শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

দেশ সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে


শেখ হাসিনা বাংলা-দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি রাজনৈতিক সভার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি এখনো দলের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির ঐকমত্যের লক্ষ্যে কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকেও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তাকে দলীয় খোলসে ঢুকিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য মুজিবের ভাবমূর্তি ুণœ করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী কখনোই নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় সরকারি খরচে নির্বাচনী বক্তব্য তথা, বিশেষ কোনো মার্কায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানাতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিগত পৌনে পাঁচ বছর তিনি দলের গুণগানে প্রচুর সময়ক্ষেপণ করেছেন। রাষ্ট্রের উন্নয়ন কিভাবে করা যায়, সে কথা যতটা বলেছেন, তার চেয়ে বেশি বলেছেন বিরোধী দলের কথিত ষড়যন্ত্রের কথা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সব সময় অতীতমুখী মনোভাব; ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বক্তব্য কম। বড় বড় দার্শনিক বলেছেন, অতীত মৃত, ভবিষ্যৎ অনাগত, বর্তমানই জীবন্ত। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক তাকেই বলা যায় যিনি অপরের সমালোচনায় সময়ক্ষেপণ না করে নিজের সমালোচনায় অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে বর্তমান সময়কে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। অতীতমুখী আচরণের কারণে, প্রধানমন্ত্রী দেশকে যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন ২০০৬ সালে, সে ক্ষেত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এতে যেমন রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে তেমনি তার ইমেজেরও ধস নেমেছে। একজন সফল রাজনৈতিক নেতার সফলতার শতভাগ বিকশিত হয় যখন ওই নেতা জাতির মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি নির্বাচনী সভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ আছে আর ছয় সপ্তাহ। এখন পর্যন্ত সংবিধানের দোহাই তুলে নিজ দলের অধীনে একতরফা সংসদ নির্বাচনের কথাই বারবার বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিরোধী দল বলছে, সব দলের অংশগ্রহণের মতো একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, সে ধরনের একটি নির্বাচনের কথা। অর্থাৎ নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে যাদের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা নেইÑ নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কাজ সমাধা করা। বিরোধী দলের এই যৌক্তিক দাবি সরকার মানতে নারাজ। সেহেতু সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। গোটা জাতি চরমভাবে হতাশ। যারা জাতিকে পথ দেখাবেন তারাই সঙ্কট জিইয়ে রেখেছেন। বর্তমান সরকার হার্ড লাইনে থাকার কারণে গণতান্ত্রিক চর্চা বলতে গেলে এখন সঙ্কটাপন্ন। বিরোধী দলের উদ্যোগে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দাবি মেনে নেয়ার মতো একটি অবস্থার সৃষ্টি করা সম্ভব কি না, তা অনিশ্চিত। এহেন অবস্থায় বিএনপির দৃষ্টি এখন জাতিসঙ্ঘের দিকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতায় আসতে সরকারকে রাজি করাতে জাতিসঙ্ঘ যাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে, সে জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের কাজটি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে বিএনপির উচ্চমহলের একাধিক ব্যক্তির ধারণা, গত ২ সেপ্টেম্বর সচিবদের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপরেখা বা কাঠামো তুলে ধরেছেন, তাতে সরকার সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা ভাবছেন নির্বাচনের সময় যতই কাছে আসছে সরকার আগের অবস্থায় থাকার কথা আরো দৃঢ়তার সাথে বলছে। সে ক্ষেত্রে সমঝোতা বলতে যা বোঝায় সেটা আর হচ্ছে না। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শক্ত অবস্থান নেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। এখনো আস্থার সঙ্কট চরমভাবে বিরাজ করছে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি গণদাবিতে রূপ নিয়েছে। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ৪ সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সচিব বৈঠকের পর এটা স্পষ্ট যে, সুষ্ঠু নির্বাচন আর সম্ভব নয়। কারণ বর্তমান নবম সংসদ ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকছে এবং বর্তমান সংসদ সদস্যরা নিজ পদে থেকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে যে নির্বাচন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন, এতে তারা অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। এই অসম যুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর অবতীর্ণ না হওয়ারই কথা। সেটা তারা বলেছেনও। নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে বিরোধী দল অটল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ও বর্তমান মন্ত্রিসভা বহাল থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সমঝোতার আর কোনো পথ খোলা নেই। তার পরও বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান চায়। মির্জা আলমগীর এখনো মনে করেন আলোচনা হলে দুই পক্ষেই ছাড় দেয়ার বিষয়টিও আসতে পারে। তবে বিশ্বের কোনো দেশেই একটি সংসদ জীবিত রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। সরকার শুধু বিরোধী দলের মতামতকে উপেক্ষা করছে না, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের মতামতকেও উপেক্ষা করা হচ্ছে। তদুপরি, আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে সরকার তাদের একদলীয় সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারী কায়দায় বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে চাইছে। এত দিন আওয়ামী লীগ সমঝোতা, সংলাপ বা আলোচনার যেসব কথা বলেছিল সবই মনে হচ্ছে মেকি ও ভাঁওতাভাজি। ২ সেপ্টেম্বর সচিবদের সভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বোঝা উচিত, বর্তমান যুগ ব্যক্তি বা পারিবারিক নেতৃত্বের যুগ নয়। দেশের সব মানুষের মতামতের যুগ চলছে গোটা বিশ্বে। দেশ কিভাবে চলবে, কারা চালাবেন ও কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবেÑ এ সব কিছুই এখন গণমানুষের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ৮ থেকে ১০টি মিডিয়ার জরিপে গণমানুষের চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটেছে। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচন হোক। প্রধানমন্ত্রীর যদি এতে সন্দেহ থাকে তাহলে গণভোটের মাধ্যমে সন্দেহ দূর করতে পারেন। দেশের বর্তমান অচলাবস্থা থেকে গোটা জাতি পরিত্রাণ চায়। বাংলাদেশে নির্বাহী প্রধানের একতরফা চিন্তা বা সিদ্ধান্তের কারণে কিছু ঘটলে জাতি অবাঞ্ছিত সরকারপ্রধানকেই দায়ী করবে সবচেয়ে বেশি। গণতন্ত্র যদি পরাজিত হয় সেখানে উগ্রপন্থার আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের চলমান ধারাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও মিসরে রক্তের হোলি খেলা চলছে। সব ধর্মের মানুষ, সব দলের মানুষ, উপজাতি বা আদিবাসী, ভিন্ন মতের মানুষ সবাই সহাবস্থানে বসবাসের সুযোগ ঘটে যদি দেশে সুস্থ ধারার গণতন্ত্রের চর্চা চলতে থাকে। ওপরে গণতন্ত্রের লেবাস ভেতরে স্বৈরাচারী চিন্তাধারা দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাবেই। নির্বাহী প্রধানকে বলব, দেশের স্বার্থে একটু নমনীয় হোন। সঙ্ঘাতের পথকে এড়িয়ে চলা এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য আপনাকেই উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads