শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১২

নিয়োগবাণিজ্যে সুরঞ্জিতের ভাগ ১০ কোটি : ড্রাইভার আজমের চাঞ্চল্যকর টিভি সাক্ষাত্কার, মন্ত্রীর বাসায় কয়েক দফায় টাকা পৌঁছানো হয় : তার বক্তব্য বোগাস—সুরঞ্জিত



সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১০ কোটি টাকা নিয়ে ৬শ’ লোককে রেলে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। রেলের নিয়োগবাণিজ্যের এই ভাগ মন্ত্রীর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেদিন ৯ এপ্রিল রাতে বস্তাভর্তি ৭৪ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িটিও মন্ত্রীর বাড়িতেই যাচ্ছিল। এর আগেও তার বাড়িতে কয়েক দফায় টাকা পৌঁছানো হয়েছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের তত্কালীন এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িচালক আজম খান বৃহস্পতিবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে এ দাবি করে আরও বলেন, বিবেকের তাড়না থেকে গাড়িটি তিনি জিগাতলার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হেডকোয়ার্টারে ঢুকিয়ে দেন। তিনি চান কোনো দুর্নীতিবাজ যেন ছাড় না পায়। আজম খান প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার জীবনের নিরাপত্তা চাওয়ার পাশাপাশি পলাতক জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বজনদের কাছে ফেরার সুযোগ করে দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন। আজম খানের এই আলোচিত ও তোলপাড় করা সাক্ষাত্কারের ফলে সুরঞ্জিতের এপিএসের অর্থ কেলেঙ্কারির ৬ মাস পর ওই অর্থের উত্স, গন্তব্যস্থলসহ রহস্য উন্মোচিত হলো।
তবে আজমের দেয়া সাক্ষাত্কারকে মিডিয়ার সৃষ্টি ও বোগাস বলে দাবি করে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, কথিত আজম এতদিন কোথায় ছিল? এসব তাকে ফাঁসানোর জন্য করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। অন্যদিকে এপিএস ফারুক সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, কথিত মো. আজম খান যা বলেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ আজম নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছুদিন রেলের দায়িত্বে থাকা যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আপাতত কোনো কমেন্ট করতে চাই না।
গাড়িচালক আজম খান সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘টাকা তো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতে যাচ্ছিল। ওদিকে যাওয়ার পথেই আমি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলি। এর আগেও কয়েকবার টাকা গেছে।’
আজম খান দাবি করেন, রেলের নিয়োগের ৭৪ লাখ টাকা মন্ত্রীর বাড়িতেই নেয়া হচ্ছিল। টাকা বস্তায় ভরে চালক তা নিজেই গাড়িতে তোলেন। ওমর ফারুক রেলের নিয়োগবাণিজ্য সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলেও দাবি করেন আজম খান।
সঙ্গে আর কেউ ছিলেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে আজম খান বলেন, ‘না না, আমার সঙ্গে অন্য কারও যোগসাজশ ছিল না। এমন না যে, কাউকে চাকরি দেব বলে কারও কাছ থেকে টাকা এনেছি। এমন কিছু ছিল না। তবে এমন অনেক কিছুই রটেছে।’
আজমের ভাষ্য, বিপুল পরিমাণ টাকাসহ গাড়ি বিজিবিতে ঢুকিয়ে দেয়ার সময় ওমর ফারুক তার কাছে জানতে চান, গাড়ি নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন? আজম দাবি করেন, ‘তখন আমি বললাম—স্যার, এগুলো ঘুষের টাকা, দুর্নীতির টাকা, রেলের দুর্নীতির টাকা, এই টাকাসহ আমি আপনাদের ধরিয়ে দেব। এজন্য আমি গাড়িটা ভেতরে ঢুকিয়েছি।’
আজম আরও দাবি করেন, ঘটনার রাতে তিনি বিজিবির গেট খোলা পেয়েছেন এবং গাড়িটি থামানোর জন্য কোনো সঙ্কেত দেয়া হয়নি। তার ভাষায়, ‘তারা আমাকে সিগন্যাল দেয়নি আর আমিও দাঁড়াইনি।’ এর পেছনে তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘গাড়িটা দিনে কয়েকবার এদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করে। তারা হয়তো চিনছে, এজন্য গুরুত্ব দেয়নি।’
বিজিবির গেটের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়ার পর ওমর ফারুক প্রথমে ভয় দেখান এবং পরে অর্থের লোভ দেখান বলে আজম খান দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘ফারুক সাহেব তখন বললেন, তুমি যে গাড়িটা ঢুকিয়েছ—এটা ঠিক করনি।’ পরে ওমর ফারুক আমাকে বলেন, ‘এখান থেকে পাঁচ লাখ টাকা নাও। তুমি জিএম, নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে নামিয়ে দাও। আর এখানের অর্ধেক তোমার, বাকি অর্ধেক আমার।’ আজমের দাবি, তিনি রাজি না হলে ফারুক তাকে সব টাকা দিয়ে দেয়ার লোভ দেখান।
টাকাসহ গাড়ি বিজিবির গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ার পর সকালে সেই টাকা গণনা করা হয়েছিল বলে চালক আজম খান দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টার দিকে টাকা গোনা হয়। ৭৪ লাখ টাকা ছিল। বাইরের চালক এনে গাড়ি নিয়ে তারা চলে যান।’
রেলের নিয়োগবাণিজ্যের সঙ্গে মেজর মশিউর রহমান নামের একজন জড়িত ছিলেন বলে আজম খান দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে ৩ কোটি টাকা নিয়োগবাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত।’ ওমর ফারুকের মাধ্যমে তিনি কয়েকশ’ লোককে রেলে ঢোকাতে চেয়েছিলেন বলে আজম দাবি করেন।
আজম খানের দাবি, মন্ত্রীকে ১০ কোটি টাকা দিয়ে ৬শ’ লোককে রেলে নিয়োগ দেয়া হবে বলে তিনি গাড়িতে আলোচনা শুনেছেন। তার দাবি, ‘দোষটা করেছেন মন্ত্রী। এখন সরকারের ওপর সেটা চাপাতে চান।’ আজম এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন। একইসঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টদের তদন্ত কাজে সহায়তা করতে চান। কোনো দুর্নীতিবাজ যেন ছাড় না পায়—এমন দাবি জানিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের নিরাপত্তা চান এবং পালিয়ে বেড়ানো জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বজনদের কাছে ফিরতে চান।
গত ৯ এপ্রিল গভীর রাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিতের এপিএস ফারুক বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় তার গাড়িটি চালক আজম খান পিলখানায় বিজিবির সদর দফতরে ঢুকিয়ে দেন। পরে বিজিবি সদস্যরা গাড়িসহ তাদের আটক করে। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। এরপর ১৬ এপ্রিল ‘অর্থ কেলেঙ্কারির’ দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান সুরঞ্জিত। এছাড়া রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে বরখাস্ত করা হয়। তবে সুরঞ্জিত সেনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে ক্যাবিনেটে রেখে দেন। এরপর ১৩ মে রেল মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তদন্ত কমিটির প্রধান রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের তদন্ত রিপোর্টের উদ্ধৃৃতি দিয়ে বলেন, অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ ঘোষণার ৩ দিনের মাথায় ১৬ মে তার ঝিগাতলার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, রেলের বিভাগীয় তদন্তে মন্ত্রী হিসেবে আমি নির্দোষ। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এক মাস এক দিন পর এখন আমি আবার রাজনীতিতে ফিরে যাব। জনগণের মধ্যে ফিরে যেতে চাই। তাদের মধ্যে থাকতে চাই। জনগণ আমার সম্পর্কে কি ধারণা করে, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ সম্মেলনের পর ওইদিনই পতাকাবাহী গাড়িতে করে নির্বাচনী এলাকা সিলেটে যান। তারপর থেকে সুরঞ্জিত সেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আসছেন।
গত ৯ এপ্রিলের পর থেকেই এপিএস ফারুকের গাড়িচালক আজম খানের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। দুর্নীতি দমন কমিশন ও রেল কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তলব করলেও তিনি হাজির হননি। প্রায় ছয় মাস ‘নিখোঁজ’ থাকার পর বুধবার রাতে তিনি আরটিভিতে সাক্ষাত্কার দেন। তবে কোথায় তার সাক্ষাত্কারটি নেয়া হয়েছে, প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়নি।
আমাকে ফাঁসানোর জন্য এসব করা হচ্ছে—সুরঞ্জিত : সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুকের গাড়িচালক আজম খানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘না না, এসব ফালতু কথা। বোগাস স্টোরি। এগুলো মিডিয়ার কারবার। আমাকে ফাঁসানোর জন্য করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এতদিন যেসব প্রসেস হয়েছে, সেসব প্রসেসের মধ্য দিয়ে আজম যায়নি কেন? এখন কোথা থেকে সে এসব বলছে?’
এদিকে গতকাল বিকালে সিলেট সার্কিট হাউসে সুরঞ্জিত সেন সাংবাদিকদের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় অভিযোগ করে বলেন, গাড়িচালক আজম বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার বাসায় ছিল। এখন বেরিয়ে এসে আমার সম্পর্কে নানা কথা বলছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজমের বক্তব্যের ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনাদের এত ইন্টারেস্ট কেন? তিনি বলেন, আজম কি বলেছে, সে বিষয়টি এখনও অবগত নই। এখন আমি এলাকায় এসেছি। ঢাকায় ফিরে গিয়ে বুঝব কি বলেছে, তারপর প্রয়োজন হলে আমি মন্তব্য করব।
এ আজম নিয়ে সন্দেহ রয়েছে—ফারুক : সুরঞ্জিত সেনের সাবেক এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, এ আজম নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। ঘটনার সময় আজমের লম্বা দাড়ি ছিল। হঠাত্ দেখি ক্লিন সেভ।
তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি—মন্ত্রীর বাসায় টাকা যাওয়ার ঘটনা সত্য নয়। মন্ত্রী নিয়োগবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত নন। এই টাকা সম্পূর্ণ আমার, আমার বাসায় যাচ্ছিল। আগেও অনেকবার মন্ত্রীর বাসায় টাকা গেছে—আজমের এমন দাবির জবাবে ফারুক বলেন, মিথ্যা কথা। কখনও মন্ত্রীর বাসায় টাকা যায়নি। নিয়োগবাণিজ্যের সঙ্গে মেজর মশিউরের সম্পৃক্ততা আছে—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার কোনো সময় কোনো মেজরের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। এখানে সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার ঘটনা উল্লেখ করে কথিত আজম আরেক ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। আরটিভির সাক্ষাত্কার সম্পর্কে ফারুক বলেন, ৯ এপ্রিল রাতে টাকাসহ যখন বিজিবি গেটে আটকা পড়ি, তখন মিডিয়াকর্মীদের মধ্যে প্রথম ফোনটা আসে বায়েজিদের (আরটিভির রিপোর্টার) নাম্বার থেকে। এই সাক্ষাত্কারটিও বায়েজিদ নিয়েছেন, এখান থেকেই সন্দেহটা আরও ঘনীভূত হয়। গত ১০ এপ্রিলের পর থেকে সুরঞ্জিত সেনের সঙ্গে তার কোনোরকম যোগাযোগ বা দেখা হয়নি বলে ফারুক দাবি করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads