সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

পুলিশ তুমি কার ? বহমান এ নষ্ট সময়ে .




গোলাপ মুনীর

পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশবাহিনীর প্রচার-প্রচারণায় এমনটিই দাবি করা হয়। জনগণের অর্থে লালিত-পালিত পুলিশবাহিনীর ভূমিকা এমনই হওয়া উচিতÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের সেবার জন্য গঠিত এই বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিপ্রতীপ প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। সন্দেহ নেই সরকারপক্ষের দলীয়করণের মাত্রা যত বাড়ছে, পুলিশের কর্মকাণ্ড ততই জনবিরোধী হয়ে উঠছে। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ সম্প্রতি ‘কাকে সেবা দিচ্ছে পুলিশ?’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে। এই সম্পাদকীয়টির প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর আচরণ ও ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত, তাদের ওপর রাষ্ট্র যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, সে দায়িত্ব পালন করতে তারা সক্ষম কি না? দ্বিতীয়ত, তারা সে দায়িত্ব পালন করতে চাইলেও ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে বাধার মুখোমুখি হচ্ছে কি না? প্রতিটি সরকারই পুলিশ বাহিনীকে দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বর্তমান সরকার দলীয়করণের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তাদের আমলে দলীয়করণের দাপট বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে।’
পত্রিকাটির এই সম্পাদকীয় বক্তব্য সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশবাহিনীর প্রদর্শিত আচরণ এ সত্যিরই প্রতিফলন সুস্পষ্ট করে তোলে। আর এর সাম্প্রতিক জায়মান উদাহরণ তো আমাদের হাতের কাছেই, অতীতের সব উদাহরণ না হয় বাদই দিলাম।
গত ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী ঘটতে দেখলাম? আমরা দেখলাম, ওই দিন ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এ সময় পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র উঁচিয়ে মিছিল করেছে, ছাত্রশিবিরের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে; একপর্যায়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলে যৌথভাবে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করেছে। অস্ত্র হাতে হামলাকারী ছাত্রলীগকর্মীদের ছবি নামোল্লেখসহ প্রায় সব ক’টি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। আবার তারাই মতিহার থানায় গিয়ে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু পরদিন আমরা জানলাম, পুলিশ ২৮ জন শিবিরকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের আরো গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।  ছাত্রলীগের যারা থানায় গিয়ে মামলা করেছে, তাদের মধ্যে খুনের মামলার আসামিও ছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। অপর দিকে রাজশাহীর ঘটনার পরদিন দিনাজপুরে পুলিশের ছত্রছায়ায় আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্রাবাসে হামলা চালিয়ে শিবিরকর্মী সন্দেহে ৩০ জনকে পিটিয়ে আহত করেছে। এরা ছাত্রাবাসগুলোতে ব্যাপক লুটপাট করে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এতে সাধারণ ছাত্ররা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে পুলিশ ৩০ রাউন্ড টিয়ার শেল ও পাঁচ রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়ে। পুলিশবাহিনীর এই ভূমিকা নিয়ে দিনাজপুরে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
এ দিকে রাজশাহীর ঘটনার দিনে রাজধানীর নয়া পল্টনে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনায় মির্জা আব্বাসের গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালালে এ সংঘর্ষ ঘটে। তখন পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে আহত হন অর্ধশত বিএনপি কর্মী। ঘটনাস্থল থেকে ২৫ জনকে আটক করা হয়। এরপর প্রায় দুই দিন বিএনপি  অফিস অবরুদ্ধ করে রাখে। পুলিশের সাথে এ সংঘর্ষের ঘটনায় চার শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। পরদিন সকালে যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে তাকে পুলিশ রিমান্ডেও নেয়া হয়। গত ৯ অক্টোবর পুলিশের সামনেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ এক নারকীয় তাণ্ডব ঘটায়। এ সময় ছাত্রলীগের হামলায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে ওই দিন দুপুরে প্রগতিশীল ছাত্রফ্রন্টের ব্যানারে আন্দোলনরত সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ওপর ছাত্রলীগ ওই হামলা চালায়। আহতদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশের সামনেই এ নারকীয় হামলা চলেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। প্রশাসনের উসকানির কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। অপর দিকে ১০ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা একটি মিছিল বের করেন। পরদিন এই মিছিল সম্পর্কিত একটি ছবি দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। ছবিতে দেখা যায়, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এক ছাত্রকে গলা চেপে ধরে বাহুবন্দী করে রেখেছেন। অন্য দুই পুলিশ তাকে লাঠিপেটা করছে। পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, বিসিএস পুলিশ প্রশাসনের এই কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষে ডিউটিতে যোগ দিয়েই এই বীরত্ব দেখিয়েছেন। প্রথম আলোর এই ছবিটির ক্যাপশন ছিল এমন : ‘প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা গতকাল (১০ অক্টোবর) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের করলে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। অথচ ২ অক্টোবর পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের কর্মীরা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়লেও তাদের বাধা দেয়া হয়নি।’
এসব ঘটনা বারবার একটি প্রশ্নই সামনে নিয়ে আসে : পুলিশ তুমি কার? এ প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় গত ৬ অক্টোবর যখন এমপিওবঞ্চিত শিক্ষকদের রাজপথে বেধড়ক পেটাল এ দেশের পুলিশ। অথচ এদের কাছেই দু’অক্ষর শিখেছিলেন বলেই আজ তারা পুলিশবাহিনীর সদস্য হয়ে শিক্ষক পেটানোর সুযোগটুকু হাতে পেয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একান্ত বাধ্য হয়ে তাদের দাবি সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে তারা রাজধানীতে জমায়েত হয়েছিলেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত পিতা-মাতাতুল্য এসব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বয়সে প্রবীণ। তাদেরও পুলিশ নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে সরকারের হাতের পুতুল হয়ে। তাদের অপরাধ, তারা এমপিওভুক্ত হওয়ার দাবিতে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ডাকে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছেন। তাদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়েছে। লাঠিপেটা করেছে। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে অর্ধশত শিক্ষক। তাদের সকরুণ কান্নার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয় পরদিনের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। এসব সচিত্র প্রতিবেদন পড়ে দেশবাসী ব্যথিত ও পুলিশের আচরণ দেখে রীতিমতো শঙ্কিত। তাদের প্রশ্নÑ এ সরকার দলবাজিকে আর কত নিচে নামিয়ে পুলিশকে এভাবে ব্যবহার করবে?
যখনই সুবিধাবঞ্চিত মানুষ তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজপথে নামে; যখন বিরোধী দল সরকারের অত্যাচার, অনাচার, দুর্নীতি, অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে চায়; তখনই পুলিশকে আমরা অতি উৎসাহীর ভূমিকায় দেখি। পুলিশ তখন পরিণত হয় সরকারের ঠ্যাঙারে বাহিনীতে। কখনো পুলিশকে দেখা যায় বিরোধী দল দমনে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের সহযোগীর ভূমিকায়। অথচ এই পুলিশকে আমরা দেখেছি চট্টগ্রামের বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দির ও বসতির ওপর উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার সময় সন্দেহজনক নীরব ভূমিকা পালন করতে। বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ব্যাপারে ১ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় যে বিশেষ সম্পাদকীয় ছাপে, তাতে এ সত্যেরই প্রতিফলন রয়েছে। এ সম্পাদকীয়টির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয় : “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিয়াছেন যে, ‘সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে’ এই ঘটনা সংঘটিত করিয়াছে। তাহা হইলে জনগণের অর্থে প্রতিপালিত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কী করিয়াছে সেই প্রশ্ন তোলা যায়। গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায় প্রশাসনের ভূমিকা লইয়াও। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির এই যুগে ছোট্ট একটি উপজেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ ধরনের তাণ্ডব কিভাবে চলিতে পারিল এবং এত ভয়াবহ একটি ঘটনার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর চট্টগ্রামের পটিয়ায় কিভাবে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিতে পারিলÑ তাহা আমরা বুঝিতে অক্ষম। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, রামু কোনো দুর্গম কিংবা বিচ্ছিন্ন জনপদ নহে। কক্সবাজার জেলা সদর হইতে এই উপজেলাটির দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। সেইখানে প্রশাসন, পুলিশÑ সবই ছিল। সর্বোপরি ঘটনাস্থল হইতে বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনীর অবস্থানও বেশি দূরে নহে। প্রয়োজনে তাদের সহায়তাও গ্রহণ করা যাইত। অতএব ঘটনার কারণ যাহাই হউক এবং উহার জন্য যে বা যাহারাই দায়ী হউক, জনগণের মালামালের নিরাপত্তা বিধানে প্রশাসন যে ব্যর্থ হইয়াছে তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাইতে হইবে। পাশাপাশি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে প্রশাসন যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে তাহাও আমলে নিতে হইবে যথাযথ গুরুত্বের সাথে।”
যেকোনো ব্যক্তিই স্বীকার করবেন, ইত্তেফাকের এই সম্পাদকীয় বক্তব্য যথার্থ অর্থেই যৌক্তিক। আর তাই যদি হয়, তবে এ প্রশ্নও জাগেÑ প্রশাসন ও পুলিশের এ ব্যর্থতার পেছনে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা কি আছে? যদি থাকে তবে বিরোধী দলের দাবিই ঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। বিরোধী দলের দাবি হচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত হয়ে সরকারি দলের ইন্ধনেই এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর এ জন্য বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। এ দাবি কতটুকু সত্য তা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সন্দেহের বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে যখন গত পরশুর দৈনিক ইত্তেফাক-এ আরেকটি সংবাদ ছাপা হয়, যেটির শিরোনাম : ‘রামুতে হামলা, জেনেও নীরব ছিল পুলিশ’। এ সংবাদ পড়ে এ সন্দেহের মাত্রা আমাদের আরো বহু গুণে বেড়ে যায়। এ খবরে উল্লেখ করা হয় : ‘ওই দিনের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও গোয়েন্দা সংস্থা আগাম সংবাদ জানতে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, হামলার খবর জেনেও নীরব থেকেছে স্থানীয় থানার পুলিশ। তিন ঘণ্টা পর তারা শীর্ষ প্রশাসনকে বিষয়টি জানায়। কেন পুলিশ তিন ঘণ্টা নীরব ছিলÑ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হামলার ইন্ধনদাতাদের সাথে পুলিশ প্রশাসনের কেউ কেউ জড়িত, এমন অভিযোগও উঠেছে।’
আরেকটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, যারাই সরকারের বিরুদ্ধে বাদ-প্রতিবাদের কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে, তাদের পেছনেই পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিছিল-সমাবেশ হলেই সরকারের সাথে সাথে পুলিশেরও মাথা খারাপ হয়ে যায়। কোনো উসকানি ছাড়াই পুলিশ যখন-তখন মিছিল-সমাবেশের ওপর হামলা করে চলেছে। এর পর রাজনৈতিক নেতাদের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেনÑ বলছেন, তাদের কাছে খবর আছে এরা নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। আর সুযোগ পেলেই বলছে, এটা জামায়াত-শিবিরের কাজ। যেমন গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে সমমনা ইসলামি ১২ দলের মিছিলে হামলা চালানোর পর এক পুলিশকর্তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে এ মিছিলে ছিল জামায়াত-শিবিরের লোক’। সেই সাথে ‘জঙ্গি’ সন্দেহের কথা বলে যাকে যেভাবে পারছে গ্রেফতার করছে, এমন অভিযোগও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে। সে জন্য আজ প্রশ্ন উঠেছেÑ পুলিশ তুমি কার? বর্তমান সরকার পুলিশবাহিনীকে যেভাবে চরমভাবে দলীয়করণ করেছে, এরই জের খতিয়ান হচ্ছে এটি।
পুলিশের মামলা-হামলা ত্বরণ গতিতে চলছেই। কারণ, সরকারের মাথায় খেলছে একটা পরিকল্পনাইÑ কী করে দমন-পীড়ন করে বিরোধী দল ও মতাবলম্বীদের নিঃশেষ-নিস্তেজ করে দিয়ে জোরজবরদস্তি করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে কোনোমতে ক্ষমতার আসন আঁকড়ে থাকা যায়। তাই জনগণকে দেয়া একের পর এক প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছে এ সরকার। সে জন্যই হয়তো গত ১৩ অক্টোবরের দৈনিক সমকাল-এ আমরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখলাম, যার শিরোনাম ছিলÑ ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৭০ ভাগ বাস্তবায়ন হয়নি’।
প্রতিবেদনটি মতে, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পুলিশের সমস্যা নিরসনে কমপক্ষে ১৮টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার পৌনে চার বছরে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এসব প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করেনি। ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সমাজসেবা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। সেই সাথে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধের ঘোষণা দেন। দু’টি প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ৮ জানুয়ারি রংপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে রংপুরে গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দেন। সে ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়নি। একই বছর ৫ মার্চ খুলনার খালিশপুর জুটমিল উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেনÑ দৌলতপুর জুটমিল, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হবে। এর মধ্যে দৌলতপুর জুটমিল জোড়াতালি দিয়ে চালু করা হলেও অন্য দু’টি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া ঢাকায় পাতাল রেল/মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ, গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, ঢাকার চার পাশে বৃত্তাকার নৌপথ, বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল অন্যতম। এভাবে প্রধানমন্ত্রী তার দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার এবং ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নে দেশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কমপক্ষে ১৮৫টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এসব প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগের বাস্তবায়ন থমকে আছে।
সরকার যদি এই পৌনে চার বছর শুধু রাজনৈতিক কূটকচালে আর প্রশাসনের দলীয়করণে ব্যস্ত না থেকে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মনোযোগী হতো, তবে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৭০ শতাংশ প্রতিশ্রুতি আজ পর্যন্ত অবাস্তবায়িত থাকত না। প্রশাসনের দলীয়করণের প্রাবল্যে আজ পুলিশবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে যে ক্ষোভ একদম নেই, তা কিন্তু নয়। তা ছাড়া পুলিশবাহিনীতে বিবেকবান মনুষ নেই, সেটাও ঠিক নয়। কিন্তু সরকারের দলীয়করণের থাবায় এদের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগটি পর্যন্ত নেই।
এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, পুলিশের কিছু দলবাজের একটি গোষ্ঠী ছাড়া বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায় না। এরা চায় জনগণের পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু সরকার তাদের সেই নিরপেক্ষ ভূমিকা ও কাক্সিক্ষত সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার পথে আজ বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকার অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে ভিন্নমতাবলম্বী দমনে; রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণ স্বার্থে অপরাধ লালনে। এর ফলে অপরাধীরা অপরাধ করে পার পাচ্ছে। সেই সাথে পুলিশবাহিনীর ওপর অনেক অনাকাক্সিক্ষত দুর্নামের দায় পড়ছে। প্রশ্ন উঠছেÑ পুলিশ তুমি কার?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads