বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১২

মধ্যরাতে সিঁদকাটার গল্প



আ মী ন কা দী র
শালা, আমাকে আবুল কোম্পানি বলা হলো কেন? এইটা কি ইয়ার্কির জায়গা? তোমার আমি চোখ উপড়ে ফেলব, হারামজাদা। তুমি আমাকে চেন না। হারামজাদা কোথাকার! তোরে আজ আমি কাছে পাইছি। তোমারে জুতাপেটা করব। শালারা, তোমরা সবাই আজান দিয়ে খাইতেছ। দোষ হয় গিয়ে আবুল কোম্পানির। আরে আমি তো তোমাদের মত একলা একলা খাইতে যাই না। আমি সব সময় দিয়ে-থুয়ে খাই। দেশে দেই। বিদেশে দেই। আমার টাকা খায় নাই এই দেশে এমন বাপের ব্যাটা আছে কেডা! সব হালার পুতের পেট ভরাইছি। কোন হালার পুতেই আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবে না। হা হা হা। কী ভাবছেন আপনারা? আবুল আবার এই গুণ্ডা-মাস্তানের ভাষা শিখল কেমনে? হা হা। এইটা আমি শাজাহান ভাইয়ের কাছে থেকে শিখেছি। আসলে শেখার কোনো শেষ নাই। এবারের এই মহাজোট জমানায় আমি অনেক কিছুই শিখেছি। আবার অনেক কিছু শিখাইছি। আমার বড় শিক্ষা হলো—টাকাপয়সা দিয়ে-থুয়ে শেষ পর্যন্ত লাভ হয় না। শেষ পর্যন্ত কেউ পাশে থাকে না। সব মাছেই বর্জ্য খায়। মল খায়। আর নাম হয় গিয়ে আবুলের। এই কথা বইয়ে পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। এবার বিশ্বাস করলাম। যাদের এত খাওয়ালাম। তারা শেষ পর্যন্ত আমার পাশে দাঁড়াল না। আর সর্বশেষ শিক্ষাটা পেলাম শাজাহান খান মিয়ার কাছ থেকে। বাড়ি আমাদের এক জায়গায় হলেও আচার-আচরণে কোনো মিল নেই। আমি কোনোদিন কারও সঙ্গে হাসি ছাড়া কথা বলিনি। গুণ্ডামি-মাস্তানি তো দূরের কথা। আমার পরম বিশ্বাস ছিল ভালো ব্যবহারের কোনো শত্রু নেই। ব্যবহারটা ভাল থাকলে যে কোনো কিছু হাসিল করা সম্ভব। কিন্তু মহাজোট সরকারের শেষ দৃশ্যে এসে আজ মনে হচ্ছে—শাজাহান-ওবায়দুলের কাছে থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। খালি তেলবাজি মিষ্টিবাজি দিয়ে হয় না। ড্যাশিং হওয়া প্রয়োজন। মাস্তানি দরকার আছে। দেখেন অবস্থা। খান সাহেব তো টকশোতে ব্যারিস্টার রফিককে সবার সামনে চোখ উপড়ে ফেলার ভয় দেখাল। তাতে কিছু কি হলো? হয়নি। তার কি মন্ত্রিত্ব গেছে? না, যায়নি। যাবে কেমনে? তারে যে সবাই ভয় পায়। যে বিরোধী দলের সাবেক মন্ত্রীর চোখ তোলার কথা বলতে পারে। সে যে প্রয়োজনে নিজদলের লোকজনের চোখ উপড়ে নেবে না—কোনো গ্যারান্টি নেই। আমি যদি খান সাহেবের মতো অমন ভয় দেখাতে পারতাম, তাহলে গোলাম মাওলা রনির মতো পুচকে, যে কিনা এখনও জানে না কই মাছরে কয়টা আছাড় দিলে মরে, সেই নাদান পিচ্চি রনিও কিনা আমারে নিয়া দৌড়-মন্ত্রিত্বের কথা বলে। যদি আমি খান সাহেবের মতো ষণ্ডা হতাম, সে ভুলেও কি সাহস পেত? সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পেত না। সারাক্ষণ ভয়ে থাকত কখন না কখন তার চোখ উপড়ে ফেলি। সেখানে খান সাহেবকে দেখেন—মহাজোটের চোটপাট শেষ। তবু তার গলার আওয়াজ নামেনি। সে এখনও বজ্রকণ্ঠ। আগামীতে যদি আবার মন্ত্রী হতে পারি—আপনারা নিশ্চিত থাকেন আমি খান মিয়ার মতো হুঙ্কার দেব, যাতে কোনো শালার ব্যাটা টিভি টক শোতে গালগল্প করার সাহস না পায়। আসলে এই টক শোই মহাজোট সরকারের বারোটা বাজিয়েছে। মহান নেত্রী ঠিকই বলেছেন। চোরে সিঁদ কাটে মধ্যরাতে। আর এই টক শোঅলারা সেই মাঝরাতেই সরকারের গলা কাটে। গলা কাটা আর সিঁদ কাটার মধ্যে পার্থক্য বিশেষ দেখি না। এই টক শো ছিল বলেই কালোবেড়াল দাদা দিনের দিন মধ্যরাতে সেখানে গিয়ে সরকারের গলা কেটেছেন। ওবায়দুল কাদের কম যাননি। তিনি তো রীতিমত বুদ্ধিজীবী সেজে বসেছিলেন। কত রস করে কথা বলতেন। এখন তার রস বের হচ্ছে। হা হা হা। টকশো যদি প্রধানমন্ত্রী আগেই বন্ধ করে দিতে পারতেন, তাহলে কালোবেড়াল দাদা আর ওবায়দুলকে মন্ত্রী বানানোর দরকার পড়ত না। আসলে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমাদের শেখার শেষ নেই। তিনি ড্যাশিং ছিলেন। শাজাহান খান সাহেবের মতো অকুতোভয় ছিলেন। তাই তিনি মোটেই পরোয়া করেননি। ঠিকই বন্ধ করে দিয়েছিলেন মিডিয়ার মুখ। এই ব্যাটাদের বলতে দিলেই যত যন্ত্রণা। পেটে ভাত নেই। বউ রাতে ভাত-তরকারি রাঁধছে কিনা খবর নেই। আর তারা কিনা ব্যস্ত সরকারের গলা কাটায়। বাঙালির সমস্যাই হলো কথা বলতে তাদের বড় সুখ। আমি কখনোই টক শোর টক্করে পড়িনি। আমি কাজে-কামে বিশ্বাসী। এই আজ কালো চশমা পরে কালো বেড়াল দাদা দেহের পশ্চাদভাগের সঙ্গে একখানা চেয়ার বেঁধে নির্লজ্জর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর ভাবছেন জওহরলাল নেহেরু যেহেতু উজিরে খামোকা থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সুতরাং তার মহামন্ত্রী হওয়া ঠেকায় কে? গাছে কাঁঠাল গোফে তেল। খুঁটিতে বান্ধা ছাগল দু-চার-দশ হাত জায়গার মধ্যে ঘুরে-ফিরে ঘাস খায়, আর ভাবে আহা দুনিয়ার সব ঘাস যেন তারই। কিন্তু যেই না দূরে ঘাস খেতে যায়, অমনি তার খুঁটিতে টান পড়ে। তখন ঠিকই ছাগলও বুঝতে পারে তার দৌড় কত দূর। কিন্তু আমাদের চাঁদাবাজ রাজনীতিকরা যখন মন্ত্রী হয়, তখন তাদেরও মনে হয়—চান্দাও তার। সরকারের সব বরাদ্দও তার। খেতে খেতে তাদের হুশ থাকে না। কিন্তু আমরা চান্দা দিতে অভ্যস্ত। আমি ৪০ বছর ধরে চাঁদা দিয়ে আসছি। কার খাই কত—আমার ঠিকই হিসাব আছে। বিশ্বব্যাংক যতই চেষ্টা করুক লাভ নেই। কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমি কাঁচা কাজের লোক নই। কী বলছে তারা! দুর্নীতির চিন্তা করলেও নাকি শাস্তি দেবে। তারা মনে একটা মনোমিটার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কার মনে কী আছে, ঠিকই তারা আবিষ্কার করে ফেলবে। হা হা। ওইসব ফালতু কথা বলে আনএডুকেটেড পারসনকে বোকা বানানো সম্ভব। কুলি সর্দার, সড়কসন্ত্রাসী মন্ত্রী হলে তাদের ওইসব ফালতু কথা বলে ভয় পাওয়ানো সম্ভব। আমাদের সম্ভব নয়। আমি এডুকেটেড পারসন। আই এম এ টোটালি এডুকেটেড পারসন। আই এম এ ফুল প্রুভড এডুকেটেড পারসন। আমি আটঘাট বেঁধেই কাজ করি। আমার সবচেয়ে হাস্যকর লেগেছে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের কথা। তারাও বলেছে, বাংলাদেশের আইনে দুর্নীতি চিন্তা করাও নাকি অপরাধ। কোন দুদক এই কথা বলছে! যারা কালো বেড়ালের মতো কট অ্যান্ড বোল্ড করাপটেড মন্ত্রীকেও ধরতে পারে না, যারা ৭০ লাখ টাকার এভিডেন্স পেয়েও বলে চাকরবাকরের কথার কোনো দাম নেই। তারা ধরবে ভাবের চোর। আমি তো জোরগলায় বলবই আই এম স্টিল অনেস্ট। আই এম এ ফুলপ্রুফ অনেস্ট ম্যান। আই এম এ গ্যারান্টিড অনেস্ট ম্যান।
ব্লাকক্যাট দাদা আমার বিরুদ্ধে কত কথাই তো বলেছেন।আমাদের কত সততা শেখালেন। আর মন্ত্রী হয়ে কী করলেন? বমাল ধরা খেলেন। ভেবেছিলেন আহা তৈরি সিস্টেম পেয়েছি। সততার তুবড়ি ছোটাব মুখে—আর তলে তলে সব সাবাড় করে দেব। আরে বাবু দুনিয়ায় এমন কোনো সিস্টেম আছে নাকি ওপরে ঠিকমত ভাগ না দিয়া একাই সব গ্রাস করা সম্ভব। আরে আমেরিকা-রাশিয়াতেও প্রেসিডেন্ট-প্রাইম মিনিস্টারকে ভাগ না দিয়া একলা সব খাওয়া যায় না। হাহা। দাদার অবস্থা দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ছে। সিঁদ কাটার গল্প। এক চোর গেছে চুরি করতে। গেরস্তের ঘরে সিঁদ কেটে ঢুকবে। ভালো কথা। সে সিঁদ কেটে চলেছে। কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল গেরস্ত। সে কোনো আওয়াজ-টাওয়াজ তুলল না। কিছু বলল না। তার ঘরে ছিল বিরাট রাম-দা। তাতে ভীষণ ধার। এক কোপ দিলে একটা মানুষকে দুই টুকরা করা সম্ভব। সেটা নিয়ে সে সিঁদ কাটার জায়গাটার একপাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকল। ভাবল যেই না চোর সিঁদ কাটা গর্ত দিয়ে মাথা গলিয়ে ভেতরে ঢুকবে—অমনি সে দেবে এক কোপ। চোরের চুরির খায়েশ সারা জীবনের জন্য মিটবে। এক কোপে চোরের মাথা দুই টুকরা। চোরের সিঁদ কাটা শেষ। গেরস্ত অধীর অপেক্ষায়। একসময় দেখল চোর বাবাজি ঠিকই মাথা গলিয়ে দিয়েছে। তাহলে আর দেরি কেন। যেই না মাথাটাকে গর্তের এপাশে ঘরের মধ্যে দেখল, আর সে ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না, দিল এক কোপ। দিতেই ঠং করে এক শব্দ হলো। রামদাটা ভেঙেই যাওয়ার জোগাড়। কেসটা কি! তারপর শুনতে পেল চোর দিব্যি সুস্থ গলায় জোরে জোরে আওয়াজ দিচ্ছে। বলছে আমি অত ভোধাই নই। আমারে তুমি গাধা ভাবছিলা গেরস্ত। তুমি রাম-দা লইয়া ঘাপটি মেরে থাকবার পার, সেই চিন্তা আমার মাথায়ও ছিল। তুমি আমার মাথায় কোপ দিবার পার নাই। তুমি কোপ দিছ কালি মাখা পাতিলে। বুঝলা ভোধাই আমি না, ভোধাই হইলা তুমি।
কালো বেড়াল দাদা সম্ভবত জানে না, চুরি-চামারি করতে গেলে কালিমাখা পাতিল সব সময় সঙ্গে থাকা দরকার। নইলে চুরির মিশনে নামা উচিত নয়। উনি বরং আমার ওপর বাটপাড়ি করতে গিয়েছিলেন। আরে এই হাজার রেল কর্মচারী নিয়োগের সিস্টেম তো আমিই আমার আমলে করেছিলাম। উনি আমার বাড়া ভাতে ছাই দিতে গিয়েছিলেন। তিনি মন্ত্রিত্ব পেয়ে সবকিছু রেডিমেড পেয়েছেন। হা হা হা। অর্থাত্ কিনা গেরস্ত ঘরে সিঁদ কাটা সারা। সিঁদ তো আগেই কাটা ছিল। আরে দাদা সিঁদ কাটারও তো কতগুলো উসুল আছে। শুধু গলা কাটতে জানলে চলবে না। সিঁদ কেটে আরও কিছু প্রস্তুতি রাখতে হয়। গায়ে মাইট্টা তেল মাখিয়ে রাখা চাই। সারা শরীর থাকতে হবে পিচ্ছিল। কেউ থাবড়া মারলেও যেন ধরা না পড়ো। গায়ের চামড়া মোটা থাকা চাই। তুমি আজান দিয়া চুরি-চামারি করবা—লোকে কিছু বলবে না, তা হয় না। লোকে তাদের কথা বলবে; তুমি তোমার কাজ সুন্দরমত করবা। পাছে লোকে কী বলল তা ভাবলে চলবে না। দাদা কী করলেন। তিনি ভাবলেন। তার চেয়ে মহাধুরন্ধর আর কে আছে। সারাজীবন কথার পিঠে কথা পিটিয়ে লোক চড়িয়ে খেয়েছেন। কথা বেচে লোকজনকে বোকা বানিয়েছেন। তিনি দেখলেন—আহা কী সুন্দর সিঁদ কাটা। তাকে কষ্ট আর কষ্ট করতে হচ্ছে না। তার খুশি আর দেখে কে! তিনি আর কালিমাখা পাতিল মাথায় দিলেন না। সোজা মাথাটা গলিয়ে দিয়ে রেলের ঘরে চুরি করতে ঢুকে পড়লেন। এ অবস্থায় যা হবার তা-ই হয়েছে। কোথাকার চাকরবাকর আলীর বেটা আলী ঠিকই রাম-দা নিয়ে ঘাপটি মেরে ছিল। সে এক কোপে কালোবেড়ালের মাথা কেটে ফেলেছে। এখন স্কন্ধকাটা ভূত হয়ে কালোবেড়াল এখানে যায়। ওখানে যায়। আর মিউ মিউ করে বেড়াচ্ছে। এই কালোবেড়ালটার মহানেত্রীও আছেন মহা যন্ত্রণায়। এটাকে বস্তায় ঢুকিয়ে দিলিল্গ ফেলে এলেও সে ঠিকই ফিরে এসে মহানেত্রীকে জ্বালাচ্ছে।
লেখক : কপি এডিটর, দৈনিক আমার দেশ
ameenqudir@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads