ধন। ঠিক সে হাওয়াতেই কিছু পরে হলেও ভেসে গেছে আমাদের যৌথ পরিবারব্যবস্থা। বর্তমানে বৃদ্ধ বাবা-মাও স্থান পান না সন্তানের পরিবারে। গত ৪০-৫০ বছরে আমাদের এ দেশের মানুষই একক পরিবার ব্যবস্থায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। বর্তমানে আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা একেবারেই নাজুক হয়ে পড়েছে। যে ঘটনাটি ঘটে গেছে বস্তুত তা আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়েরই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের ঐশীদের বাঁচাবে কে? এমন লাখ লাখ ঐশী লোকচুর আড়ালে সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনুভূত হয়। মেয়েদের চেয়ে বহুসংখ্যক বেশি ধ্বংস হচ্ছে আমাদের উঠতি বয়সের ছেলেরা। গোটা প্রজন্মই আজ রাহুগ্রস্ত। ঐশীদের এহেন অবস্থান বিশ্লেষণে কিছু অতি পরিচিত কারণ আমাদের সামনে ঘুরেফিরেই হাজির হয়। সে কারণগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বাবা-মায়ের সন্তান পালনের দায়িত্ব অসীম। জীবনের শ্রেষ্ঠতম বিনিয়োগ তার সন্তানের জীবনকে সার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। বর্তমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নি¤œবিত্তের সন্তানদের মধ্যে অভাবের কারণে নষ্ট হওয়ার উপকরণ কম; কিন্তু উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে এ উপকরণের কোনো হিসাব নেই। ঐশীর জীবন এর বাইরে নয়। এ পথেই সে ধ্বংসের পথে এগিয়েছে। প্রথমত একটি শিশু দুই-আড়াই বছর বয়স থেকেই বুঝতে শেখে পরিবারে তার অবস্থান কোথায়? অনেক পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য না থাকার কারণে এরা সময় কাটায় বাসাবাড়ির কাজের মানুষদের হাতে। বাবা-মায়ের অভাব তাদের শিশুমনকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। ফলে এরা হয়ে ওঠে অবাধ্য ও একগুঁয়ে। চাকরির তাগিদে বাবা-মা দুজনই হয়তো শিশুটি ঘুম থেকে উঠার আগেই বাসা ছেড়ে চলে যান। ঘুম থেকে জেগে শিশুটির চোখ দুটি খোঁজে দুটি প্রিয় মুখ। ব্যর্থ হয় সে। মানসিকভাবে আহত শিশুটি তার খাওয়া-গোসল কোনোটিই সঠিকভাবে করতে চায় না। ফলে সে মানসিকভাবে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। সারা দিন কাটে টেলিভিশন, সিডি আর নানাবিধ খেলার জগতে। কোথাও কোথাও বাসার কাজের মানুষের কাছেও এই শিশুরা লাঞ্ছিত হয়। বাবা-মায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে বাধাপ্রাপ্ত হয় বলেই শিশুদের মধ্যে শৈশব থেকেই অবরুদ্ধ অভিমানের জন্ম হয়। অনেকেই হয়ে যায় অন্তর্মুখী, যা তার জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ক্রামগত বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাবা-মা সম্পর্কের ঘাটতি পূরণ করতে শিশুদের জন্য বহুবিধ আধুনিক খেলনা, পোশাক ও খাবার দিয়ে তাদের শূন্য মনটাকে ভরিয়ে রাখতে চান। এ অবস্থায় চতুর শিশু তার বায়না ক্রমাগত বাড়াতে থাকে। ধীর-বিষক্রিয়ায় সে বাবা-মাকে বাধ্য করে ফেলে তার অপরিমিত চাহিদার কাছে। শিশুটি হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী। দারুণভাবে বায়নাদার। শিশুটির বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে আশপাশের শিশুদের মধ্যে তার অবস্থান কোথায় এটা বোঝার চেষ্টা করে। যদি তার অবস্থান অনেক ওপরে এটা বুঝতে পারে তখন সে হয়ে ওঠে অহঙ্কারী। প্রাচুর্যের আধিক্য তাকে করে তোলে অপচয়কারী। অন্যদের সে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শেখে। এভাবেই একটি শিশু শৈশবেই, সত্য-সুন্দর, শান্ত-নিরহঙ্কার-মিতব্যয়ী ও সহিষ্ণু হওয়ার পথ থেকে সরে আসে নিজের অজান্তেই। সে আশপাশের সমাজের সাথে নিজেকে মেলাতে ব্যর্থ হয়। উল্টো তারই মতো স্বেচ্ছাচারী মুক্তজীবন প্রত্যাশী বখে যাওয়াদের সাথে গড়ে ওঠে তার এক অদ্ভুত সখ্য। জোটে দুষ্ট বন্ধু। জীবন হয়ে ওঠে বন্ধু-নির্ভর। বাবা-মা হয়ে ওঠেন অচেনা। শুভাকাক্সক্ষীরা হয়ে উঠেন শত্রু। পা বাড়ায় অজস্র উপকরণে সাজানো নোংরা অন্ধকার জগতে। এটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়োসন্ধিকালের অপ্রতিরোধ্য আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ছেলেমেয়েদের জন্য সময়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এক অর্থে ভয়াবহ। পরিশেষে মায়েদের জন্য দুটি কথা : সন্তানকে যথেষ্ট সময় দেয়ার চেষ্টা করুন। শুধু শাসন নয় তাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও শিক্ষক হওয়ার সাধনা করুন। বাইরে খাবার প্রবণতা আজকাল উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের একটি ঝোঁক। তাদের জন্য বাসায় ছুটির দিনে মুখরোচক যুগোপযোগী খাবার রান্না করুন। এটা পরিবারের সবাই উপভোগ করবে। তাদের বাইরে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবসহ খাবার অভ্যাস আশা করা যায় কমবে। সুফল পাবেন। সন্তানের পোশাক নির্বাচনে তাদের রুচিবোধকে জাগ্রত করুন। নারীদের শালীনতা, লজ্জাশীলতার বিষয় সচেতন করে তুলুন। আমাদের মনে আছে কয়েক বছর আগে একটি ১৫-১৬ বছরের মেয়ে স্কুল পাস করার পর কলেজে যাওয়ার প্রাক্কালে বাবা-মায়ের কাছে আবদার করল ব্লু-জিনস ও গেঞ্জি পরে কলেজে যাবে। মা-বাবার প্রচণ্ড বাধার মুখে তার আবেদন মঞ্জুর না হওয়ার কারণে মেয়েটি সিলিংফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। খবরটি বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়। কাজেই মায়েদের জন্য সতর্ক হওয়ার সময় এখনই। একজন সচেতন মা তার সন্তান যথাসময়ে স্কুল কলেজে যায় কি না? রাতে যথাসময়ে ঘুমোতে যায় কি না? এসব বিষয়েও মাঝে মধ্যেই খোঁজখবর রাখবেন। মনে রাখতে হবে যে, সন্তানেরা স্কুল-কলেজে অনিয়মিত, সময়মতো খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে, রাত জেগে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে ও প্রায়ই অনেক রাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবাকে চিন্তা করতে হবে। এ অভ্যাসগুলো বন্ধ করতে যতœবান হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে স্কুলগামী সন্তানের হাতে প্রয়োজন অতিরিক্ত অর্থ জোগান না দেয়া। তাদের পকেট মানি বা টিফিন হিসেবে যৌক্তিক বিবেচনায় টাকা দেবেন। প্রয়োজন অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করবেন না। এই অর্থই অনর্থ ঘটিয়েছে আমাদের ঐশীর জীবনে। একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। বর্তমানে বিভিন্ন মাদকের সাথে ইয়াবার যে বিশাল সরবরাহ লক্ষ করা যাচ্ছে তার পরিণতি জ্বলন্ত জাহান্নাম। আমাদের আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা এ ব্যাপারে তৎপর বলেই বিশ্বাস করি; তারপরও বড় বড় চালান ধরা পড়ার পর গডফাদারদের দৌরাত্ম্যে বড় কিছু হয় বলে মনে হয় না। মানুষরূপী এ শয়তানদের কোনো বিচার হয় না। দেশের বহু নারী-পুরুষ এ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক। দেশকে বিপদমুক্ত করা হোক। প্রজন্মকে রক্ষা করা হোক। আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি ঐশীদের মিছিলের এখানেই সমাপ্তি হোক। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads