বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক সঙ্কট

বাংলাদেশ এখন কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। সর্বত্র উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয় আর অনিশ্চয়তার ছাপ। প্রধানমন্ত্রীর ভয় যদি আবার এক-এগারো আসে, বিরোধীদলীয় নেতার ভয় একদলীয় সরকার নিয়ে, সুশীলসমাজের উৎকণ্ঠা সুষ্ঠু নির্বাচন আর সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা কখন যে শুরু হয় সঙ্ঘাত আর সংঘর্ষ। সেই সাথে কিছু প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। যেমনÑ নির্বাচন কি যথাসময়ে হবে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে? যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাতে কি বিএনপি অংশ নেবে? যদি বিএনপি অংশ না নেয় তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে? নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন কি সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় সবাই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলমান এই সঙ্কটের জন্ম আজ থেকে প্রায় দুই বছর তিন মাস আগে। যখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। সেই সময় থেকেই সুশীলসমাজ, আইনজ্ঞ, রাজনীতি বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনেরা সবাই এর সমালোচনা করেছেন। সরকার কর্ণপাত করেনি। এই সঙ্কট এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময় অতিক্রান্ত হলেও সরকারি দলের প থেকে কোনো পরিবর্তন ল করা যায়নি। এই সমস্যা সমাধানেও সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আলোচনা ও সংলাপের কথা বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা শুধু সভা সমাবেশেই সীমাবব্ধ ছিল। অথচ বিরোধী জোট দুই বছর ধরে প্রধানত এই ইস্যুতেই আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। ঠিক একই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দেয়া হয়েছে ১৯৯৬ সালে। তখন বর্তমান সরকার সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ২০০৬ সালেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে তৎকালীন বিরোধী দল নির্বাচনে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নয় বরং একজন সাবেক বিচারপতির জন্য। যার বিরুদ্ধে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ছিল। তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে সাংবিধানিক সংস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সাথে সাথে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও ছিল অভিযোগ। ফলে তৈরি হয় এক-এগারো, প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত যার উদাহরণ উপস্থাপন করেন। তাহলে প্রশ্ন সেই একই সংবিধানে তৈরি করা নতুন বিধান অন্তর্বতী সরকারেরঅধীনে বিএনপি কিভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা এবং জাতীয় সংসদ বহাল থাকবে? সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতি। সময় ও অবস্থার পরিপ্রেেিত জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করতে হয়। জনমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করে সংবিধান পরিবর্তন করা দরকার। প্রশ্ন হলো, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরিবর্তন করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হলো তাতে কি প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে? যেহেতু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পে অভিমত দিয়েছে তাই বলা যায়, সংশোধনীতে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সরকারি দলের ইচ্ছা আকাক্সার বাস্তবায়ন ঘটেছে। নির্বাচন নিয়ে সর্বশেষ জটিলতা দেখা দিয়েছে কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছেন, নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেবেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রয়োজনে বিরোধী দলের সদস্যও থাকবে। কিন্তু গত ২ তারিখ সচিবালয়ে সচিবসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচন হবে ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে। তিনি সেখানে ঘোষণা করেন, এই সময়ে সংসদ বহাল থাকবে তবে কোনো অধিবেশন বসবে না এবং মন্ত্রিসভা থাকবে তবে তারা রুটিন কাজ ছাড়া কোনো নীতিনির্ধারণী কাজ করবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর বিভিন্ন মহল থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশিষ্টজনেরা অভিমত দিয়েছেন এভাবে নির্বাচন হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডতৈরি হবে না। এটি নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে। স্বয়ং নির্বাচন কমিশনই এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন। নিরপে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করার জন্য সংবিধান সংশোধনীর পর যে সংস্কার করার কথা ছিল তা করা হয়নি। ভোটার তালিকার সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত জানুয়ারি মাসে ভোটার তালিকার ওপর পরিচালিত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রপের একটি অডিট থেকে দেখা যায়, তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ১৫ শতাংশ ভোটারের আইডি নম্বর ভুল। তা ছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের কাজে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। কয়েক দিন আগে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মতদ্বৈধতা দেখা গেছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন নিজেদের মতা কমিয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছে, যা সর্বমহলে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান চারটি দলের তিনটি দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি (মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক দল) ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের নিরপেতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সার্বিক দিক বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান হয়, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচনের পরিবর্তে সরকারের কাছে যেনতেন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় টিকে থাকাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ল্েয সরকার প্রশাসনসহ সব েেত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে সুবিধা দিয়ে ঢেলে সাজাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে পদন্নোতির হিড়িক ল করা যাচ্ছে। প্রশাসনে ৩২৬ জন উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। সরকারের জন্য হুমকিএমন ৩৫ জন কর্মকর্তসহ প্রশাসন ক্যাডারের দুই অতিরিক্ত সচিব, দুই যুগ্ম সচিব ও পরারাষ্ট্র ক্যাডারের তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আর উপপরিদর্শকের পদ তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। কর্মরত সাড়ে ২৩ হাজারেরও বেশি জুনিয়র কমিশন অফিসার (জেসিও) এবং সার্জেন্টের পদ উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাদ যায়নি শিকেরাও। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তার মর্যাদা দেয়া হয় গত বছরের মে মাসে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিকের পদ তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রায় ২৬ হাজার রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোরও পরিকল্পনা আছে। নির্বাচনের সময় প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিকদের বড় ভূমিকা থাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এ ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন যে, গোটা প্রশাসনযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে সরকার নির্বাচনের নামে প্রহসন করতে চাইছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার একদলীয় নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যদি বিএনপি কিংবা ১৮ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ না নেয় সেই বিকল্পও সরকারের তরফ থেকে ভাবা হয়েছে। এ েেত্র সরকারের যোগসাজশে বিএনপির আদলে বিএনএফ গঠনের প্রচেষ্টা ল করা গেছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি তো হাতের কাছেই রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর গত কিছু দিনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, সরকার দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নির্বাচনের ফল নিজের ঘরে ভিড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর, সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টার চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের মনোভাব বিচার মানি কিন্তু তাল গাছ আমারটাইপের। এ পরিপ্রেেিত বিদ্যমান অবস্থায় যদি ১৮ দল নির্বাচনে অংশ নেয় তাদেরকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হবে। সংসদ বহাল থাকায় নির্বাচিত সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা সরকারি দলের সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পাবে, যা বিরোধী দল পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (মন্ত্রিসভা) যাদের মতা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনগত বিধান করা হয়নি। স্বেচ্ছায় নিজেদের মতা খর্ব করতে ইচ্ছুক বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত মতাহীন নির্বাচন কমিশন। অসংশোধিত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোকে রচিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও আচরণবিধি। আমলাতন্ত্র, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সবাই প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অভাব ঘটবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচনের যে পরিবেশ তা এখনো তৈরি হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি কিংবা ১৮ দলীয় জোট শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলোর সমাধান হওয়া ছাড়া একটি নিরপে নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে যদি বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তা নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারাবৈ আর কিছুই নয়।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads