শুক্রবার, ১২ অক্টোবর, ২০১২

বিশ্বে সরকারের আরেক বিরূপ চেহারা



মঈনুল আলম
হাসিনা সরকারের আরেক বিরূপ চেহারা প্রকাশ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ২ সেপ্টেম্বর পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষ বিস্তৃত চিত্র ও শিরোনাম সংবলিত প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ, র‌্যাব ও সামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে দেশের গার্মেন্ট শিল্পগুলোকে কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে রাখার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি এমন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনা সরকারের ‘ইমেজ’ বিশ্বের চোখে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই বছরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনে অসঙ্কুলান শ্রমিকদের বিক্ষোভ এবং পুলিশের সাথে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এর প্রতিরোধে বাংলাদেশের (ক্ষমতাসীন) নেতারা গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য রাষ্ট্রের সব নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রয়োগ করছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘একটি উচ্চপর্যায়ের সরকারি কমিটি গার্মেন্ট শিল্প খাতের ওপর নজরদারি করছে এবং এ কমিটিতে সামরিক, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি বিশেষ পুলিশ দল বহু শিল্প এলাকায় টহলদারি করে। অনেক শ্রমিক সংগঠনের ওপর গোয়েন্দা সংস্থা নজর রেখেছে। আমিনুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক সংগঠককে গত এপ্রিলে নির্যাতনের পর নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, গার্মেন্টের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর নির্মাতারা যারা যেখানে শ্রমিক মজুরি কম সে দিকে ছোটে, তাদের কাছে বাংলাদেশ হচ্ছে আকর্ষণীয়, বিশেষ করে চীনে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায়। প্রভাবশালী কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাককিনসে’ বাংলাদেশকে ‘আগামী চীন’ বলে আখ্যায়িত করে পূর্বাভাস দেয় যে ‘বাংলাদেশের গার্মেন্ট রফতানি, যা বর্তমানে বার্ষিক ১৮ বিলিয়ন ডলার তা ২০২০ সাল নাগাদ তিন গুণে গিয়ে দাঁড়াতে পারে’।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পগুলোতে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষে উদ্বিগ্ন হয়ে গার্মেন্ট ক্রয়কারী ১২টি প্রধান ব্র্যান্ড ও খুচরা ক্রেতাদের প্রতিনিধি দল গত জুলাইয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির দাবির ন্যায্য সমাধান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ ‘উদ্বেগের কোনো কারণ নেই’ বলে তাদের অনুরোধ উড়িয়ে দেন এবং এর সাথে উল্লেখ করেন ‘গার্মেন্ট ক্রেতা কোনো ব্র্যান্ড তো তাদের আমদানি অর্ডার বাতিল করেনি।’
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার গার্মেন্ট কারখানার মালিকেরা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, তাদের চাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবির বিস্তৃতিকে প্রতিরোধ করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গার্মেন্ট শিল্প মালিকেরা হচ্ছেন প্রধান প্রধান রাজনৈতিক চাঁদা দাতা ও তাদের মালিকানায় অনেক সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল চলছে। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছেন দেশের বৃহত্তম তিনটি বাণিজ্য সমিতির সদস্য। ন্যূনপক্ষে ৩০টি গার্মেন্ট শিল্পের মালিক অথবা তাদের পরিবারের সদস্য জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছে, যা সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার ১০ শতাংশ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেছেন, ‘রাজনীতি ও ব্যবসায় এমন ওৎপ্রোতভাবে জড়িত যে একে অপরের অঙ্গ হয়ে গেছে। গার্মেন্ট শিল্প এবং ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোয়ালিশন গঠিত হয়েছে। দাবিদাওয়া আদায়ের ব্যাপারে শ্রমিকদের অবস্থান খুবই সঙ্কীর্ণ হয়ে গেছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোজিটা নিটওয়্যারের শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন (দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলন মেটানোর পর) কাজে যোগ দিতে এলে দুইজন অফিসার তাকে ছোট্ট গার্ডঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলে। অফিসার দুইজন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্য। যে র‌্যাব ‘ক্রসফায়ার’ অজুহাত দিয়ে মানুষকে আক্রমণ করে হত্যা করার জন্য কুখ্যাত হয়েছে। একজন অফিসার হেলালউদ্দিনকে একটি পদত্যাগপত্রে সই করতে আদেশ দেন। আরেকজন অফিসার বলেন, ‘তুমি যদি সই না কর তোমাকে ক্রসফায়ারে ফেলে দেয়া হবে।’ বাধ্য হয়ে হেলালউদ্দিন তার পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুন মাসে সুইডিস রিটেইল গার্মেন্ট আমদানিকারক ‘এইচ অ্যান্ড অ্যাম’ বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে ঘন ঘন শ্রমিক বিক্ষোভে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অভিযোগ করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান করার আহ্বান জানায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের আমদানিকারকেরাও বদনাম কুড়াচ্ছে। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ নামীয় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অভিযোগ করে যে, ‘নাইকি’, ‘পিউমা’ ও ‘অ্যাডিডাস’ ব্র্যান্ডের জন্য গার্মেন্ট বানায় যে পাঁচটি কারখানা, সেগুলোতে শ্রমিকদের বাংলাদেশে ধার্য ন্যূনতম বেতনও দেয়া হয় না। গত মার্চে বাংলাদেশের একটি গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৯ নারী-পুরুষ শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার ওপর গৃহীত একটি ভিডিও প্রতিবেদন আমেরিকার একটি নিউজ চ্যানেলে প্রচার করতে গেলে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ‘টমি হিলফিগারের’ মালিক কোম্পানি ‘পিভিএইচ করপোরেশন’ ওই কারখানায় নিরাপত্তা সিস্টেম বসানোর জন্য এক মিলিয়ন ডলার (৯ কোটি টাকা) দান করে। ওই কারখানায় ‘টমি হিলফিগার’ ব্র্যান্ডের গার্মেন্ট বানানো হতো।
ওয়াশিংটনের একটি বাণিজ্য সংস্থা ‘ইউনাইটেড স্টেটস অ্যাসোসিয়েশন অব ইম্পোর্টার্স অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলের’ প্রেসিডেন্ট জুলিয়া হিউগস নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা বাংলাদেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে উন্নততর মান ও কর্মশর্তাদি দেখতে চায়। শ্রমিকদের বেতনভাতা অবশ্যই বাড়াতে হবে।’
তবে বাংলাদেশের অনেক গার্মেন্ট শিল্প মালিক বিশ্বাস করতে চান না যে, বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশের গার্মেন্টের জন্য অধিকতর মূল্য দিতে রাজি হবেন। শওকত আলী ভূঞা নামের এক গার্মেন্ট শিল্প মালিক বলেন, তার মুনাফার মার্জিন প্রায় শূন্য হওয়ায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ‘ওয়ালমার্ট’ ও ‘টার্গেট’-এর সাথে ব্যবসায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
কোনো কোনো শ্রমিক নেতা গার্মেন্টশ্রমিকদের শোষণের জন্য বিদেশী ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলোর চাপকে দায়ী করেছে। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা রায় রমেশচন্দ্র টাইমসকে বলেন, ‘পুরো সরবরাহ লাইনকে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সরকারকে আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে এবং শ্রমিক সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শর্তাদি পূরণ করতে হবে।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিজস্ব প্রতিবেদক জিম ইয়ার্ডলি বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে ঈশ্বরদীর গার্মেন্ট শিল্প এলাকার ডেটলাইন দিয়ে এ প্রতিবেদন ফাইল করেছেন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads