সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১২

অস্ত্র প্রদর্শন করলে কিছু করার নেই : এ কি কথা শুনি আজ পুলিশের মুখে



রাজশাহীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন এবং অস্ত্র আইন সম্পর্কে এক নয়া তত্ত্ব জাহির করে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তা শুধু অভিনবই নয়, চূড়ান্ত নৈরাজ্যের ইঙ্গিতবাহীও বটে। পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হওয়ার পর কোনো দেশের কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের নিয়মবহির্ভূত আত্মঘাতী বাণী দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। গত ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যকার সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের সশস্ত্র আক্রমণ প্রসঙ্গে আলোচ্য ওসি সাহেব বলেছেন, ‘ওইদিন অস্ত্র প্রদর্শন হয়েছে আমরাও জানি। অস্ত্র প্রদর্শন করলে কিছু করার নেই। শুধু অস্ত্রসহ ধরা পড়লেই মামলা করা যাবে। কিন্তু অস্ত্র পাওয়া না গেলে কিংবা কারও বিরুদ্ধে মামলা না হলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।’ একটি ব্যাপারে অবশ্য ওসি সাহেব ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তা হলো, তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে, তিনি অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখেছেন। কিন্তু কোনো তত্পরতা দেখাননি। সম্ভবত এ সময় তিনি ও তার থানার অন্যান্য পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে নিরীক্ষণ করেছেন, কারা অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করছে। যখন দেখতে পেলেন সব অস্ত্রই ছাত্রলীগের ক্যাডার-কর্মীদের হাতে এবং তারাই গুলিবর্ষণ করছে তখন তিনি দলবল নিয়ে দেখি না দেখি পুতুলবত্ দাঁড়িয়ে থেকেছেন, মজা করে সংঘর্ষের দৃশ্য উপভোগ করেছেন অথবা কড়া নজর রেখেছেন আক্রান্ত ছাত্রদের কারও হাতে অস্ত্র আছে কিনা। অতঃপর তারা হতাশ হয়েছেন, কারণ সব অস্ত্রই বহন করছে যুদ্ধংদেহী ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ফলে কিছুই করার ছিল না কর্তব্যরত থানা পুলিশের।
অস্ত্র প্রদর্শন করলে পুলিশ লেজ গুটিয়ে থাকে কিংবা অক্ষম দর্শকের ভূমিকা নেয় এবং তা বুক ফুলিয়ে তার অযৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করে এমন ঘটনা অবশ্য এদেশে বিরল নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ এ ধরনের একাধিক দৃষ্টান্ত রেখেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র তাণ্ডবে পুলিশ চোখে ঠুলি লাগিয়েছে এবং যথারীতি জানিয়েছে কাউকে ধরা যায়নি। মূল কথা হচ্ছে, সবাইকে ধরা যায় না, নিষেধ আছে। কে নিষেধ করেছে? একটি প্রবাদ আছে বাংলা ভাষায়, ‘খুঁটির জোরে পাঁঠা কুদে।’ যাই হোক, ওসি সাহেবের কথায় ডাকাত-তস্কার, ছিনতাইকারী বা অন্য অপরাধীরা উত্সাহিত হবে কিনা তা না বলাই ভালো। তবে অপরাধীচক্র নির্দ্বিধায় অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে পারবে অন্তত রাজশাহী কোতোয়ালি থানা এলাকায়। এতে সংশ্লিষ্ট ওসি সাহেবের কিছু করার থাকবে না বলে মনে হয়। কেউ যদি অস্ত্রসহ ধরে এনে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে তাহলেই কেবল মামলা হবে। আর অস্ত্র পাওয়া না গেলে মামলা দূরের কথা, দাগি সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। একথাই প্রকাশ পেয়েছে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কথায়। রাজশাহীর সশস্ত্র তাণ্ডবে যারা অস্ত্র বহন করেছে, গুলি চালিয়েছে এবং অস্ত্রে গুলি লোড করেছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে, সেইসব বীরপুঙ্গবের সচিত্র ছবি ছাপা হয়েছে দেশের গণমাধ্যমে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে বৃত্ত এঁকে এসব চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ক্রমাগত কয়েকদিন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কারও টিকির নাগাল পায়নি। উদ্ধার করতে পারেনি একটি অস্ত্রও।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা শুধু ছাত্রলীগের বরাবরের কর্মকাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শানেনজুল। ঈদের পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় শুরু হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রশিবির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন আশঙ্কা করছে সরকারপক্ষ। সে সূত্রেই এ ধরনের তাণ্ডব চালানো হয়েছে। এছাড়া ছাত্রশিবির যাতে সহসা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে উদ্দেশ্যে ওপর মহল থেকে রাবি ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। পুলিশের সামনেই এত অস্ত্রের প্রদর্শন এবং তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সে অস্ত্রের একটিও উদ্ধার এবং অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করতে না পারা সেই সজাগ থাকার একটি মহড়া বলেই মনে করছেন অনেকে। যদি তা-ই হয় তাহলে এমন ভাবার অবকাশ আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার নির্দেশনা পেয়েছে থানা পুলিশও।
এ অবস্থায় মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অস্ত্র প্রদর্শন, ব্যবহার এবং এ বিষয়ক মামলা সম্পর্কে যা বলেছেন তা তার নিজের কথা নয়। অর্থাত্ যেমন নির্দেশনা তেমন উচ্চারণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার আসে সরকার যায়, থেকে যায় প্রশাসন। পুলিশ প্রশাসন দেশে সুশাসন তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। ক্ষমতায় থেকে এর যথেচ্ছ ব্যবহার কার্যত ওপর দিকে থুথু ছিটানোর শামিল। আমরা মনে করি, আলোচ্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অস্ত্র সম্পর্কে যা বলেছেন তা প্রত্যাহার করা উচিত এবং এ ধরনের দায়িত্বহীন উক্তির জন্য বিভাগীয় জবাবদিহিতার মোকাবিলা করা জরুরি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads