রবিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১২

নাটের গুরু মুক্তিযোদ্ধা লীগের যুগ্ম সম্পাদক : দশ কোটি টাকার জালনোট


সরঞ্জামসহ গ্রেফতার ১০ : বাজারে ছাড়া হয়েছে ২০ কোটি : প্রস্তুতি ছিল ১০০ কোটির

নাছির উদ্দিন শোয়েব
তিনি মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও বাংলাদেশে জালটাকা তৈরির গুরু। তিনি ১৪ বছর ধরে জালটাকা তৈরির ব্যবসা করছেন। পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। কিছুদিন জেল খেটেছেন; কিন্তু জালটাকার ব্যবসা ছাড়তে পারেননি। এর মধ্যে বাজারে ছেড়েছেন কোটি কোটি টাকা মূল্যের জালনোট। রয়েছে তার অসংখ্য শিষ্য। তারাও গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে জালটাকার ব্যবসা করছে। গোয়েন্দাদের কাছে জালটাকা তৈরির মূল হোতা বলে পরিচিত এই ব্যক্তির নাম দুরুজ্জামান ওরফে নুরুজ্জামান মাস্টার ওরফে জামান বিশ্বাস (৫০)। যিনি মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তার ছোট ভাই অ্যাডভোকেট খালেদুজ্জামানকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সংঘবদ্ধ চক্র। তাদের রয়েছে জালটাকা তৈরির একাধিক কারখানা। দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিকভাবে জালটাকার ব্যবসা চালিয়ে আসছিল ওই চক্রটি।
১০ কোটি টাকার জালনোট ও সরঞ্জামসহ নুরুজ্জামান বিশ্বাস এবং তার ৯ সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শনিবার বিকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছাড়ার মুখ্য সময়টাকেই বেছে নিয়েছিল জালনোট তৈরির চক্রটি। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা বাজারে ছাড়া হয়। এর ঠিক একদিন আগেই গ্রেফতার হলো ১০ কোটি টাকার জালনোটসহ প্রতারক চক্রটি। গ্রেফতার করাদের মধ্যে চারজন নারী সদস্যও রয়েছে। এরা হলো—দুরুুজ্জামান ওরফে নুরুজ্জামান ওরফে জামান বিশ্বাস, তার ছোট ভাই অ্যাডভোকেট খালেদুজ্জামান, মো. বাবু মিয়া ওরফে তোতলা বাবু, সুজন ওরফে ডেসটিনি সুজন, মো. মঞ্জুরুল কামাল ওরফে কামাল মাস্টার, জালাল উদ্দিন, শান্তা ওরফে শাবানা, মোসা. মাকসুদা, লিমা আক্তার ও আ. রহমান। তাদের কাছ থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ২২ হাজার বাংলাদেশী জালটাকা, ৮৮ হাজার ভারতীয় জাল রুপি, প্রায় ৮ কোটি টাকার জালনোটের খসড়া, একটি ডেক্সটপ, একটি মনিটর, ৩টি ল্যাপটপ, ৬টি প্রিন্টার, বিভিন্ন রঙের ১২ হাজার কার্টিস, বাংলাদেশ ব্যাংকের জলছাপ, বঙ্গবন্ধুর ছবির জলছাপের স্ক্রিনপ্রিন্ট করার স্ক্রিন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ১০০০ লেখা ২ ব্যাগ নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন ধরনের বোর্ড ৫৭টি, স্ক্রিনপ্রিন্টের রঙ টানার রাবার ৬০টি, জালটাকা ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত নেগেটিভ, কাটার ব্লেট ৬০টি, সাদা, সোনালি, সবুজ ও লালসহ বিভিন্ন ধরনের রঙের ১২০টি কৌটা, ফেবিকল এপ্রিটন ব্যান্ডের আঠা ৭৫ কৌটা, তরল রিডিউচার ২২ বোতল, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ৩০ বোতল, স্টিলের স্কেল ৩৫টি, বিভিন্ন ধরনের আর্ট ব্রাশ ২৭টি, বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ান মুদ্রার ডাইস ২টি, বঙ্গবন্ধু/শাপলা/বাংলাদেশ ব্যাংক/১০০০ ও ৫০০ টাকার জলছাপ সংবলিত কাগজ ৪০ প্যাকেট, হাতুড়ি ৫টি, পার্স ৫টি, টাকা কাটার স্কেল মেশিন ১টি, নিরাপত্তা সুতা বানানোর জন্য ফয়েল পেপার ১ রোলসহ জালটাকা তৈরির আরও বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
নুরুজ্জামান বিশ্বাস গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে অকপটে জালনোট তৈরির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ১০০ কোটি টাকার জালটাকা বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি ছিল। এরই মধ্যে ২০ কোটি জালটাকা বাজারে ছাড়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (উত্তর) মাহবুবুর রহমান জানান, আটকদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। দেশে জালটাকা তৈরির মূল হোতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ চক্রের অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গতকাল গ্রেফতার করাদের ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এসময় নুরুজ্জামান নিজেকে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি বলে দাবি করেন। সঙ্গে থাকা দলীয় পরিচয়ের ভিজিটিং কার্ডও প্রদর্শন করেন তিনি।
জানা যায়, গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মশিউর রহমান ও এসি মাহবুব রহমানের নেতৃত্বে ডেমরা এলাকার বাঁশেরপুলের পাশে আমিনবাগ এবং কামরাঙ্গীরচরের পশ্চিম রসুলপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি নকল টাকা তৈরির কারখানার সন্ধান পান। এরপর ওই কারখানায় অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এডিসি মশিউর রহমান জানান, তার নেতৃত্বে শনিবার বিকালে ডেমরার বাঁশেরপুলে ফরমান খাঁ মার্কেটের পাশের ৩১ নম্বর আমিনবাগের একটি বাসার ৫ম তলায় অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৩০ লাখ জাল টাকা এবং ৫ কোটি টাকার জালনোট তৈরি করার বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করেন। এরপর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জালনোট কেনাবেচার অন্যতম হোতা ও কারখানার মালিক লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকির মাস্টারকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জালাল, শান্তাসহ অপর ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। জাকির মাস্টার জানান, তারা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জালটাকার ব্যবসা করে আসছিলেন। আর শান্তা ওরফে শাবানা তার অন্যতম কারিগর হিসেবে কাজ করে। গ্রেফতারদের তথ্যের ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচর পশ্চিম রসুলপুরের একটি ৫ তলা বাড়ির ২য় তলায় অভিযান চালিয়ে ৮৮ হাজার জাল ইন্ডিয়ান রুপি, ১ কোটি ২০ লাখ ২২ হাজার জালটাকাসহ আরও ৩ কোটি জালটাকা তৈরির উপকরণসহ বাংলাদেশী জালটাকা তৈরির প্রধান হোতা দুরুজ্জামান ওরফে মাস্টার ওরফে জামান বিশ্বাস ও তার ছোট ভাই অ্যাডভোকেট খালেদুজ্জামানকে গ্রেফতার করেন। দুরুজ্জামান কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর থেকে সারাবছর জালটাকার ব্যবসা করলেও আসন্ন ঈদ উপলক্ষে চলতি মাসের শুরুতে তার অন্যতম পাইকার কামাল মাস্টারের কামরাঙ্গীরচরের বাসায় এসে জালটাকা তৈরি শুরু করেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দুরুজ্জামান ওরফে মাস্টার ওরফে জামান বিশ্বাস বাংলাদেশে জালটাকার সূচনা করেন। প্রথম জীবনে তিনি রাজশাহীতে আকবর নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে একসঙ্গে আর্ট করতেন। ১৯৯৮ সালে আকবর তাকে সাদা-কালো ১০০ টাকার একটি নোট কালার করতে দিলে তিনি তা করে দেন। এরপর থেকে তিনি জালটাকা তৈরির পরিকল্পনা নেন। ’৯৯ সালের প্রথমদিকে তিনি রাজধানীর ধানমন্ডির জিগাতলায় বাসা ভাড়া করেন এবং ৭০-৮০ হাজার টাকা দিয়ে একটি কালার ফটোকপি মেশিন ক্রয় করেন। এরপর তারা কালার ফটোকপি দিয়ে নোটের উভয় পাশে ফটোকপি করার পর স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে তাতে বাঘের মাথার জলছাপ দিয়ে জালটাকা তৈরি শুরু করেন। প্রথমে কালার ফটোকপি দিয়ে নোটের উভয় পাশে ফটোকপি করার পর স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে তাতে বাঘের মাথার জলছাপ দেয়া হতো। পরে ফয়েল কাগজে হিট দিয়ে সিকিউরিটি সুতা বসানো হতো। জামান বিশ্বাস আরও জানান, তখন এক লাখ জালটাকার বান্ডিল ১০-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন প্রতিলাখ জালটাকা ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে দেশে ৮-১০টি জালনোট তৈরির সক্রিয় গ্রুপ রয়েছে। জামান বলেন, ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ জালটাকা বিক্রেতা হেলালকে গ্রেফতার করে। তার মাধ্যমে জামান বিশ্বাসকে কালার ফটোকপি মেশিন ও জাল টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। সে মামলায় ২১ মাস জেল খাটার পর জামান জামিনে বের হয়ে আবার সরঞ্জামাদি কিনে দেশে বাণিজ্যিকভাবে জালটাকা তৈরির বাণিজ্য শুরু করেন। জামান জানান, তার শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হলো—ছগির মাস্টার, হুমায়ুন, রাশিদুল, কাওছার, জাকির, আ. হামিদ, সেলিম, ইমন ও সুমন প্রমুখ। তারা জামানের কাছ থেকে জালটাকার দীক্ষা নিয়ে নিজেরাই জালটাকা তৈরি শুরু করে। জামান গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে তারা ১০০ কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। পুলিশ জানায়, গ্রেফতার করাদের বিরুদ্ধে ডেমরা ও কামরাঙ্গীরচর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের গতকাল ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads