বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১২

চেতনার লাঠিয়াল ও অচেতন মানবতা


মিনার রশীদ
মওলানা আবুল কালাম আজাদ জীবনসায়াহ্নে মানবতার রূপ দেখে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন। উপমহাদেশের ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ চল্লিশের দশকে জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা। সেই মানবতার জানাজার পর পরবর্তী চল্লিশ বছরে চল্লিশাও শেষ হয়ে গেছে। তারপর নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারে পুনর্জন্ম হয়েছে নতুন বোধের নতুন অবয়বের এক মানবতা। এই ‘মানবতার স্লোগানটি’ কোথাও হয়েছে রাজনীতির হাতিয়ার। কোথাও সেজেছে চেতনার লাঠিয়াল। কোথাও হয়েছে খুদ-কুঁড়ায় আকর্ষিত কিংবা ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত।
সর্প হয়ে যারা দংশন করেন তারাই অনেক সময় এই আজব মানবতার বড় বড় ওঝা সেজে বসেন। জনৈক বৌদ্ধ যুবকের ইসলাম অবমাননাসংক্রান্ত ডিজিটাল পোস্টিংটিকে অ্যানালগ জনতার সামনে এনেছিল আওয়ামী ঘরানার ‘তৌহিদি জনতা’ মিছিলের নেতৃত্বেও দেখা গেছে মৎস্য লীগ ও ছাত্রলীগকে। তার পরও যারা প্রশাসন ও পুলিশের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের আক্কেল দাঁত আদতেই উঠেছে কি না তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
কাজেই কারা এই আক্রমণ করেছে তা বলে দিতে জনতার মঞ্চের মহানায়ক বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটুও সময় লাগেনি। তবে বিএনপি-জামায়াতকে সরাসরি দায়ী করার চেয়ে বরং আশরাফুল ইসলামের ‘শিবির অনুপ্রবেশ তত্ত্ব’ এই জায়গায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হতো। ছাত্রলীগ ও মৎস্যলীগের ভুট্টোরা নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে গেছেন। এবার দীলিপ বড়–য়া ও আ স ম আরেফিন সিদ্দিকীদের কাজটি শুরু হয়ে গেছে। সুধীদের সমাবেশে দিলীপ বড়–য়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তাতে দারুণভাবে উজ্জীবিত গদ্যলেখক আনিসুল হকেরা পদ্যের মাধ্যমে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভিলেইনের গায়ের রঙ, সাইজ, মুখের অবয়ব, গায়ের পোশাক সব স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা আছে। দেখা গেছে, ভিলেইন মনের মতো না হলে মানবতার এই ওঝারা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। ৭৮ বছর বয়স্ক ভাস্কর রশীদ আহমেদ ও তার পুত্রবধূ আট বছর ভারতের কুখ্যাত তিহার জেলে কাটিয়ে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য রয়েছে। এসব নান্দনিক পরিচয় ভারতের হোটেলে তার মুসলিম পরিচয়টি ঢিম বা অনুজ্জ্বল করতে পারেনি। টাকা জালিয়াতি চক্রের মিথ্যা অভিযোগে জেলে পুড়ে রেখেছে আট-আটটি বছর।
প্রিয় দাদু ও মায়ের এই ভয়ানক বিপদ ও বিরহে পরিবারের কিশোরী মেয়েটিও এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে বিদায় নিয়েছে। বাবা, স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে ভাস্কর্যের ছেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সিলেটের নূরজাহানের চেয়েও এই হতভাগা পরিবারের ট্র্যাজেডিতে মানবিক উপাদান কোনো অংশেই কম নেই। তার পরও এদের নিয়ে দেশের কিংবদন্তিতুল্য কোনো লেখকের কলম কখনোই ঝলসে উঠবে না। কারণ সবই ঠিক ছিলÑ স্থানটিই ঠিক নেই। মানবতার প্রতি দরদ প্রদর্শনের উৎসস্থল এদের মগজÑ হৃদয় নয়।
বিশ্ব প্রোপটে মানবতার চেহারাটিও খুব বেশি ভিন্ন নয়। একবার একটা তিমির বাচ্চা দলছুট হয়ে উত্তর মেরুর কাছাকাছি কোথাও বরফে আটকা পড়ে যায়। এটা নিয়ে সারা বিশ্বে তুমুল হইচই শুরু হয়ে যায়। শেষমেশ বরফকাটা জাহাজ পাঠিয়ে সেই তিমির বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বিশ্বের হৃদয়বান মানুষগুলো।
এবার এই তিমির বাচ্চার চেয়েও জটিল বরফের পাহাড়ে আটকা পড়েছে হাজার হাজার মানুষের বাচ্চা। এক তিমির বাচ্চার জন্য বিশ্ব মানবতার যে পেরেশানি ছিল এই হাজার হাজার মানবসন্তানের জন্য সেই পরিমাণ পেরেশানি ল করা যাচ্ছে না। নিজের দেশ থেকে তাড়া খেয়ে ওরা আমাদের উপকূলে ভিড় করছে। সমুদ্রে ভাসছে। আমাদের কোস্টগার্ড ও বর্ডার গার্ড ওদের ঢুকতে দিচ্ছে না। পৃথিবীতে এমন হতভাগা প্রাণী বোধ হয় আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের মাতৃভূমিতেই তারা ‘অবৈধ’ হিসেবে গণ্য হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে কষ্টের কথাটি হলো, এদের যারা কচুকাটা করছে সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একটা পিঁপড়া হত্যা করাকেও ‘মহাপাপ’ বলে জ্ঞান করত।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছোটখাটো নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী কিংবা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে যেকোনো রাজনৈতিক ও সামরিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর সমগ্র বিশ্ব। কিন্তু এ ধরনের কোনো ক্যাটাগরিতেই গ্রহবাসীর সহানুভূতিটি পাচ্ছে না রোহিঙ্গা নামক হতভাগা একটি জনগোষ্ঠী। এদের হাতে তেলের মতো কোনো সম্পদ নেই। ফলে কুয়েতের মতো পেট্রো-ডলার নিঃসৃত মায়াকান্না অনুপস্থিত। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়ার সম্মুখে শতাব্দীর সুযোগ (Opportunity for the Century ) সৃষ্টি হয়েছিল। এদের বেলায় তেমন ধরনের জিও-পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট নেই। এরা কারোর ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ বা এসেট হতে পারছে না। বরং দীপু মনিদের হৃদয়হীন বাংলাদেশসহ ওআইসির জন্য আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ক্ষতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এত দিনে হৃদয়ঙ্গম করেছে। কাজেই বিশ্বজনমতের বাইরে থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। অং সান সু চির ওপরও গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী বিশ্বের একটা সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সৃষ্টির উৎস বা সোর্সটি বন্ধ করার নিমিত্তে চাপের জায়গাগুলো আরো স্পষ্টভাবে বিশ্বশক্তির হাতের নাগালে এসেছে। সেই আসল জায়গায় চাপটি প্রয়োগ না করে বিশ্বশক্তি বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ভোঁতা মানবিক বোধটিকে শাণিত করার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড সৃষ্টি করলেও মুসলিম বিশ্বকে কাছে টানার তাগিদটি কখনোই অনুভব করেননি। ইন্ডিয়াকে যতটুকু কাছে টেনেছেন বাদবাকি বিশ্বকে ততটুকু দূরে ঠেলে দিয়েছেন। কাজেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বকে সামনে রেখে বিশ্ব জনমতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো সামর্থ্য, দক্ষতা কিংবা নৈতিক মনোবল কোনোটিই এ সরকারের নেই। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে নিজের আঙিনা থেকে অনেক দূরে ইরান-ইরাকের যুদ্ধ বন্ধের নেতৃত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ ও তার মাত্র বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বছরের এক রাষ্ট্রপতি। আর এখন ঘরের পাশে চরম মানবিক বিপর্যয়ে নিজের দরজায় খিল এঁটে ‘শান্তির মডেল’ নামে রচনাটি বিশ্বসভায় জমা দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে বাংলাদেশ।
কাজেই সহায়হীনের একমাত্র সহায় হিসেবে এই সরকার রোহিঙ্গাদের সাথে যে আচরণ করছে, তা অত্যন্ত অমানবিক ও নিষ্ঠুর বলে পরিগণিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মীয় চেতনা কিংবা মানবিক চেতনাÑ কোনো চেতনাতেই এই আচরণ ন্যায্য হচ্ছে না। মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলোকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এর বাইরে মুসলিম উম্মাহর একটা দৃশ্যমান বলয় বা উপস্থিতি রয়েছে। সেই বলয়ে আমরা এক স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক জাতি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছি। এই বলয়ের প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্ব থেকেই বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে এযাবৎ সবচেয়ে বড় সাহায্যের পোঁটলাটি এসেছে। অন্যরা এক টাকা দান করে দশ টাকার কথা শুনিয়েছে কিংবা পাঁচ টাকার কসরত দেখিয়েছে। কাজেই মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন ধরনের আচরণ বৈষয়িক বিবেচনাতেও আত্মহত্যার শামিল হচ্ছে।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন ত্রিশ-চল্লিশটি ট্রলারে করে রোহিঙ্গারা (মানুষ নয়) সমুদ্রে ভাসছে। এই তিন হাজার বনি আদম যখন অকূল পাথারে ভাসছে তখন মুসলিম উম্মাহর ৩০ লাখ হাজী লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা বলে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিচ্ছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশের এক লাখ। এই এক লাখ লাব্বাইকার জবাবে সৃষ্টিকর্তা (নিশ্চয় অভাগা রোহিঙ্গাদের তিনিই সৃষ্টি করেছেন) কী জবাব দিচ্ছেন জানি না।
সমুদ্রে একটা প্রাণীও যখন বিপন্ন হয়ে ভাসতে থাকে, তখন তাকে আশ্রয় দেয়া আশপাশে অবস্থানরত অন্য সবার জন্য বাধ্যবাধক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিপন্ন আত্মাকে উদ্ধার করার এই মানবিক বোধ মানুষের মাঝে অত্যন্ত প্রখরভাবে কাজ করে। আর আধুনিক বিশ্বে তা সার্বজনীন আইনে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি চুরি করেও সমুদ্রগামী পরিবহনে উঠে পড়ে (মেরিটাইম পরিভাষায় যাকে বলে Stowaway) তাকে আপদ মনে করে পানিতে ফেলে দেয়া বা মেরে ফেলা সমুদ্র আইনে মারাত্মক অপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের কথা বলে এ সরকার উঠতে-বসতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে চলেছে। নীরবতার জন্য জনগণও সেই অপরাধ শেয়ার করছে।
দুর্ধর্ষ সার্বরা ‘এথনিং কিনজিং’ শুরু করলে বসনিয়ার নির্যাতিত মুসলিম মেয়েরা ওআইসির কাছে শেষমেশ সাহায্য হিসেবে চেয়েছিল জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি। কিন্তু তজ্জন্য ওআইসির প্রস্তুতিটি তখন তেমন ছিল না। সে তুলনায় এবার হাতে বেশ খানিকটা সময় পাওয়া গেছে। কারণ যুগ যুগের অনভ্যাসহেতু ভিক্ষুদের এই কর্মটি শুরু করতে একটু সময় লাগতে পারে। আবুল মাল আব্দুল মুহিতদের জন্যও অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের সীমান্তজুড়ে শুধু হবে মায়াবড়ির কারখানা। আমাদের প্রতিবেশী আমাদের ডাইল (ফেনসিডিল) খাইয়ে যেভাবে ধনী হচ্ছে; একই কায়দায় আমাদের প্রতিবেশীদের আমরা খাওয়াবো ‘মায়াবড়ি’ রোহিঙ্গা সিস্টাররা চাহিবামাত্রই ওআইসির ব্রাদাররা দ্রুতগামী ইউএস নেভির বোটে চড়ে কন্ট্রাসেপটিভ সাপ্লাই দিতে সক্ষম হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বা শুধু ‘ওহ আইসি’ করার দুর্নাম এভাবেই ঘুচে যাবে।
ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামি ও নিউকিয়ার দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত জাপানের সম্রাট ও ধর্মরক্ষক তার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে ডাকেননি। আকাশের দিকে তাকিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, এসব কী হচ্ছে? স্যান্ডির ভয়ে পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার দেশের লোকজন ছয়টি শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ক্যাথরিনা, স্যান্ডি প্রভৃতির বাতাসের গতি ও রিখটার স্কেলের মাত্রাটির নিয়ন্ত্রণ কার হাতেÑ এই প্রশ্নটি মনে এলেই আকাশের পানে দৃষ্টি চলে যায়।
কাজেই বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী অবিশ্বাসীর মতো দাম্ভিক, অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হতে পারে না। এ সরকার শুধু সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসটুকুই মুছে ফেলেনি; জাতির আচার-আচরণ থেকেও মানবিক মূল্যবোধের সব রস শুষে নিয়েছে। সমুদ্রে ভাসমান চরম বিপদগ্রস্ত বনি আদমদের আত্মার প্রতি আমরা যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছি তাতে সত্যিই ভয় লাগছে, এর জন্য কোনো কালেকটিভ পানিশমেন্ট আল্লাহ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেন কি না। আল্লাহ আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা করুন। দেশের আপামর মানুষ নিষ্ঠুর নয়। একটা নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠী আমাদের ওপর চেপে বসেছে।
সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় এই পৃথিবী একটা অতি ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়েও নগণ্য। এর মধ্যে মানুষ হিসেবে আমরা অতি ক্ষুদ্র একটা জীব। যার বাহাদুরি (আয়ু) একটা কাছিমের চেয়েও অনেক অনেক কম। এগুলো নিয়ে না ভাবলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। আওয়ামী লীগ হয়ে পড়ে। সাবেক মন্ত্রীর চোখও তুলে ফেলতে চায়।
minarrashid@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads