সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

বেগম খালেদা জিয়ার চীন সফর : কিছু প্রত্যাশার কথা




আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চীন সফরকালীন নানা ঘটনাবলীর মধ্যে একটি ঘটনা নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছিল। তার সফরসঙ্গীদের মাধ্যমে বিষয়টি চাউর হয়। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের (সিআরআই) এক সহকর্মী আমাকে ঘটনাটি বলেছিলেন। আধুনিক মহাচীনের জনক মাও সেতুং বলেছেন, ‘গ্রেট ওয়ালের চূড়ায় যারা উঠতে না পারেন, তারা প্রকৃত বীর নন।’ শহীদ জিয়া চেয়ারম্যান মাওয়ের এই বাণীটি মনে রেখেছিলেন। তিনি চীন সফরে গিয়ে মহাপ্রাচীর দেখতে যান। গিয়েই তিনি দৌড়ে প্রাচীরের চূড়ায় উঠে যান। তার সঙ্গে যেসব আমলা-অমাত্য ছিলেন, তারা শুরুতে চেষ্টা করেছিলেন, লজ্জায় হলেও রাষ্ট্রপতিকে অনুসরণ করার, কিন্তু পারেননি। কাজটি আসলেও দুঃসাধ্য। আমার নিজের অভিজ্ঞতায়ও তাই মনে হয়েছে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। বেগম খালেদা জিয়ার সফর সামনে রেখে এটি অবতারণার কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি জিয়া যেমন প্রাচীরের চূড়ায় উঠেছিলেন তেমনি বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দূরদর্শী এই রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছিলেন, জন্মের পর থেকেই বৃহত্ প্রতিবেশীর রোষানলে পড়া ক্ষুদ্র এই দেশটির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা কতটা জরুরি। কিন্তু এই সম্পর্ক অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে জিয়া-পরবর্তী সময়ে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বা এর নেতৃত্বাধীন জোট যখনই ক্ষমতায় এসেছে অতিরিক্ত ভারত তোষণের কারণে বেইজিং বিগড়িয়েছে।
চীন সম্পর্কে যারা একটু খোঁজ-খবর রাখেন, চীনা মনন সম্পর্কে তাদের ধারণা রয়েছে। এই দেশটি যাকে বুক দেয়, তাকে পিঠ দেয় না। এর বর্তমান উদাহরণ হচ্ছে সিরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বশংবদ দেশগুলো ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানকে শেষ করার পর এখন ধরেছে সিরিয়াকে। নিঃসন্দেহে এতদিনে দেশটিতে জাতিসংঘ, ন্যাটো বা নখদন্তহীন আরব লিগের ব্যানারে আক্রমণ হয়ে যেত। এই আগ্রাসন সম্ভব হচ্ছে না চীন-রাশিয়ার কারণে।
প্রসঙ্গটি তুললাম এই কারণে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭৪ সালেই ইসলামাবাদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ’৭১ সালে চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এই চীন শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় ঢাকাকে স্বীকৃতি দেয়নি। অর্থাত্ কারও ওপর বিগড়ে গেলে তা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনকে পাশে পাওয়া আজ জরুরি। এই অঞ্চলের আত্মস্বীকৃত বড়ভাই ভারত প্রতিবেশী অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে যেভাবে পদানত করে ফেলেছে, বাংলাদেশকেও সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়। অবশ্য সেই সুযোগও সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ঢাকায় যে জোট ক্ষমতাসীন, তার উপদেষ্টা, মন্ত্রীরা কথা বলেন চাণক্যপুরীর ভাষায়। তাদের বক্তৃতা, বিবৃতি নামটি ডিলিট করে পড়লে বা শুনলে মনে হবে দিল্লির মসনদে আসীন কারও কথা।
পুরো ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে মরুভূমি বানানোর জন্য দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সব অভিন্ন নদীতে ভারত বাঁধ দিয়েছে। সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে, শিল্প বিকাশ রোধে চোরাচালানিদের জন্য সীমান্ত খুলে দিচ্ছে, জাতির ভবিষ্যত্ তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের জন্য সীমান্তজুড়ে ফেনসিডিলসহ নানা নেশাদ্রব্যের কারখানা গড়ে তুলেছে। এ রকম সহস্র উদাহরণ দেয়া যাবে। এর মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হতে না দেয়া। কারণ বাংলাদেশকে ভালো অবস্থায় দেখলে ভৌগোলিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন সেভেন সিস্টারের সাধারণ মানুষ তাদের স্বাধীনতার দাবি আরও জোরদার করবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ নানা সীমাবদ্ধতার পরও সামনে এগিয়ে যেতে চায়। সেক্ষেত্রে চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের প্রতিরক্ষা, ব্যবসায়, অবকাঠামো উন্নয়ন চীনা সহযোগিতার বিকল্প নেই।
তাত্ত্বিক আলোচনায় যাব না। দীর্ঘদিন চীনে থাকার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, ধেই ধেই করে দেশটি যে কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বলা হয়ে থাকে চীনের উন্নতি দিনে দিনে নয়, প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে হচ্ছে। এই দেশটির একটি বিষয় সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য। নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্যও কিছু করতে চায়। আফ্রিকার জন্য সহযোগিতার ডালা খুলে দিয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে না।
সিআরআইতে আমার চাকরিকালে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন আশফাকুর রহমান। মেয়াদান্তে বেইজিং ত্যাগের আগে তার সঙ্গে বাংলাদেশ-চীন ব্যবসায়িক সম্পর্কে অনেক কথা হয়েছিল। তার কিছু কথা তুলে দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি তখন বলেন, চীনে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি বেড়েছে। তাছাড়া আমরা অনেক বাণিজ্যমেলায়ও অংশ নিয়েছি। আমাদের পণ্য নিয়ে আসছি। এতে খুব উপকার হয়। চীনে যে কোনো জিনিস বিক্রি করা খুব শক্ত। কারণ চীনই সব জিনিস কম দামে দেয়। যেমন কাপড়, নিটওয়্যার। আমরা দু’বছর আগে এগুলো বিক্রি করতে শুরু করি। তবে পূর্ব চায়নায় না, পশ্চিম চায়নায়। কারণ সেখানে আমাদের পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে। চীন বিশাল দেশ, শুধু একদিকে দৃষ্টি দিলে হবে না। এখন আমরা ওষুধ, কাঁকড়া বিক্রির চেষ্টা করছি। এগুলো করে দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছি।
চীনের সঙ্গে ব্যবসায় যেমন বৃদ্ধি করা যায়, তেমনি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও বেইজিংয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন।
কারণ এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই দিল্লিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি চালু করে। কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সঙ্গে একতরফা বন্ধুত্ব গড়তে গিয়ে বর্তমান সরকার ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে একদিকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে; অন্যদিকে এই সুযোগে ভারত তার অযৌক্তিক দাবিগুলো বাংলাদেশকে মানতে বাধ্য করছে। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শুধু একটি দেশকে অবলম্বন করে কোনো দেশের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তার সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। শেখ হাসিনা সরকারের একবছর পার হতে না হতেই ভারত তার দীর্ঘ ৪০ বছরের দাবিগুলো আদায় করে নেয়। সন্ত্রাস দমনের নামে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহ দমনে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা, করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অনুমতিসহ ভারত যা যা চেয়েছে তার সবকিছুতেই সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে একের পর এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যা এবং বর্বরতা থামেনি। অপদখলীয় ভূমি এবং ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত সমস্যার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এবং টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে রীতিমত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ভারত।
ভারতের সঙ্গে একতরফা সম্পর্ক গড়তে গিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকা। চীনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ এখন আর বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন খারাপ। সবমিলিয়ে বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশকে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে।’
এই বাস্তবতার মধ্যে বর্তমান সরকারের শেষ মুহূর্তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চীন সফরে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার ভারতের অনুকম্পা নিয়ে যে কোনো উপায়ে আবার ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই সরকার যে আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
এই অবস্থায় আবার দেশের হাল ধরতে হবে বেগম জিয়াকে। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে টপ প্রায়োরিটি থাকা উচিত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি খালেদা জিয়া চীনের সঙ্গে আবার ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন, যেমনটি পেরেছিলেন তার প্রয়াত স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads