রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১২

দুর্নীতি তদন্তে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দল : আত্মগ্লানি থেকে জাতি মুক্ত হোক



পদ্মা সেতুর বহুল আলোচিত দুর্নীতির তদন্ত মূল্যায়নে গতকাল ঢাকায় এসেছে বিশ্বব্যাংক গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল। জানা গেছে, প্রতিনিধি দল এ দফায় ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান এবং দুদকের সঙ্গে বৈঠক করে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম খতিয়ে দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত অনুসন্ধান দলের সঙ্গে আলোচনা করবে। প্রতিনিধি দলের কাছে সব তথ্য পাওয়া মাত্র সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য আগেভাগেই দুদক প্রস্তুতি নিয়েছে। এমন কী ১৩ অক্টোবর ছুটির দিনেও দুদক বৈঠকে বসেছে। মনে করা হচ্ছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও ছুটিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি হয়তো আবার উত্থাপিত হতে পারে। এসব নিয়েই দুদকের যত ব্যস্ততা। বস্তুত তদন্ত যাচাই-বাছাই করে তা সুষ্ঠু, পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছতা কতটুকু তা পর্যবেক্ষণ করবে বিশ্বব্যাংকের এই প্যানেল দল। এ দলের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে। পরে শিগগিরই বিশ্বব্যাংকের আরেকটি প্রতিনিধি দল আসবে। তাদের সঙ্গে আসবে পদ্মা সেতুতে সহ-অর্থায়নকারী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার প্রতিনিধিরাও। এই দলটি মূলত সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবে বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশনে তিন সদস্যের প্যানেল অব ইনভেস্টিগেটিভ এক্সপার্ট দল দুর্নীতির যেসব অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের ১২০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি বাতিল করেছিল, সেসব অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের দেয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং এক মাসের মধ্যে ওয়াশিংটনে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেশ করবে। এ উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি দল দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদক এ পর্যন্ত কী কী কাজ করেছে, বিশেষত অভিযোগ তদন্তে দুদক যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সেসব বিষয়ও খতিয়ে দেখবে। তাছাড়া এ প্রকল্পে দুদকের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার প্রশ্নটিও উত্থাপিত হবে। প্যানেলের সঙ্গে দুদকের এ বৈঠক সন্তোষজনক হলে আশা করা যেতে পারে ফিরে যাওয়া বিশ্বব্যাংক ফের আসতে পারে পদ্মা সেতু প্রকল্পে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত ২৯ জুন ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। অভিযুক্ত সব সরকারি কর্মকর্তাকে ছুটিতে পাঠানো, তদন্ত পর্যালোচনা করে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য একটি স্বাধীন এক্সটারনাল প্যানেল গঠন করাসহ চারটি শর্ত পূরণ না করায় ঋণচুক্তি বাতিল করে সংস্থাটি। তখন পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জোর গলায় দাবি করে আসছিলেন পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথাও বলেছিলেন। চাঁদা তোলা শুরু করে দিয়েছিলেন কতিপয় অতি উত্সাহী সরকার সমর্থক। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির বিহিত না করে বিশ্বব্যাংকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে বক্তৃতা দিয়েছেন। জাতিসংঘে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারও দাবি করেছিলেন। অবশেষে সবই পরিণত হয় বহবারম্ভে। একপর্যায়ে অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকে ছুটিতে পাঠিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবি আংশিকভাবে পূরণ করা হয়। তাতে মনে হতে পারে বরফ কিছুটা গলেছে। তবে ঘোলা পানি পরিষ্কার হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে বৈকি।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, হয়তো শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রতিশ্রুত অর্থ দেবে, সেতু নির্মাণের কাজও চলবে। কিন্তু দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতি নিয়ে এ নাগাদ যে নাটক হয়ে গেল তাতে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন হলো তা কী কোনো প্রাপ্তি দিয়ে মোচন সম্ভব?
অথচ সরকার অনায়াসে এই বৃহত্ প্রকল্প থেকে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দিতে পারতো। তা না করে যারা ঋণদান করে সহায়তা দেবে তাদেরকেই উল্টো অপবাদ দেয়ার রাস্তা ধরে অগ্রসর হলো। অবশেষে ঘটনাটা দাঁড়ালো এ রকম—চুরির চুরি, তার ওপর শিনা জুরি। এখন বিশ্বব্যাংক এসে চোর যাচাই করার দায়িত্ব পালন করছে আর দুর্নীতি দমন কমিশন তথা সরকার দায় থেকে রেহাই পেতে অনেকটা আসামির মতো আচরণ করছে। স্বাধীন দেশের ‘স্বাধীন’ দুর্নীতি কমিশন দান পেতে এবং মান বাঁচাতে নিরূপায় করণিকের মতো ফাইলপত্র নিয়ে ঘুরছে বিশ্বব্যাংকের পিছনে। এই যদি হয় পরিণতি তাহলে আগে এত বাগাড়ম্বর করা হলো কেন? অবশেষে কথাটা দাঁড়ালো এরকম, সেই তো নথ খসালি তবে কেন লোক হাসালি। এ ব্যাপারে আমরা বরাবরই সরকারকে সতর্ক করেছি—দুর্নীতিবাজদের ধরুন, বিচার করুন। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি ছাড়া পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। সরকার সেসব প্রস্তাব কানে তোলেনি। উদ্দেশ্য ছিল গোলাজলে মাছ শিকার করবে। এখন ঝক্কি সামলাও।
আমরা মনে করি, কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা দুর্নীতির প্রশ্নে তদারকিতে এলে তা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই লজ্জাকর, ক্ষতিকর এবং মন্দ দৃষ্টান্ত। বেপরোয়া দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন সরকারের ভুলের জন্য জাতিকে সেই গ্লানিকর অবস্থাকেই আজ মাথা পেতে নিতে হচ্ছে। আমরা চাই, ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করবে তাদের জন্য এই ন্যক্কারজনক ঘটনা একটি সতর্ক সংকেত হয়ে থাকুক। যত উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিই হোন না কেন তিনি যেন ক্ষমতার জোরে আইনের জাল কেটে বেরুতে সক্ষম না হন, আমরা এও প্রত্যাশা করি। বর্তমান সরকার ঠেলায় পড়ে হলেও দুর্নীতির রাশ টেনে ধরবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এহেন ভ্রান্তপথে পা বাড়ানোর ভরসা না পায়। দেশবাসী চায় পদ্মা সেতু হোক। কিন্তু তার আগে উত্থাপিত অভিযোগের সুরাহা হওয়াও কম জরুরি নয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads