মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

চুল নিয়ে মাতামাতি ও সংবিধানের আকুতি


কথায় বলে, যত গর্জে তত বর্ষে না। কোন পথে হাঁটছেন হাসিনা? একের পর এক বাক্য জনতার উদ্দেশে বর্ষণ করে দেশকে চরম সংকটের সম্মুখীন করেছেন তিনি। এটাই কি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথ? বঙ্গবন্ধুতো দেশকে ভালবেসেছিলেন। মানুষকে ভালবেসেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত রক্তপাত-সংঘাত পরিহার করার রাজনীতিকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
১৭ আগষ্ট ২০১৩ টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জরুরি সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করা হলো।  দেশবাসী ভেবেছিল এটি প্রধানমন্ত্রীর জরুরি সংবাদ সম্মেলন-হয়তো বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে, নির্বাচন কালীন সরকার সম্পর্কে তিনি কিছু বলবেন। কিন্তু দেখা গেল, ওই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে পাটের জন্ম রহস্য বা জিন সিকুয়েন্সিং সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী অস্বাভাবিক দৃঢ়তার সাথে বললেন, সংবিধান থেকে তিনি এক চুলও নড়বেন না। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী মোতাবেক বর্তমান সরকারের অধীনেই পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনকালে যে সরকার থাকবে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? উত্তরে পুনরায় দৃঢ়তার সাথে প্রধানমন্ত্রী জানান দিলেন, সংবিধানে যা লেখা আছে তাই হবে। এর মানে হলো, ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রীও তিনিই থাকবেন।
আসল কথা, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাবে তেমন কোনো নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে না। সে কারণেই আওয়ামী লীগ ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে যে, তারা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে না। যদি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে দেশে কোনো নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচন দেবে। শেখ মুজিব তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে তার তর্জনী সম্পূর্ণ বাঁকা করে বলতেন  যে, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। হাসিনার কথায় সে দৃষ্টান্তেরই প্রতিধ্বনি হলো।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তর্ক-বিতর্কের ঝড় বইছে। সংবিধানের সংশোধনীর পূর্বে তিনি বলে আসছিলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত নির্বাচিত সরকারের অধীনেই দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকালে নির্বাচিত দলীয় সরকার নিজের থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। সে সব দেশে গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে, রাজনীতিকদের কাছে একটি অলঙ্ঘনীয় আদর্শ হিসেবে বাস্তবে স্বীকৃতি লাভ করায় নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিরোধী দলের মনে নির্বাচনে কারচুপির কোন আশঙ্কা সৃষ্টি হয় না।
বাংলাদেশের সংবিধান থাকুক বা না থাকুক, সংবিধানের সাথে সাযুজ্যশীল হোক বা না হোক জনগণের জন্যে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
 রাজনীতি বিজ্ঞানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, একক প্রজাতন্ত্রের ধারণা, লিখিত সংবিধান ও সিভিল ’ল-এর প্রায়োগিকতা, অলিখিত সংবিধান ও কম ’ল-এর অধিক্ষেত্র, পার্লামেন্টারি সার্বভৌমত্ব ও সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এ ধারণাগুলো দ্বারা কোন রাষ্ট্র ও সে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক নির্ণিত হয়, জনগণের স্বার্থের নিশ্চয়তা নির্ধারিত হয়। কোন একটি সংবিধান জনগণের কি-না বা রাষ্ট্রের সংবিধানে জনগণের অভিপ্রায়ের মূল্য কি তা জানতে হলে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের ঐ সূচকগুলো, ঐ পরিভাষাগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে কথা বলতে হলেও এ পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক দিক সামনে রাখতে হবে।
মার্কিন সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার একক এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টকে দেয়া আছে। সে দেশের দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টকে আইন প্রণয়ন করার একক ক্ষমতা দেয়া আছে ঠিকই কিন্তু যদি প্রণীত আইন লিখিত বা অলিখিত মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণœ করে তবে সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব এখতিয়ারে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ঘোষণা করে প্রণীত আইনটিই বাতিল করতে পারে।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এক্ষেত্রে তা করতে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাবান। ‘ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি’ মার্কিন সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য।
বৃটিশ সংবিধান অলিখিত, এর অর্থ সেখানে কমন ‘ল কার্যকর। কমন ল’ বলতে দেশে প্রচলিত প্রথা ও ঐতিহ্যকে বুঝায়। বৃটিশ পার্লামেন্ট অলিখিত সংবিধান হিসেবে এই কমন ’ল-এর উপর ভিত্তি করে সিভিল ’ল জারী করে। এ কারণে অর্থাৎ লিখিত সংবিধান না থাকায় বৃটিশ পার্লামেন্ট প্রকৃতই সার্বভৌম-সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব সেখানে নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানে এককভাবে ও নিরঙ্কুশভাবে সংবিধানকেই সার্বভৌমত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট বা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট মার্কিনীদের বা বৃটিশদের মত সেভাবে সার্বভৌমত্ব ভোগ করে না। বাংলাদেশের সংবিধান সে ক্ষমতা পার্লামেন্টকে বা সুপ্রিম কোর্টকে দেয়নি। ৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ঘোষিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে, পার্লামেন্ট যে আইনই প্রণয়ন করুক না কেন তা যদি সংবিধানের কোন প্রবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তবে যেটুকু সাংঘর্ষিক হবে ততটুকু স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। সংবিধান ও প্রচলিত আইনের আওতায় মাত্র বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার ঘোষণা দিতে পারে পার্লামেন্ট সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোন আইন পাস করতে পারে না, আবার সুপ্রিম কোর্টও সংবিধান ও পার্লামেন্টের আইন লংঘন করে কোন অধিকার ঘোষণা বা কোন ধরনের আদেশ দিতে পারে না।
অন্যদিকে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তির প্রকাশ স্বরূপ ঘোষণা করা হয়েছে সংবিধানকে এবং সে কারণে এ সংবিধানের আওতায় বর্ণিত ক্ষমতাধীনে পার্লামেন্ট কালাকানুন তৈরি করতে পারে, সেরূপ করলে সুপ্রিম কোর্ট কিছু করতে পারে না। এ সংবিধানে মৌলিক অধিকার যতটুকু ঘোষণা আছে তাও এ সংবিধানের অধীনেই স্থগিত রাখা যায়, সেরূপ রাখা হলে তা সাংবিধানিক গণ্য হবে। অর্থাৎ ‘জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশই হলো সংবিধান’ নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ নীতি ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রয়োজন সঙ্গতিপূর্ণ। বৃটিশ যুক্তরাজ্যের ‘সুপ্রীম্যাসি অব পার্লামেন্ট’ নীতি অলিখিত সংবিধান ও কমন ল’ এর কারণে অপরিহার্য। কিন্তু “সলেমন এক্সপ্রেশন অব রিপাবলিক” নীতি একক প্রজাতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
রিপাবলিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় সংবিধান দ্বারা লিখিত থাকে। কেবলমাত্র সে সংবিধানের আওতায় নির্বাচনের মাধ্যমেই সংবিধান সম্মত পার্লামেন্ট কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করে জনগণের অভিপ্রায়ের সংশোধনী আনয়ন করা যায়। সুতরাং জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তির প্রকাশস্বরূপ সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ও লিখিত সংবিধানের প্রাধান্য বাংলাদেশের সংবিধানের অলংঘনীয় বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের সংবিধানের এটি একটি গৌরবময় ও রিপাবলিক ধারণাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্য কেউ উপলব্ধি করলে তার পক্ষে মার্কিন বা বৃটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যের আলোকে আমাদের সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে জাতীয় সংকট সৃষ্টির অনুঘটক হওয়া সম্ভব নয়।
কেউ কেউ বলছেন, জনগণের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। যে জনগণের জন্য এই সংবিধান সেই জনগণের স্বার্থে সংবিধানের বাইরে হলেও এ সংবিধান পরিবর্তন করা বা সংবিধানের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নেয়া সঙ্গত।
প্রথমত: স্মর্তব্য যে, “জনগণের জন্য” শব্দদ্বয় পরিমাপক কোন যন্ত্র নেই। এর একটি পদ্ধতিগত পরিমাপক আছে এবং তা হলো নির্বাচন।
দ্বিতীয়ত: ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষের জাতিসত্তার পরম অভিপ্রায় ও ঐকমত্যের প্রকাশ হিসেবে একটি সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়। ঐ সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত আছেÑ “আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তার সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানব জাতির প্রগতিশীল আশা-আকাক্সক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।”
 সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গণপরিষদে সংবিধান গ্রহণের সময়ে এই “দৃঢ়ভাবে ঘোষণা” শব্দগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে বিঘোষিত হয়েছে যে, জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি হচ্ছে এই সংবিধান।
সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবলমাত্র এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।”
সংবিধানের ৭(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এ সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।”
উল্লেখ থাকে যে, সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উক্ত প্রস্তাবনায় বর্ণিত ঐ অংশগুলো গণভোট ছাড়া সংশোধনযোগ্য নয়। জনগণের ইচ্ছার প্রমাণক ও মাধ্যম হচ্ছে সংবিধান এবং এ জন্য প্রস্তাবনায় বর্ণিত বক্তব্যকে জনগণের ভোট ছাড়া অপরিবর্তনীয় বলা হয়েছে।
এ কথাগুলোরই প্রতিফলন ঘটেছে ড. মহিউদ্দিন ফারুখ বনাম সরকার মামলায় (৪৯ ডিএলআর)। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, “সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭ অনর্থকভাবে উদ্ধৃত হয়নি। এ প্রবিধানে এ অর্থই ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বিচার বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের উপর অর্পিত সকল ধরনের আইনী, প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে জনগণের নিজেদেরই সংবিধানসম্মত ক্ষমতা এবং সে মতে সংবিধান অনুযায়ী ‘সৃষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান নিজের অন্তর্নিহিত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাবলে ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় না, বরং জনগণের সকল ক্ষমতাকেই ঐ সংস্থাগুলো সংবিধানে যেভাবে লেখা আছে সেভাবে প্রয়োগ করে থাকে। অনুচ্ছেদ-৭ এর কর্তৃত্বাধীনেই জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস।
তৃতীয়ত: সংবিধানেই সংবিধান পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপন বা বাতিল করার প্রবিধান রাখা হয়েছে। জনগণ যদি সেইরূপ কোন পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে তবে তা সংবিধানসম্মত পন্থায় সম্ভব। সংবিধানের ১৪২(১) (ক) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ“সংসদের আইন দ্বারা এ সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের মাধ্যমে সংশোধিত হইতে পারিবে।”
তবে উক্তরূপ সংশোধনীর জন্য ১৪২(১)(ক) (আ) নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত পদ্ধতির অনুসৃতি অবশ্যই বাধ্যতামূলক। বলা হয়েছে, “সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।”
এর সাথে সংবিধানের ১৪২ (১) (ক) নং অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৮, ৪৮ বা ৫৬ বা ১৪২ নং অনুচ্ছেদসমূহ সংশোধনীর কোন বিল সংসদ কর্তৃক গৃহীত হলে তা রাষ্ট্রপতি সরাসরি সম্মতি দিতে পারবেন না। বরং সেক্ষেত্রে বিধান করা হয়েছে যে, তিনি বিলটিকে রেফারেন্ডামে বা গণভোটে প্রেরণ করবেন। যদি গণভোটে জনগণের সম্মতি পান তাহলেই কেবল তিনি সম্মতি দিবেন এবং তার সম্মতিক্রমে সংবিধান সংশোধিত হবে। এছাড়া সংবিধানের অন্যান্য সকল সংশোধনীর ক্ষেত্রে ১৪২(১)(খ)নং অনুচ্ছেদ মতে সংসদে বিলটি গৃহীত হওয়ার ৭ দিনের মধ্যেই সম্মতি দিবেন।
৭ দিনের মধ্যে না দিলে ধরে নেয়া হবে যে, তিনি সম্মতি দিয়েছেন। সংবিধান-প্রস্তাবনা, ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ নং অনুচ্ছেদ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণ কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা। কিšুÍ সংবিধান-প্রস্তাবনা ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ নং অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে তা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা নয়। রাষ্ট্রপতির এখানে একটি বাধ্যতামূলক কর্তৃত্ব রয়েছে, তাহলো গণভোটে প্রেরণপূর্বক জনগণের সম্মতি গ্রহণ অপরিহার্য।
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নিয়োগ, ক্ষমতা প্রয়োগ এবং গৃহীত সকল পদক্ষেপ বৈধ করতে সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির পদে সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। পঞ্চম সংসদে ১৯৯১ সালের ৬ আগষ্ট এ সংশোধনী পাস হয়। একই দিনে একই সঙ্গে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীও পাস হয়। ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সাধারণ নির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কারণ সেসব দেশের রাজনীতিকরা গণতন্ত্রকে বাস্তব ক্ষেত্রে মূল্য দিতে শিখেছেন। গণতন্ত্রের মূলকথা, জনগণের স্বাধীন মতামতের আলোকে দেশ পরিচালিত হতে হবে। এ কারণেই ১৯৮২ সাল থেকে চলমান এরশাদের ০৯ বছরের শাসনের ১৯৯০ সালে অবসানে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল সম্মত হয় এবং সে অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। সরকারের মেয়াদ শেষে খালেদা জিয়া তার সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিতে খালেদা জিয়াকে বাধ্য করেন।
১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ ভোররাতে পাসকৃত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়। সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে যে বিষয়গুলো সংযোজন করা হয়েছে, তাতে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৪৫টিতে উন্নীত করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে বণ্টন ব্যবস্থা, সংবিধানে নতুন একটি অনুচ্ছেদ ৪(ক) সন্নিবেশ করে সরকারি অফিস-আদালতে প্রতিকৃতি স্থাপন নীতিমালা, ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের বয়সসীমা ৬৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়েছে। সংবিধানের ১৩৯ অনুচ্ছেদে (১) দফায় পিএসসির চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্যদের চাকরির বয়স দায়িত্ব গ্রহণের তারিখ থেকে ৫ বছর এবং বয়সসীমা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬৫-তে উন্নীত করা হয়েছে। সংবিধানের ১২৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। (১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী সাপেক্ষে মহাহিসাব নিরীক্ষক তার দায়িত্ব গ্রহণের তারিখ হতে ৫ বছর বা তার ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া ইহার মধ্যে অগ্রে ঘটে সেই কাল পর্যন্ত বহাল থাকিবেন।
১৪৮ অনুচ্ছেদের (২) দফার পর নতুন ২ (ক) সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ইহাতে সাধারণ নির্বাচনের পর ফলাফল গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৩ দিনের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি সংসদ সদস্য শপথ বাক্য পাঠ করাতে ব্যর্থ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের শপথ বাক্য পাঠ করানোর বিধান করা হয়েছে।
২০০৬ সালের বিএনপি-জোট সরকারের শাসনের সমাপ্তিতে আওয়ামী লীগের মূল দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। এ ইস্যুতে দলটি ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত দেশে ওলট-পালট কা- ঘটিয়েছে। বিদেশীরাও হস্তক্ষেপ করেছে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রেসিডেন্টের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেনি আওয়ামী লীগ।
চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের মুহূর্তে বিশেষ করে দু’দলের মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক পর্যায়ে সংলাপকালে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা দলগুলোর আন্দোলনের একমাত্র ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান। মূল দাবি থেকে আওয়ামী লীগের এ বিচ্যুতিতে দেশবাসী হতবাক হয়ে পড়েন। জাতি এতদিন একথাই শুনেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার ছাড়া আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
দলটির সভানেত্রী বারংবার বলেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সংস্কার ছাড়া বাংলার মাটিতে কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না এবং কাউকে নির্বাচনে অংশ নিতেও দিবেন না।
আওয়ামী লীগের নেতারা তখন বৈঠক করে আলোচনা করেছিলেন, চলমান সংকট নিরসনের পর বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব হলে এবং এ সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে তা হবে মূল দাবির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতকতা। একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হবে যে, দলটি নিজেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সংস্কার চায়নি। এটা তাদের দাবি ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল দেশে অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারে আওয়ামী লীগের দাবি পূরণ করতে সংবিধান সংশোধন করতে হতো। রাজনীতির গতি প্রবাহ এ ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, জোট সরকার ও আওয়ামী লীগ একমত হলে সংবিধান সংশোধন করা হবে। কিšুÍ অষ্টম সংসদের সমাপনী ভাষণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধনে সংসদের জরুরি অধিবেশন আহবানের দাবি জানাননি।
পেশাজীবী নেতারা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ এক সেমিনারে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সঙ্কটে ফেলে অনেকে জাতীয় সরকারের স্বপ্ন দেখছেন। জাতীয় সরকারকে কিভাবে সাংবিধানিক আচ্ছাদন দেয়া যায় সে নিয়ে কিছু বড় বড় আইনজীবী নেতা যথারীতি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে সংস্কারের নামে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হলে শুধু যে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে তা নয়, দেশও বিপন্ন হয়ে পড়বে। যে মুহূর্তে ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালানোর জন্য দাবি করছে তখন খোদ বাংলাদেশের ভেতরে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির অপকৌশল কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের পক্ষেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ সম্মিলিতি পেশাজীবী সমম্বয় পরিষদ ‘সংসদীয় গণতন্ত্র-নির্বাচন’ এই সেমিনারের আয়োজন করে। পরিষদের সভাপতি প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ।
সভায় বক্তারা বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার যখন দ্বারপ্রান্তে, তিন তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সমাগত, এরূপ একটি সময়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বাকযুদ্ধ ও অসহনশীলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে বা হয়েছে তা দেশপ্রেমিক কোনো পেশাজীবী বা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আগামী দিনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক এটি বাংলাদেশের সকলের একমাত্র কামনা।
বন্ধুবৎসল বিদেশীরা আমাদের হিতাকাঙ্খী হয়ে নীরবে কিছু পরামর্শ দিতেই পারে। কিন্তু পরামর্শ প্রদান প্রক্রিয়া যদি আমাদের ওপর খবরদারিতে পর্যবসিত হয় তাহলে জাতীয় অনুভূতি আহত না হয়ে পারে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে নালিশ জানাতে যান। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় দেশের জনগণ নয়, বিদেশীরাই তাদের ক্ষমতায় বসাবে....।
২০০৬ সালে গণতন্ত্রের চাইতেও দলীয় স্বার্থ বিবেচনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও পচিয়ে ফেলা হয়। সেই সুযোগে অসাংবিধানিক শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সেনা সমর্থিত সরকারের নামে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার কায়েম করে। শুধু তাই নয়, তারা দেশের দুই প্রধান নেত্রীকে আটক করে রাজনীতি থেকে তাদের নির্বাসন দেয়ার লক্ষ্যে দুই প্রধান দলের তথাকথিত সংস্কারপন্থী নেতাদের নিয়ে সরকার গঠনের কাজে অনেক দূর এগিয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলায় এই চক্রান্ত অর্ধপথেই বন্ধ হয়ে যায়।
এই পর্যায়ে আটক দুই প্রধান নেত্রীর একজন তিনি ক্ষমতায় গেলে অসাংবিধানিক সরকারের সকল কার্যের বৈধতা দানের আগাম প্রতিশ্রুতি প্রদানের  প্রেক্ষিতে দেশে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জয়ী হয়ে সেই নেত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দিয়ে সংবিধানে নির্বাচিত দলীয় সরকারের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে তাদের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের দফা-৩ এ বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে।’
নতুন এ সংশোধনী আনার পর থেকেই রাজনীতিতে উত্তাপ বিরাজ করছে। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে।
উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান বাতিল করে দিয়েছে। সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ শিরোনামে ৫৮খ(১) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘সংসদ ভাংগিয়া দেয়ার পর বা মেয়াদ অবসানের কারণে ভংগ হইবার পর যে তারিখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করেন সেই তারিখ হইতে সংসদ গঠিত হইবার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী তাহার পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত মেয়াদে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে।’
এরপর ৫৮(ঙ) অনুচ্ছেদ পর্যন্ত ওই সরকারের দায়, গঠন প্রকৃতি, কার্যপরিধি ইত্যাদি সবিস্তারে সন্নিবেশিত ছিল।
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের উদ্যোগে জাতীয় সংসদে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানটি বাতিল হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার ও সরকারি দলের লোকজন বারবার উচ্চ আদালতের রায়ের দোহাই দিয়েছেন। অথচ সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রেখেই সংবিধান সংশোধন করা হবে। কমিটির কোনো সদস্যই মিডিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে প্রকাশিত মতামত অস্বীকার বা নাকচ করেননি।
সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত প্রস্তাবাবলীতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায়ের জন্য কমিটির সদস্যরা যেদিন গেলেন সেদিনই উল্টে গেল সব। মিডিয়াতেও খবর এলো, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়ই বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করে কমিটি এবং সংসদে সরকারি দলের ব্রুট মেজরিটির জোরে তা যথারীতি পাসও হয়ে যায়। তখন বিএনপিসহ সব বিরোধী দল আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ে সংসদ চাইলে আরও দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে বলে যে অভিমত দেয়া হয়েছে বার বার তা উল্লেখ করেছে। সরকার পক্ষ কোনো পাত্তাই দেয়না। তারা বার বার উচ্চ আদালতের রায়েরই দোহাই দিয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতি স্বাক্ষরিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছেÑআগামী দুই সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করবেন নির্বাচন কমিশন এবং ওয়ান-ইলেভেনের দুই বছরের অবৈধ শাসনকে ক্ষমা করা হলো। বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মূল যে কথাটি লিখেছেন তা হচ্ছেÑ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে হইবে।’ রায়ে বলা হয়েছেÑ‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, ২০১১ সালের ১০ মে তারিখ হইতে ভাবীসাপেক্ষভাবে প্রোসপেকটিভলি) অসাংবিধানিক তথা অবৈধ ঘোষণা করা হইল এবং আপীলটি খরচা ব্যতিরেকে মঞ্জুর করা হইল।’
রায়ের ১৬ দফা সারাংশে বলা হয়েছেÑ(১) জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম; (২) বাংলাদেশের সরকার মানুষের সরকার নহে, আইনের সরকার; (৩)সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, ইহা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পন করিয়াছে; (৪) জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো; (৫) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোন ধরনের ছেদ বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না; (৬) সুপ্রিম কোর্ট ইহার জুডিশিয়াল রিভিউ এর ক্ষমতাবলে যে কোন অসাংবিধানিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করিতে পারে বা বাতিল করতে পারে; (৭) কোন মোকদ্দমার শুনানিকালে কোন আইনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে সুপ্রিম কোর্ট সে সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না, আইনের প্রশ্নটি নিরসন করাই সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্ব; (৮) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে জাতীয় সংসদ সংবিধানের যে কোন সংশোধন করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ক্ষুণœ বা খর্ব বা সংশোধন করিতে পারে না; (৯) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, বাংলাদেশ সংবিধান সংশোধন করিয়াছে; (১০) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬, রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে খর্ব করিয়াছে বিধায় উক্ত তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ, সুতরাং বাতিল হইবে; (১১) বিশেষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ও কারণাধীনে কোন আইন ভাবীসাপেক্ষভাবে (প্রোসপেকটিভলি) অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাইতে পারে; (১২) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত সময় পূর্বে, যথা ৪২ (বিয়াল্লিশ) দিন পূর্বে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন; (১৩) সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন ১৯৯৬, অসাংবিধানিক ও অবৈধ হইলেও জাতীয় সংসদ ইহার বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুসারে উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী সাপেক্ষে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমত নুতনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে; (১৪) সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ হইতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ পর্যন্ত নির্বাচনের সহিত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা অনুসারে এমনকি পরোক্ষভাবে জড়িত, রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকিবে; (১৫) বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদের শর্ত এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের স্বার্থে আনয়ন করা প্রয়োজন এবং (১৬) ২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ পরবর্তী তারিখ প্রায় দুই বছর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ঐ অতিরিক্ত সময়কালের কার্যাবলী মার্জনা করা হইল।
২ আগস্ট ২০১২ মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে বেশ কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সাথে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের এ প্রচারাভিযানে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনোমতেই হতে দেবো না। এতে বরং বিএনপিই লাভবান হবে। ওদের আপনারা বোঝান। প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে আবারো যে সামরিক বাহিনী জড়াবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এতে বিএনপি লাভবান হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রচারে নামতে মন্ত্রীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সভা, সেমিনার, জনসভা, গোলটেবিল বৈঠক এমনকি এলাকার জনসংযোগের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে বক্তব্য এবং মতামত দিতে হবে। শুধু জনসংযোগ নয়, যেখানে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা হবে, সেখানে তদেরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুফল সম্পর্কে বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে আবারো সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় চলে আসতে পারে এ আশঙ্কার বিষয়টি বিরোধী শিবিরে পৌঁছে দেবেন মন্ত্রি সভার সদস্যরা।
আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ইতোমধ্যে বলেছেন, এ প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত ৪ আগষ্ট ২০১২)
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকলেও তার প্রস্তাব আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এর মাধ্যমে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। এখন সেই অন্তর্বর্তী সরকার দলীয় না নির্দলীয় হবে তা নিয়েই এখন বিরোধে থেকে গেল।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুণœুর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে না বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসদ রেখে তো নির্বাচন হবে না। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব দিলে সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। এটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। যেমন আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে অনুরোধ করবো আমরা এ সময়ে নির্বাচন করতে চাই। তখন রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেবেন। এই মন্ত্রীসভা থাকবে নাকি ছোট করতে হবে তার নির্দেশ দেবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি যেভাবে নির্দেশ দেবেন সেই অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করবে।
১০ নভেম্বর ২০১২ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘ল রিপোর্টার্স ফোরাম’ আয়োজিত সেমিনারে দেশের আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিকরা ‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় ও রাজনেতিক সঙ্কট উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, রাজপথের সংঘাত ছাড়া সংকটের উত্তরণ সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো সংঘাত ছাড়া রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়নি। একই সঙ্গে বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে কোন সমাধানে পৌঁছতে না পারলে বর্তমান সরকারি দল বিরোধী দল কেউই রক্ষা পাবে না। বক্তাদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে যেমন অভিমত এসেছে তেমনি আবার ভিন্নমতও এসেছে। তবে সকল বক্তাই আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভুত রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন এলআরএফ সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের আইন, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক সালেহউদ্দিন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’ এর পরিচালক ড. শাহদীন মালিক ।
সবচেয়ে বড় কথা সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের পূর্ণাঙ্গ রায় দেয়ার অধিকার ছিল না। ২০১১ সালের ১০ মে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে রায় দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। এরপর ১৭ মে অবসর নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অবসর নেয়ার পর তিনি কলম ধরতে পারেন কিনা? এটা সো সিম্পল। ১৮ মে তিনি কলম ধরতে পারেন না। ১৭ মে’র পরে তার কোনো অধিকার নেই রায় দেয়ার। অথচ ১৬ মাস পর তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন। এটা গায়ের জোরে করা হয়েছে।
কোন কোন আইনজীবী বলছেন, উচ্চ আদালতে যে রায় দিয়েছে তা মানা বাধ্যতামূলক। এটা নিয়ে বিতর্ক করা ঠিক হবে না। বিতর্ক করলে নতুন একটি বিড়ম্বনা সৃষ্টি হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসংক্রান্ত রায়ের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এর সমাধান আনতে হবে। সেই দায়িত্ব এখন জাতীয় সংসদের। সংসদেই নির্ধারণ হবে আগামী নির্বাচনের পদ্ধতি কি হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। সরকার ও বিরোধী দলকে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে।
আমাদের সব সময় খেয়াল রাখতে হবে সংবিধান ও গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল রাখা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি কাজ। এখানে বিরোধী দল চাচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সমাধানের সুযোগ এখনো রয়েছে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়েই একটি দিকনির্দেশনা আছে। আগে শিডিউল ঘোষণা করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচন হয়েছে। আর এখন তা হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। সরকার ও বিরোধী দলে তো নির্বাচিত ব্যক্তি আছেই। সুতরাং, কোনো সমস্যা আছে বলে মনে করি না। এটা রাজনীতিবিদরাই সমাধান করবেন। এখন তাদেরই দায়িত্ব।
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। তিনি বলেছেন, আমি সবসময় বলে আসছি, নির্বাচন হবে না। ক্ষমতা ছাড়ার সম্ভাবনা আছে, এমন কোনো নির্বাচন আওয়ামী লীগ করবে না। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে সে নির্বাচন অর্থবহ হবে না। পৃথিবীর কোথাও সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হয়?
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে বিএনপিকে যেভাবে রাজপথের আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার  মেনে নিতে বাধ্য করেছিল, বিএনপিও যদি এবার আওয়ামী লীগকে সেভাবে বাধ্য করতে পারে তবে সমাধান একভাবে হবে। না হয় ইতিহাস তার আপন গতিতে চলবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি বেআইনি পথে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় তবে ইতিহাসের পরিণতি তাকে ভোগ করতে হবে। ইতিহাসের কাছে  কেউ ছাড়া পাননি, তারাও পাবেন না।
দেশ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে মত দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, দেশটা একটা রক্তপাতের দিকে যাচ্ছে। খুনখারাবি হচ্ছে দলের ভেতরে-বাইরে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতিতে রাজনৈতিক চিন্তাবিদ নেই। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেই তাকে ছোট করেছে। ভারতে মহাত্মা গান্ধী মারা গেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আব্রাহাম লিঙ্কন মারা গেছেন। সে সব দেশে সারাক্ষণ তাদের জন্য কান্নাকাটি করা হয় না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে দলীয় নেতায় পরিণত করেছে। বঙ্গবন্ধুর যে উজ্জ্বল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তিনি যে দুর্নীতিমুক্ত মানুষ ছিলেন, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যে কোনো টাকা ছিল না, তিনি যে জাতির ঐক্য চেয়েছিলেন, তিনি  যে ক্ষমা করেছিলেন, তা নিয়ে তো  কোথায়ও আওয়ামী লীগ আলোচনা করে না। বঙ্গবন্ধুর দল তো চুরি করতে পারে না।
বিএনপি ধরে নিয়েছে যে আগামী নির্বাচনে তারা বিপুল ভোটে এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে। তাদের এই আশাবাদ ভিত্তিহীন নয়। তাদের এই আশাবাদ বাস্তবায়িত হতে পারে তখন যখন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি করতে আওয়ামী লীগ সরকার দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছে। তাই আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে অব্যাহতভাবে গভীর সংশয় প্রকাশ করছেন সচেতন দেশবাসী।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান কি পবিত্র কোরআন বা কোনো ধর্মগ্রন্থ যে তার কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাবে না? বর্তমান সরকারের সংশোধনের আগে সংবিধানের যে রূপ ছিল তা যেমন ছিল মনুষ্যরচিত, সংবিধানের বর্তমান রূপও তো মনুষ্যরচিত। দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার স্বার্থে সংবিধান আরেক দফা সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে বাধা বা অসুবিধা কোথায়?
সাধারণ মানুষ দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি দেখতে চায়। বাংলাদেশের বিদেশী প্রকৃত সুহৃদরাও চান, বাংলাদেশে সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে যে দলই ক্ষমতায় যাক, জনগণের মনে কোনো ক্ষোভ থাকবে না। তার পরিবর্তে এ ছুতায় সে ছুতায় যদি এমন কোনো নির্বাচন হয়, যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হবে না, সেক্ষেত্রে জনমনে ক্ষোভ ধূমায়িত হতেই থাকবে। যারা এরকম চাপিয়ে দেয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবেন, তারাও শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন না। সে ধরনের নির্বাচন হয়ে পড়বে অনেকটাই অর্থহীন। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের পরও দেশে অশান্তি ও সংঘাত বেড়েই যাবে। বহির্দেশের সুহৃদরাও এ ধরনের নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতি দেখে হতাশ হয়ে পড়তে বাধ্য।
এসব কারণেই আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, সরকার যেন এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন যাতে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয় এবং দেশে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি ও সংঘাতের বৃদ্ধি পায়। অতীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন যে সরকারকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনের মারফৎ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী, সে সরকারও কিšুÍ ছিল নির্বাচিত সরকার। সে সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি সেদিন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান যুক্তিসঙ্গত হয়ে থাকে, আজ তা অগ্রহণযেগ্য হবে কোন্্ যুক্তিতে?
আর সংবিধান থেকে এক চুলও না নড়ার যে সংকল্প ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কেও বলতে হয়, সংবিধান পবিত্র কোন ধর্মগ্রন্থ নয় যে তার কোনো অংশ সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজন করা যাবে না। এই সংবিধানই বর্তমান সরকারকৃত সর্বশেষ সংশোধনীর পূর্বে যে অবস্থায় ছিল সেটাও ছিল সংবিধান। সংবিধান সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের মতামত আমলে নেয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত জরুরি বলে বিবেচিত হয়। অথচ বর্তমান সরকারপ্রধান সে রকম কোনো পদক্ষেপ তো গ্রহণ করেনইনি, বিরোধী দলের বিরোধিতা চরম উপেক্ষা করেই সংবিধানে এই সংশোধনী আনেন। এরপর তিনি যদি ঘোষণা দেন সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না তার অর্থ কিন্তু তাঁর সংবিধান প্রীতি বা গণতন্ত্রপ্রীতির প্রমাণ বহন করবে না।
গণতন্ত্রে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতা একেবারেই অপরিহার্য। বিশেষ করে সংবিধান সংশোধনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দলের মতামতকে আমলে নেয়া যেখানে অত্যন্ত জরুরী ছিল, সেখানে তাদের সুস্পষ্ট বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের যে বিধান করা হয়েছে তা বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রপ্রীতির নয়, গণতন্ত্রভীতিরই প্রমাণ বহন করে। এভাবে সংশোধিত সংবিধান থেকে এক চুলও নড়বেন না বলে ঘোষণা দেয়ায় প্রমাণিত হয়েছে তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত থেকে এক চুলও নড়বেন না। বলাবাহুল্য, এর কোনোটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিশীল নয়।
এখনও সময় আছে। দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার স্বার্থে, সর্বোপরি দেশের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের স্বার্থে এই অনড়, অনাকাক্সিক্ষত অবস্থান থেকে সরে আসুন। সকল দলের গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দানের গৌরব অর্জন করুন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads