বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কীর্তিমান এম সাইফুর রহমান


সাইফুর রহমান শুধু একজন মানুষের নাম নয়। সাইফুর রহমান ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তার জন্ম ঐতিহাসিক মৌলভীবাজার জেলার বাহারমর্দান গ্রামে। ১৯৩২ সালের ৬ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা মোহাম্মদ আবুল বাছির, মা তালেবুন নেছা। সাইফুর রহমান ছিলেন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তিনি যখন মাত্র ছয় বছরের একটি বালক, তখন তার বাবা মারা যান। চাচা মোহাম্মদ সফি তার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। গ্রামের মক্তব থেকে বাল্যশিক্ষা শেষ করে ১৯৪০ সালে জগৎসী গোপালকৃষ্ণ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই স্কুলে দুই বছর অধ্যায়ন করে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এমসি কলেজে আইকমে ভর্তি হন। তিনি এসএম হলের একজন আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এম সাইফুর রহমান দলীয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও মাতৃভাষা রক্ষার প্রত্যেকটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। বাঙালির ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র নেতৃবৃন্দ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দিলে সাইফুর রহমান অংশগ্রহণ করেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তৎকালীন সরকার ঘোষণা করেছিল, যারা মুচলেকা দেবে তাদের মুক্তি দেয়া হবে। আত্মমর্যাদাবান বাঙালিপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক সাইফুর রহমান বিশ্বাস করতেন, ভাষা আন্দোলন বাঙালির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের আন্দোলন। এ সংগ্রাম বাঙালির দাবি আদায়ের সংগ্রাম। তিনি তখন তৎকালীন সরকারের কাছে নতি স্বীকার করেননি। সাইফুর রহমান ছিলেন প্রখর আত্মমর্যাদাবান এক সাহসী মানুষ। সে জন্য তিনি কখনো জেল-জুলুমকে ভয় পাননি। পরে তিনি স্বাভাবিক নিয়মে জেল থেকে মুক্তি পান। ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০০৫ সালে তিনি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক লাভ করেন। দেশ বিদেশে তিনি অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রাণপুরুষ, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী সেই সাইফুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মার্যাদা না দিয়ে আমরা কার্পণ্য প্রদর্শন করছি। সাইফুর রহমান ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন অর্জন করেন। সে সময় মেধাবী ছাত্রদের মতো তারও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অভিলাষ ছিল, সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলাতন্ত্রে যোগ দেয়া; কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হওয়ার পরে সিএসপি হওয়ার বাসনা মন থেকে মুছে ফেলেন। তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান; কিন্তু লন্ডনে পৌঁছার পর তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৩-৫৮ সালে পড়াশোনার পর ১৯৫৯ সালে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্স ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের ফেলোশিপ অর্জন করেন। তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষ শিক্ষা অর্জন করেন। সাইফুর রহমান দেশে ফিরে এসে পাকিস্তান অক্সিজেন কোম্পানিতে যোগদান করেন। মাত্র দুই বছর চাকরি করার পর তিনি এবং তার আরো দুই বন্ধু মিলে একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস ফার্ম গড়ে তোলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুরোধে সাইফুর রহমান জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। জিয়াউর রহমানের অনুরোধে এম সাইফুর রহমান ১৯৭৬ সালে বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে তার মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। পরে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার সংসদীয়-৩ আসন থেকে সদস সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে সাইফুর রহমানের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে সাইফুর রহমান তার সরকারের মন্ত্রিসভায় অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আবার মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ এবং সিলেট (সদর-কোম্পানীগঞ্জ)-১ আসন থেকে এমনপি নির্বাচিত হন। পরে তিনি মৌলভীবাজার-৩ আসন ছেড়ে দিলে তার বড় ছেলে নাসের রহমান উপনির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পরে সাইফুর রহমান তখন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি জাতীয় সংসদে ১২ বার জাতীয় বাজেট পেশ করে কৃতিত্বপূর্ণ রেকর্ডের অধিকারী হন। মনীষীর ভাষায়Ñ কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নয়। এই কথাটি সাইফুর রহমান তার বর্ণাঢ্য জীবনে প্রতিফলিত করেছেন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশী যিনি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এই দুই প্রতিষ্ঠানের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত মাদ্রিদ সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। জননন্দিত নেতা এম সাইফুর রহমান বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় ইস্যু নিয়ে অসংখ্য অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাইফুর রহমান মৃত্যুকে জয় করার জন্য অনেক কাজ করে গেছেন। যার ফলে তিনি আজ কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। সাইফুর রহমানকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। তিনি সব সময় কিভাবে দেশের উন্নয়ন ও সিলেটের উন্নয়ন করা যায় তা নিয়ে সর্বদা গভীরভাবে ভাবতেন। তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। সাইফুর রহমান যে শুধু একজন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি একজন দানবীরও ছিলেন। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাইফুর রহমান মারা যাওয়ার পর এই বরেণ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার খুবই ছোট মনের পরিচয় দেয়। আজ ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব অর্থনীতির বরপুত্র আলহাজ এম সাইফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ২০০৯ সালের এ দিনে কোটি কোটি বাঙালিকে শোকাহত করে চলে গেছেন পরপারে। আজ এম সাইফুর রহমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনাÑ তিনি যেন আজীবন মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ সাইফুর রহমানকে বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে রাখেন। আমিন


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads