রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১২

বৌদ্ধবসতিতে হামলা এবং সরকারের ব্লেম গেম




সম্প্রতি কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে কুরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদল উগ্র হামলাকারী বৌদ্ধমন্দির ও পল্লীতে হামলা চালায় এবং বৌদ্ধদের মন্দির ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা নিঃসন্দেহে চরম গর্হিত একটি কাজ করেছে। এরা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এ দেশের বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত হেনেছে। এরা বিনষ্ট করেছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। এ ঘটনার মাধ্যমে এরা জাতীয় ভাবমর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছে। নিঃসন্দেহে এরা জাতীয় শত্রু। এরা নিন্দার পাত্র। এরা যেমনি জাতীয় জীবনের জন্য কলঙ্ক, তেমনি মুসলমান নামেরও কলঙ্ক। এদের প্রতি রইল শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা। এর বিপরীতে এ ঘটনার শিকার বৌদ্ধ সমাজের প্রতি এ দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি রইল ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি। কারণ এই হামলার হাত থেকে সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একটি দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাÑ এটি মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দোষে আমরা দোষী। এ কথা সত্য, রামু ও অন্যান্য স্থানের বৌদ্ধমন্দির ও পল্লীতে যারা এবার হামলা চালিয়েছে এদের বাহ্যিক পরিচয় ‘মুসলমান’ নামে। কিন্তু এরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা পায়নি। ইসলাম কখনোই নিরপরাধ কারো ওপর কোনো ধরনের হামলার অনুমোদন দেয় না। ইসলামে কোনো ব্যাপারেই কারো ওপর জোরজবরদস্তির স্থান নেই। এমনকি ধর্মের ব্যাপারেও জোরজবরদস্তিকে ইসলাম অস্বীকার করেছে। কুরআনে স্পষ্টত উল্লেখ আছে : ‘তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম।’
সুখের কথা, বৌদ্ধমন্দির ও পল্লীতে এই হামলার সময় ইসলামে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন মুসলমানকেও আমরা দেখেছি তাদের জীবন বিপন্ন করে এ হামলা প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে। এবং এরা কোনো কোনো স্থানে উগ্র হামলাকারীদের হাত থেকে বৌদ্ধদের রক্ষা করেছেন। একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক, তাদেরকে ‘Heroes of our time’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এরা দেখতে সাদাসিধে মানুষ। সাধারণ মানুষ বলেই এদের পরিচয়। এরা হচ্ছেনÑ মাসুদ রানা, হারুন, ওসমান, মোশাররফ, হেলাল ও কামাল। এরাই আমাদের ‘এ সময়ের বীর’। এরা এদের জীবন বিপন্ন করে আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে হামলাকারীদের ঠেকিয়ে দিয়ে শনিবার রাতে রক্ষা করেছিলেন চট্টগ্রামের চেংরাঘাটের প্যাগোডা। এদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম। গত ৩ অক্টোবর ডেইলি স্টার জানায়Ñ এদের প্রতিরোধেই সেদিন রক্ষা পেয়েছিল বৌদ্ধদের মন্দির ও বসতবাড়ি। রামুতে অগ্নিসংযোগের পর অন্যান্য স্থানেও উচ্ছৃঙ্খল কিছু মুসলমান যখন স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল, তখন মাসুদ ও তার বন্ধুরা আন্দাজ করতে পারলেন, এরা পাশের প্রতিবেশী বৌদ্ধদের ওপর হামলা করবে। মাসুদ ও তার বন্ধুদের প্রশ্নÑ একজন উত্তম কুমারের অপরাধে কেন বাকি বৌদ্ধরা হামলার শিকার হবে? দেখা গেল শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা মিছিলসহকারে বৌদ্ধবসতির দিকে আসছে। এরা সংখ্যায় ৫০ থেকে ৬০ জন। হাতে লাঠিসোঁটা ও দিয়াশলাই। তখন রানা ও তার বন্ধুবান্ধবেরা মাত্র ছয়জন। তারা প্রথমে ভাবলেন, ‘আমরা এই ছয়জন কী তাদের প্রতিরোধ করতে পারব?’ পরক্ষণেই ভাবলেন, ‘এরা স্থানীয় লোকজন। এরা সবাই আমাদের চেনে। এরা আমাদের ক্ষতি করবে না।’
এরা ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা এ কী করছ? ইসলাম কী এমনটি প্রচার করে? তোমরা একজন বৌদ্ধের অপরাধে সব বৌদ্ধকে কেন শাস্তি দিতে চাইছ?’
হামলাকারীরা বলল : ‘আমরা উত্তমের মাথা চাই।’ ওসমান জবাব দিলেন: ‘উত্তম এখানে থাকে না। এটা তার বাবার বাড়ি। তোমরা এখান থেকে চলে যাও। এ বাড়ি তোমরা ধ্বংস করতে পারবে না।’ হামলাকারীরা কিছু সময় ওদের সাথে কথা কাটাকাটি করে। একসময় তারা ফিরে যায়। তবে রানা ও মাসুদের আশঙ্কা ছিলÑ এরা আবার ফিরে এসে হামলা করতে পারে। তাই তারা খবর দিলেন তাদের আত্মীয়স্বজনকে। তারা এলেন। তাদের সংখ্যা দাঁড়াল ৩০ জনের মতো।
তাদের আশঙ্কা সত্যি হলো। রাত সাড়ে ১১টায় ৪০০ থেকে ৫০০ জনের একটি বিক্ষুব্ধ দল ফিরে এলো। এবার এরা আরো বেশি উগ্র। এরা কেউ স্থানীয় নয়। সময়ের সাহসী তরুণেরা এবার তাদের মুখোমুখি হয়ে বললেন : ‘তোমরা যদি মুসলমান হও, তবে তোমাদের উচিত আমাদের সাথে যোগ দেয়া।’ এরপরও অনেকে থামতে চায় না। মানুষের বাধা ঠেলে ভেতরে আসতে চায়। কেউ কেউ ইটপাটকেল ছুড়তে লাগলেন রানা ও তার বন্ধুদের ওপর। ওসমান মাথায় আঘাত পান। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। কে একজন লাঠি দিয়ে মোশাররফের হাতে আঘাত করে। এ সময় মানববাধা ভেঙে পড়ে। হামলাকারীদের কেউ কেউ বৌদ্ধ মঠে ঢুকে পড়ছে। রানা ও তার বন্ধু দৌড়ে গিয়ে তাদের বললেন : ‘এটি বড়–য়াদের (বাঙালি বৌদ্ধদের) মন্দির নয়। এটি রাখাইন মন্দির।’ এ কথা শুনে হামলাকারীরা শান্ত হলো। তবে কেউ কেউ মঠে আগুনও ধরাতে ব্যস্ত।  তখন রানা ও তার বন্ধুরা নিলেন অন্য কৌশল। তারা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা আগুন দিয়ো না। পাশেই মুসলমানদের বাজার। মঠে আগুন দিলে বাজারও পুড়ে যাবে। সাথে পুড়বে মুসলমানদের বাড়িঘরও।’ এভাবেই সেদিন এই বীর তরুণেরা চেংরাঘাট মঠটি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। আবারো তাদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা। বাংলাদেশকে বারবার বাঁচিয়ে তুলবে ধ্বংসের হাত থেকে এসব সাধারণ মানুষÑ অসাধারণ বীরত্ব যারা বারবার প্রদর্শন করে আসছে। ইতিহাস এর সাক্ষী।
দৈনিক প্রথম আলোর এক রিপোর্টে আরেকজন বীরের কথা জানা যায়। রিপোর্টে তার ভাষায় তার কথা আমরা জেনেছি এভাবে : ‘১০ ঘণ্টা পাহারা দিয়েছিলাম। একসময় দেখলাম, ওরা দল বেঁধে ধেয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল আর পারব না। মন্দিরের ফটকে আমি ওদের পায়ে ধরি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। আমাকে মাড়িয়েই ওরা ভাঙচুর শুরু করে। ওদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে আমি জ্ঞান হারাই।’
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছলেন উখিয়া ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনার প্রভাষক শাহ আলম। উখিয়ার শত বছরের লেজুড়কুল বৌদ্ধমন্দির ভাঙার সময় তিনি ছিলেন প্রতিবাদী মানুষ। এ থেকে এটুকু বোঝা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন মন্দির ও বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালানোর সময় অনেক মুসলমানও এর সক্রিয় প্রতিবাদী ছিলেন। এদের কেউ হামলা ঠেকাতে পেরেছেন, কেউ চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারেননি। এসব প্রতিবাদী মানুষ বাংলায় এখনো আছে বলেই হয়তো দেশটা এখনো টিকে আছে।
সন্দেহ নেই, যারা সম্প্রতি বৌদ্ধদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছে, বৌদ্ধমন্দির-মঠ আর বাড়িঘর জ্বালিয়েছে, এরা সীমাহীন অপরাধ করেছে। দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ চায় এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করা হোক। এরা নিশ্চিতভাবেই দেশ-জাতি এমনকি গোটা মানুষ জাতির শত্রু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ দোষীরা কি চিহ্নিত হবে? অপরাধীরা কি শাস্তি পাবে? এ প্রশ্ন এ জন্যই যে, যখনই এ ধরনের বড় কোনো ঘটনা ঘটে, তখন সরকারি দলই বলি আর বিরোধী দলই বলি, এসব ঘটনাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বিশেষ করে সরকার পক্ষই এ রাজনীতির সূচনাটি করে। আর বিরোধী দল তখন অনেকটা বাধ্য হয় নিজেকে রক্ষার জন্য বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে নিতে। তখন গোটা ঘটনাটি নিয়ে এক ধরনের ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। আর এতে করে জাতি প্রকৃত ঘটনাটি জানতে পারে না। মাঝপথ থেকে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এবারো চট্টগ্রামের বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দির পোড়ানোর ঘটনার ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটবে, এমন আশঙ্কাই প্রবল হয়ে উঠেছে। পত্রপত্রিকায় যেসব খবর আসছে তা থেকে এমনটিই আঁচ করা যায়।
গত ৩ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো ‘কার ইন্ধনে পরিকল্পিত হামলা’ শীর্ষক খবরে লিখেছে : ‘রাজনৈতিক নেতাদের সামনেই যে একের পর এক বৌদ্ধমন্দির, বসতবাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তা সবাই বলছেন। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এ দৃশ্য নীরবে দেখেছেন। ঘটনার শিকার বৌদ্ধরাও অভিযোগ করেছেন, হামলা প্রতিহত করতে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক ছিলেন না। তারা আন্তরিক হলে, এ ঘটনা প্রতিহত করা যেত।’
এ ঘটনা যদি সত্যি হয়, তবে সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু সরকারের লোকজন তো ব্যস্ত এর যাবতীয় দায় বিরোধী দলের ওপর চাপাতে। বলা যায়, সরকার এরই মধ্যে এর স্বভাবসিদ্ধ ‘ব্লেম গেম’ শুরু করে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে এসে বলেছেন, বিএনপি এমপি লুৎফর রহমান এ ঘটনা উসকে দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, এই এমপি তার সফরকারী দলের সাথে সাক্ষাৎ করেননি। এমপি ঘটনার শিকার বৌদ্ধদেরও দেখতে যাননি। তিনি তার লোকজন দিয়ে ফেসবুকের ছবি ছাপানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং হামলায় প্ররোচনা জোগান। প্রধানমন্ত্রীও বিরোধী দলের নামোল্লেখ না করে এ হামলার জন্য কার্যত বিরোধী দলকেই দায়ী করেই বক্তব্য দিয়েছেন দেশের বাইরে ও ভেতরে। সাহারা খাতুনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মহিউদ্দীন খান আলমগীর প্রকৃত দোষীদের বের করার ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নেবেন এমনটিই প্রত্যাশা ছিল দেশবাসীর। কিন্তু তিনিও সাহারা খাতুনের মতো ‘ব্লেম গেম’ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছেন। অতীতে আমরা দেখেছি, সাহারা প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের বদলে তিনি তদন্তকে ভুলপথে নিয়ে গেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার ব্যর্থতার শেষ নেই। আর মহিউদ্দীন খান আলমগীর সেই সাহারা খাতুনকে ’৭৫-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে সফল মন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেছেন। তার উচিত ছিল তদন্তের আগে এ হামলার জন্য বিএনপি এমপিকে না দুষে তদন্ত কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর সেই তদন্ত সূত্রে প্রকৃত দোষীকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো? কিন্তু তিনি তা না করে হাঁটলেন উল্টোপথে। শুরু করে দিলেন ব্লেম গেম। বললেন, বিএনপি এমপি লুৎফর রহমান হামলাকারীদের উসকে দিয়ে এই হামলা চালিয়েছিলেন। এ দিকে আমরা গত ৪ অক্টোবর দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছাপা হতে দেখেছি। ছবির ক্যাপশনটিতে লেখা ছিল : ‘কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কোটবাজার স্টেশন থেকে বের হওয়া এই সেই মিছিল, যেখান থেকে হামলা হয়েছিল পূর্ব রতœাপালং সুদর্শন বৌদ্ধবিহারে, মিছিলটির নেতৃত্বে ছিলেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরী (প্রথম সারির বাম থেকে সাদা চেক শার্টধারী ষষ্ঠ ব্যক্তি) ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক চৌধুরী (প্রথম সারির ডান থেকে হাফশার্টধারী চতুর্থ ব্যক্তি)। দুই আওয়ামী লীগ নেতার মাঝখানে (টুপি পরা) আওয়ামী লীগ সমর্থিত রতœাপালং ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল কবীর চৌধুরী ও হলুদিয়া পালং ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু চৌধুরী (বাম থেকে তৃতীয়)।’ ছবিটি যদি সত্যি হয়, তবে স্বরাষ্টমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনা ঘটানোর জন্য যেভাবে বিরোধী দলকে দায়ী করে চলেছেন, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এখানেই শেষ নয়। গত ৪ অক্টোবর নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘রামু বৌদ্ধ বিহারে আ’লীগ নেতাকে বড়–য়াদের ধাওয়া’ শীর্ষক একটি খবর ছাপা হয়েছে। খবরে শত বৌদ্ধ ভিক্ষু অভিযোগ করেছেন, রক্ষার দায়িত্ব যাদের তাদের সামনেই হামলা হয়েছে।
আসলে বর্তমান সরকার প্রতিটি ঘটনাকেই দেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত স্বার্থান্বেষী বিবেচনা থেকে। যার ফলে কোনো সমস্যা বা ঘটনার জন্য কে দায়ী তাদের নির্লজ্জভাবে আড়াল করা হচ্ছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক খাতের কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি ও অন্যান্য এমনি সব কেলেঙ্কারির কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। আজ শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টি করা হয়েছে নতুন করে অস্থিরতা। ছাত্রলীগের তালিকা অনুযায়ী কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় তিন সপ্তাহ ধরে বন্ধ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্যের বিরুদ্ধে জমি বিক্রির অভিযোগে অশান্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে বড় মাপের সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে কারা কাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে, পত্রপত্রিকায় সে ছবি ও খবর ছাপা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দৈনিক ইত্তেফাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ঘটনা নিয়ে ‘রাবিতে সেই অস্ত্রধারী যারা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গোলাগুলির ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে রাজশাহীর সুশীলসমাজ। পরদিন বুধবার রাজশাহীর সবার মুখে ছিল একই প্রশ্নÑ এরা কারা? এত আগ্নেয়াস্ত্র এরা কোথায় পেল? ছাত্রলীগের নামধারী এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের একাংশ মঙ্গলবার দুপুরে প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়াকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেছে। এক সহকারী প্রক্টরকে গুলি করতে উদ্যত হয়েছে এবং অপর প্রক্টরকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. গোলাম সাব্বির তপুকে ধাওয়া করেছে। এরপর এরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবন, উপাচার্যের বাসভবনের গেট ও পরিবহন ভাঙচুর করেছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড সহজেই মিডিয়ায় ধরা পড়েছে। রিপোর্টটিতে অবশ্য এ-ও উল্লেখ করা হয়Ñ ছাত্রশিবিরের অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যাওয়ায় তারা মিডিয়ায় ধরা পড়েনি। সে যাই হোক, রাজশাহীর ঘটনার খবর গণমাধ্যমে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের ব্যাপক সন্ত্রাসের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পরদিন এ ঘটনার জন্য দায়ী করে ২৮ শিবিরকর্মীকে আটক করা হয়। কিন্তু কোনো ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করা হয়নি। তা ছাড়া মামলা দায়ের করা হয়েছে শিবিরকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে দৈনিক প্রথম আলো গত ৪ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘পুলিশের সামনেই অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি, তবু গ্রেফতার নেই’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশ করে। খবরে বলা হয় : ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মঙ্গলবার ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করেছে। পুলিশের সামনেই এরা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে প্রায় অর্ধশত গুলি ছুড়েছে। তবে পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করেনি।
…অনুসন্ধানে জানা গেছে, অস্ত্র হাতে যারা হামলার সম্মুখভাগে ছিল, তারা ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের বিতর্কিত নেতা। নিজ দলের কর্মী হত্যা থেকে শুরু করে তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা পর্যন্ত রয়েছে। এদের একজন অছাত্র। সংঘর্ষের সময় ছাত্রশিবিরের এক কর্মীর হাতে পাইপগান দেখা গেছে। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। যারা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বহিষ্কৃত সহসভাপতি আখেরুজ্জামান ওরফে তাকিম, বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিন, উপপাঠাগার সম্পাদক নাসিম আহমেদ সেতু ও উপদফতর সম্পাদক আতিকুর রহমান। বহিষ্কৃত হওয়ার পরও ওই দু’জন ছাত্রলীগের সব কর্মকাণ্ডে নিয়মিত যুক্ত রয়েছে। সুদীর্ঘ রিপোর্টের বিস্তারিতে যাওয়া অসম্ভব। তবে এ ঘটনায় শিবিরের ২১ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তার বাদি ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন থানায় গিয়ে মামলাটি করলেও তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি।
আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্যই গত মঙ্গলবারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার খবরাখবর পত্রপত্রিকায় পড়েছেন। এসবও পড়েছেন, শিবিরের ২১ জন গ্রেফতার হলেও ছাত্রলীগের একজনও গ্রেফতার হয়নি। এসব ঘটছে যখন, তখন আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসব দেখে দেশের মানুষের মনে শঙ্কা জাগেÑ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনায় আপনার একইভাবে একচোখ বন্ধ থাকবে। ফলে অপরাধীরা পার পাবে। হয়তো নির্দোষকে দোষী বানানোর নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার চেষ্টা চলবে। তবে এসব দিয়ে কি আর শেষ পর্যন্ত পার পাওয়া যায়?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads