মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

শেখ হাসিনার রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং বিরোধী দলের ভূমিকা



অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে ২০০৮ সালের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আসীন হয়ে প্রায় চার বছর পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে আনীত ১৪টি মামলা হয়েছিল দুর্নীতি/অর্থ কেলেঙ্কারির। বিরোধী দলের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, হাসিনা ক্ষমতায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অন্যথায় নির্ঘাত তার ১০৮ বছরের জেল হতো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা। শেখ হাসিনা তার বিগত রাজক্ষমতায় রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ হয়েছেন। অর্থনীতির ফাঁক-ফোকর তিনি খুঁজে পেয়েছেন। এবার ক্ষমতায় এসে সেই পথটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এগিয়ে গেছেন। তার দলের সোনার বান্দাদের অর্থ আত্মসাত্জনিত যাতে মামলা না হয় তার জন্য কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিষয়ে ইনডেমনিটি বিল পার্লামেন্টে পাস করিয়েছেন। কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনগণ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না সত্য, কিন্তু মানুষের মনের ক্ষোভ কি শান্ত করতে তিনি পারবেন। কোটি কোটি টাকার অর্থ আত্মসােক এভাবে বৈধ করার জুটি আর কেউ কি আছে?
জননেত্রীর সোনার ছেলেদের ব্যাংক লুটের ঘটনা পরিকল্পিত। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে হলমার্কের কতিপয় ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সোনালী ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে জননেত্রীর দলীয় সন্তানদের পরিচালক বানিয়ে ব্যাংক লুটের ব্যবস্থা করা হলো। বলির পাঁঠা হলো অশিক্ষিত তানভীর মাহমুদ। নাটের গুরুরা সটকে পড়তে চেয়েছে। এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের সহায়তা দেবেন, অন্যথায় বেমক্কা সব ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ হলো, তার তদন্ত হলো, কিন্তু দোষীদের ধরা হলো না? কী কৈফিয়ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অবাঙালিদের শিল্প-কলকারখানা রাষ্টায়ত্ত করার নামে আওয়ামী সোনার ছেলেরা লুটপাট করেছিল। ধ্বংস করে দিয়েছিল বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থাপনা।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। এক সময় তিনি হাওর-বাঁওড়ের একজন পাকা ব্যবসায়ী ছিলেন। সেজন্য তাকে স্থানীয়ভাবে বলা হতো কৈবর্ত ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ জাতে কুলীন এবং কৈবর্ত জাতে নমশূদ্র। চর্চাপদে একটা ধারা ‘নগর বাহিরে ডম্বি তোহারি কুড়িয়া, ছোঁছো জায়সি ব্রাহ্মই নাড়িয়া।’ এটি বাংলা ভাষার আদিরূপ। অর্থ হলো—নগরের বাহিরে ডোমনির কুঁড়েঘর, নেড়ে বামুন তার ঘরের পাশে ঘুরঘুর করে। রাজনীতিতে আওয়ামী দলের অচ্ছুত থেকে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। শেষমেশ অর্থ কেলেঙ্কারিতে পড়ে একেবারে নাজেহাল। প্রধানমন্ত্রী কেন তাকে সাহায্য করছেন না বুঝলাম না। তার সঙ্গে কি বাবুর যোগাযোগ হয়নি। ‘ব্ল্যাক ক্যাট’ হয়েই কি তিনি নির্বাসনে যাবেন! তবে সুরঞ্জিত বাবুর একটি আত্মপ্রসাদ হচ্ছে আওয়ামী দলসহ একসঙ্গে বিসর্জন হতে যাচ্ছে আগামীতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব দুদক প্রধান গোলাম রহমান একজন প্রভুভক্ত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সরকারের দু’জন মন্ত্রী ও মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিত্বকে নিখুঁত ব্যক্তি বলে ঘোষণা দিলেন। কোনো দুর্নীতি ঘটেনি সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন দুর্নীতির কারণে তাদের পদচ্যুতি ঘটে, তখন সেবা দাসের ভূমিকা গ্রহণ করে বলেন, আন্তর্জাতিক তদন্ত হলে দুদক তাতে সহায়তা করবে এবং তা হবে বাংলাদেশের জন্য গৌরব। এ ধরনের অথর্ব কমিশন ব্যক্তি কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে? সরকারপ্রধান সুরঞ্জিত বাবুকে, আবুল হোসেন ও অন্য অপরাধী ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন; কিন্তু দেশের মানুষ বিষয়গুলো ভেবেছেন—তবে কি প্রধানমন্ত্রীও এদের সঙ্গে একই কাজের শরিক?
সত্য কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক জগতের অতুজ্জ্বল নক্ষত্র মাহমুদুর রহমানকে ৬০টির অধিক মামলায় জড়িত করা হলো। মাহামান্য সুপ্রিমকোর্ট তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাস জেল ও ২০০০ টাকা অর্থদণ্ডের পরিবর্তে ছয় মাস জেল এবং ১,০০,০০০ টাকা অর্থদণ্ডের এবং অর্থদণ্ড জমা না দিলে আরও এক মাস জেলের রায় দিলেন। রায় ঘোষণা হলো সত্য, কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস রায় আদালতের নথিতে এসে পৌঁছল না।
বাংলাদেশের অপর প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার ওপর বিশ্লেষণ করে রায় দিলেন. কিন্তু দীর্ঘ ১৩ মাস অতিক্রান্ত হলো। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। দু’বার রায় লিখলেন। পরে যখন রায় আদালতে এসে পৌঁছল, তার ১১ মাস আগেই হাসিনা সরকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অবসান ঘটালেন। বিচার ব্যবস্থার এই ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রবাহে দেশের বিচার ব্যবস্থার এক কলঙ্কজনক অধ্যায় যেমন সূচিত হলো, তেমনি রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
রাজশাহীতে মার্ডার কেসের ১ নম্বর আসামিকে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে মামলা প্রত্যাহার আদেশ দিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি বানানো হলো প্রধানমন্ত্রীর নেপথ্য ইশারায়। থার্ড ডিভিশন পাস করা নিম্নমানের আইনজীবীদের কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ জাতির জন্য কলঙ্কজনক ঘটনা। ফলে বিচার বিভাগের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বারবার। দলীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে সেসব বিচাপতির বাইরে আসার যোগ্যতা নেই। অর্থ কেলেঙ্কারি, মানিলন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত করে যখন বিচারপতিদের সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার পরও সরকার ও বিচার বিভাগ নিশ্চুপ থাকে, তখন স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ওপর দেশবাসীর কি আস্থা থাকে? মাহমুদুর রহমান ও অলিউল্লাহ নোমানের সাংবাদিকতা তখন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়। ভিয়েতনামের হো চি মিন সাংবাদিকতায় এক সময় সাড়া জাগিয়েছিলেন। রুমানিয়ার ভার্জিল তানাসের দুঃসাহসিকতা, পলি লুন্দ্রর সাংবাদিকতার সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের নাম বিশ্বে সমাদৃত হবে। দেশের দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হয় তখন সাহসিকতার সঙ্গে দেশপ্রেমিকদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তাতে দুঃখকষ্ট জীবনকে অতিষ্ঠ করলেও দেশের জন্য কণ্ঠ উচ্চকিত করার সময় এসেছে।
বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার একটি জঘন্যতম মানসিকতা হাসিনার মধ্যে লক্ষণীয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হত্যাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীসহ বাংলাদেশের জামায়াত ও শিবিরের নেতাদের আসামি করা, রিমান্ড লওয়ার তাণ্ডবতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি একজন আইনজীবী হিসেবে ঘটনাপরম্পরা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করা, প্রশাসনকে সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ রাখা, পুলিশ বিভাগের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণজনিত বিষয়গুলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক। এরূপ অবস্থা সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সরকারি দলের লোক, ছাত্র-যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চর দখল, জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে চলে গেলে এবং দলীয় প্রধানের তাদের অপরাধের প্রতি সমর্থনজনিত কারণে দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। দেশের মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। কিন্তু কীভাবে? দেশের বিরোধী দলের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রধানত এর জন্য দায়ী। জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রচণ্ড জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি জেলা শহরে অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে এমনকি কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় বিরোধী রাজনীতি জনগণের প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ। রাজধানী শহরে বিরোধী দল পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কেন? সত্ লোকের অন্তর্ভুক্তি দলে ঘটছে না কেন? দলীয় কোন্দল এখন প্রকাশ্যে বিদ্যমান। ভাবটা যেন এমন, আওয়ামী দল ব্যর্থ অতএব জনগণের বিকল্প কিছু নেই। বিএনপি ক্ষমতায় এলো বলে? রাজনীতি কি এতই সহজ। দলের মধ্যে অন্তর্কলহ ও বিভেদ থাকায় দল মানুষের ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ।
আওয়ামী দলের প্রধান শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে মামলা দিয়ে কেবল ক্ষান্ত নয়, পুলিশ দিয়ে গুম, খুন ও হত্যার কাজ করানো হচ্ছে। বিচারকরা অসহায়ের মতো রিমান্ড প্রার্থনা মঞ্জুর করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে একটি সত্য হলেও প্রতিবাদী কণ্ঠ হওয়ার জন্য রাজনীতিবিদকে ভূমিকা নিতে হবে। এ ব্যাপারে বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
দেশের বিবেকবান ব্যক্তিরা সরকারের বিরুদ্ধে টোলভিশনে কথা বলছেন, সাংবাদিকরা তাদের অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন; কিন্তু বিরোধী দলের ভূমিকা নগণ্য। যদি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন না করে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে কি বিরোধী দল তা প্রতিহত করতে পারবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিরোধী দলের সে ক্ষমতা বর্তমানে নেই। যারা ক্ষমতার প্রত্যাশী হয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তাদের কি দেশপ্রেমিক আখ্যা দেয়া যায়? একথা অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী দুঃশাসনে মানুষ বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত। দেশের অর্থনীতি দিন দিন পরাশ্রিত হচ্ছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুত্ বিলের যাঁতাকলে মানুষ নিষ্পেষিত। কৃষকদের দেখার কেউ নেই। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, সারের দাম আকাশচুম্বী। ভেজাল সার, ভেজাল বীজ সরবরাহ করে কৃষককে আওয়ামী সরকার ধ্বংস করছে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা নেই। বিরোধী দলের কথন হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী সরকার যাবে, বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসবে। আবার তারা যাবে, আওয়ামী দল আবার আসবে। কিন্তু মানুষ প্রত্যাশা করে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, সুশাসন থাকবে, অকল্যাণ দূরীভূত হবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। দেশে খুন-গুম হবে না। নিরাপদ বাংলাদেশ জনগণের কাম্য।
লেখক : সাবেক সভাপতি, রাজশাহী আইনজীবী সমিতি

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads