সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

কবে ঘুম ভাঙবে সরকারের?

জামদানি ফজলি নিম নকশিকাঁথার স্বত্ব নিবন্ধন ভারতের
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি, ফজলি আম, নিম থেকে নকশিকাঁথা পর্যন্ত ৬৬টি পণ্য ও প্রাণীর স্বত্ব নিয়ে গেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। এখন নিতে যাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও ইলিশ মাছ। ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে ভারত ট্রেড রিলেটেড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (টিআরআইপিএস) চুক্তির আওতায় জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর (জিআই) নামে আইনের অধীনে রেজিস্টার খুলে পণ্যগুলো প্যাটেন্ট করিয়ে নিয়েছে। এ চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি দেশ জিআই আইন ১৯৯৯-এর আওতায় তার দেশের জনপ্রিয়, অসাধারণ ও স্বতন্ত্র পণ্যগুলোকে প্যাটেন্ট ও সংরক্ষণ করতে পারে। এ চুক্তির আওতায় ভারত আরো ১৫৮টি পণ্যের তালিকা তৈরি করেছে প্যাটেন্ট করার জন্য। কেবল এসব পণ্য নয়, বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাণবৈচিত্র্য নিজেদের নামে প্যাটেন্ট  করিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের নাগা মরিচ, ১৫ হাজার প্রজাতির ধান এবং বেগুনের প্যাটেন্ট করিয়ে নিয়েছে ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন ও আফ্রিকানরা। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ‘বাণিজ্যসম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপসে পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর প্যাটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। এ চুক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে এমন প্রাকৃতিক, মানুষের তৈরি এবং কৃষিজাত পণ্য, তার ওপর সংশ্লিষ্ট  দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক আইন করে নিবন্ধন করে রাখার বিধান রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার (শহর বা দেশ) পণ্যের পরিচিতির জন্য জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর বা জিআই ব্যবহার করা হয়। জিআই উৎপাদকদের তাদের পণ্যের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে যাতে অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে তাদের পণ্য আলাদাভাবে চেনা যায়। এর ফলে তাদের এই পণ্যের আলাদা  সুনাম সৃষ্টি হয়। ফলে বিশ্ববাজারে তারা নিজেদের পণ্যের জন্য ভালো দাম পায়। ভারত জিআই নিবন্ধনের মাধ্যমে তাদের পণ্যের স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
ভারত ও অন্য দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থকে সামনে রেখে জামদানি, নকশিকাঁথা, ফজলি আম বা হাজার জাতের ধান প্যাটেন্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে। সে উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বার্থ বিপন্ন হলো কি হলো না সেটি তাদের দেখার বিষয় নয়। দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশ এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ঘুমিয়ে আছে। এসংক্রান্ত একটি খসড়া আইন তৈরির পর বহু দিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন কৃষি সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে সজাগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নিতে দেখা যাচ্ছে না।
আমরা মনে করি, সময় পেরিয়ে গেছে সেটাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এখন সামনে বাংলাদেশী যেসব পণ্য প্যাটেন্ট করতে বাকি আছে সেসবের ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যে আইনটি মতামতের জন্য বছরের পর বছর ওয়েবসাইটে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সেটা চূড়ান্ত করতে হবে। সেই সাথে ইতোমধ্যে যেসব বাংলাদেশী পণ্য অন্য দেশ প্যাটেন্ট করিয়ে নিয়েছে সেসবের ব্যাপারে যেখানে সুযোগ আছে সেখানে আপিল বা পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাতে হবে। আর যেখানে সম্পূরক নাম দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নতুন  প্যাটেন্ট  করার সুযোগ আছে সেখানে সে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে প্যাটেন্ট বা স্বত্বাধিকারের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি অফিস রয়েছে। সে অফিসে যোগ্য ও দক্ষ জনবল সব সময় থাকে না। একজন কর্মকর্তা  দেশ-বিদেশের প্রশিক্ষণে দক্ষ হয়ে উঠলে তাকে অন্যত্র বদলি করা হতে দেখা দেখা যায়। আন্তর্জাতিক প্যাটেন্ট অধিকারের গুরুত্ব এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই অফিসটিকে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা মনে করি এ ধরনের বাঁচা-মরার একটি জাতীয় স্বার্থ ইস্যুতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ঘুম ভাঙা খুবই জরুরি। তা না হলে বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যগত বহু পণ্যের স্বত্বাধিকার হারিয়ে বসবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য এবং কৃষি ও উৎপাদন খাত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads