বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১২

ভিসিলীগ আর ছাত্রলীগের তাণ্ডবে অশান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়



প্রফেসর ড. মো. হারুনর রশীদ খান
গত ৪ অক্টোবর একটি দৈনিক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম ছিল ‘আবার শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা’। ওই খবর অনুসারে ছাত্রলীগের তালিকা অনুযায়ী কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় মাসাধিককাল শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ভিসির বিরুদ্ধে জমি বিক্রির অভিযোগ ওঠায় অশান্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত ছাত্রলীগ বনাম শিবির সংঘর্ষে। শুধু ওই দৈনিকটি নয়, দেশের সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ খবরগুলো গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়েছে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। সম্প্রতি খবরের আরেকটি শিরোনাম হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সুকর্ম (!)। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তার গাড়িবিলাস ও অর্থকাণ্ড। ভর্তি পরীক্ষার অর্থ থেকে বড় অংকের অর্থ গ্রহণেরও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। আমার কর্মস্থল যেহেতু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সেহেতু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। আমার যৌবনে আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শৈশবে আমি এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। এখানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২২ বছর আগে। ছোটখাটো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীতে কখনও সন্ত্রাস বা অন্য কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে পত্রিকার শিরোনাম হয়নি। পক্ষান্তরে দেশ-বিদেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচিতি লাভ করে রাজনীতিমুক্ত, সন্ত্রাস ও সেশনজটমুক্ত জ্ঞানচর্চার এক অনবদ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এখান থেকে ডিগ্রি অর্জনকারী ছাত্রছাত্রীরা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। শিক্ষকদের পিএইচডি ডিগ্রিসহ আরও কিছু শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে বছর দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে, যার মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শ্রেণীতে স্থান পায়। বিশ বছরেরও অধিককাল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, যেখানে জীবনের সব সোনালি সময় নিয়োগ করেছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন গৌরবের অংশীদার হতে পেরে গর্বে বুক ভরে যায়। কিন্তু কথায় বলে, এক পাতিল দুধে এক ফোঁটা গো-চনাই যথেষ্ট। তেমনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি, কর্ণধার এবং রক্ষক ভিসির বিরুদ্ধে একটি সুকর্মের (!) অভিযোগ আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইশ বছরে অর্জিত সুনাম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। বিগত দিনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাত্, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা ধরনের বাণিজ্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ভিসির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি প্লট আকারে বিক্রির অভিযোগ ওঠেনি। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীতে মনে হয় এটাই প্রথম যে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি ওই প্রতিষ্ঠানেরই কর্ণধারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনাটিই ঘটেছে সম্প্রতি আমার কর্মক্ষেত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাত্র ১০৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তান এবং পরে খুলনা আর্ট কলেজ স্থাপিত হয়েছিল এখানে। কয়েক মাস আগে অভিযোগ ওঠে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ভিসি মহোদয়ের সংশ্লিষ্টতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাবেষ্টিত কিছু জমি প্লট আকারে বাইরের ভূমিদস্যুদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতিবাদের মুখে নানা টালবাহানার পর ভিসি বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। আর এই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে জমি বিক্রির সঙ্গে স্বয়ং ভিসির সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ঘটনা আড়াল করার চেষ্টায় নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকে কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার জের ধরেই স্থগিত হয়ে যায় ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। প্রশাসন নানা ছুতোয় শোকজের নামে নানা ধরনের হয়রানি করতে থাকেন প্রতিবাদী শিক্ষকদের। ক্যাম্পাসে সচেতন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ ধরনের খবর এখন প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শিরোনাম হচ্ছে, যা দেখে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। যে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গত বিশ বছর গর্ব করেছি, এখন তা শুধুই অতীত। যা হোক, ভিসি মহোদয়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৫ অক্টোবর। মেয়াদ শেষের আগে কয়েক সপ্তাহ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে অফিসে আসতে পারেননি তিনি। সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে এখনও আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কবে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে, তা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা মূল্যবোধ আর নৈতিকতারই চরম অবক্ষয়। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের সমাজের নিচু থেকে উঁচু সব জায়গাতেই পচন ধরেছে। দেশের মানুষের মনে নিশ্চয়ই ভিসিদের এমন অবস্থা দেখে করুণা হচ্ছে। যারা এর আগে বুয়েটের ভিসির একগুঁয়েমি দেখেছেন, তাদের কাছে সেটা তখন নিশ্চয়ই খুব খারাপ উদাহরণ মনে হয়েছিল। কিন্তু তাদের কাছেও এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যে সর্বকালের সেরা উদাহরণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি ভাবি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি উঠেছে—তার চেয়েও খারাপ আর কি কোনো ঘটনা আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে? অনেক ভেবে দেখলাম, হ্যাঁ এর চেয়েও বড় আরেকটি ঘটনাই কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে, আর সেটা হলো—যদি কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে পারি সরকার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। বোধ করি সেটি কখনোই ঘটবে না বা কোনো সরকারই সেটা করবে না। তার মানে দাঁড়ায়, আমাদের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে, তার মধ্যে জঘন্যতম ঘটনাটিই ঘটে গেছে।
কিন্তু ভিসিলীগ খ্যাত এসব ভিসির মান-সম্মান এত হালকা নয় যে, মাত্র এতটুকু অভিযোগে বা অবাঞ্ছিত ঘোষণায় সেটা চলে যাবে।
যা হোক, এবার দৃষ্টি ফেরাই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ছাত্রলীগের তালিকা থেকে কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসাধিককাল ধরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল আর অবশেষে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বাস ভাংচুর করে পুড়িয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি বাইরে থাকা নয় হাজার ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি, ভিসিসহ প্রোভিসি এবং ট্রেজারার এই নিয়োগবাণিজ্যে জড়িত। অর্থাত্ একথা স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অচল অবস্থার জন্য প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বই দায়ী। অভিযোগ উঠেছে, ৯২টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে ছাত্রলীগের নেতারা কয়েকশ’ ব্যক্তির কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নামে অর্থ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ২০০ জনের একটি তালিকা প্রশাসনকে দিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু দেখা যায়, ৯২টি পদের বিপরীতে যে ১১২ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে ওই তালিকার মাত্র কয়েকজনের চাকরি হয়েছে। এ থেকেই শুরু হয় ছাত্রলীগের তাণ্ডব। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ভিসি স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের নেতারা তার কাছে একটি তালিকা দিয়েছিল যা থেকে কয়েকজনের চাকরি হয়েছে। মাসাধিককালের মধ্যে ভিসি পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাসে গেছেন মাত্র তিন দিন। নিরাপত্তার অভাবে তার গাড়ি রাখা হয় পুলিশ লাইনে। মোদ্দাকথা হলো, ছাত্রলীগের কাছে ১২ হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন তথা পুরো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি।
এবার আসা যাক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। গত ২ অক্টোবর ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ফিল্মি কায়দায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অস্ত্রে গুলি ভরা, অস্ত্র তাক করা এবং গুলি চালানোর দৃশ্য ছাপা হয়। এ সময় পুলিশকে অত্যন্ত অসহায়ভাবে নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। দেখে মনে হয় পুলিশ যেন তাদের সততা, মানবতা, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা সরকারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের এই তাণ্ডবে শিবিরের পাঁচ কর্মী গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ আহত হয় কমপক্ষে ৩০ জন—যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর ও সাংবাদিকও রয়েছেন। ছাত্রলীগের এই হামলার কারণ শুধুই তাদের আধিপত্য বিস্তার। পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের পরেও কেন তাদের গ্রেফতার করা হয়নি, এর কারণ জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের অভিযান ও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমার বিশ্বাস, তারা আইনের আওতায় আসবে।’ অন্যদিকে ভিসি বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে যে-ই জড়িত থাক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে। এজন্য সময়ের প্রয়োজন।’ যেখানে পুলিশের সামনে অস্ত্র ব্যবহার হলো, তখন হাতে-নাতে না ধরে এখন বলা হচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ বা ভিসির এ ধরনের বক্তব্য কেবলই ‘বক্তব্য’। কোনোদিন এর বাস্তবায়ন যে হবে না, সেটা সবাই জানে। অস্ত্রহাতে যাদের দেখা গেছে, তারা ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডার। তারা নিজ দলের কর্মী হত্যা ও ডাকাতিসহ অনেক অপকর্মের মামলার আসামি। এই ক্যাডারদেরই একজন আবার বাদী হয়ে শিবিরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে, যে মামলায় ভর্তিচ্ছুসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সরকারের উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো নীতিরই যেন আরেকটি প্রমাণ রাখল এই ছাত্র সংগঠনটি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে যা-ই করুক ‘কেষ্টা বেটাই চোর’। সব দোষই শিবিরের আর ছাত্রলীগ হলো সোনার ছেলেদের খনি। শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের ‘গুণ্ডা-বদমাশ’ বলেছেন, দুঃখ প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘দরিদ্র মানুষের টাকায় চলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি অমানুষ তৈরির জন্য?’ একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা মিছিল বের করলে বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ছাত্রীদের ওপরও আছড়ে পড়ে তারা। ছাত্রলীগের যে ক্যাডাররা নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে হামলা চালিয়েছে, তারাই আবার বাদী হয়ে হামলায় আক্রান্তদের নামে মামলা করেছে। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে প্রক্টর সরাসরি পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক ছাত্রীকে ঘুষি মারছেন। কী দারুণ প্রক্টরিয়াল দায়িত্ব পালন!
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ গত ৮ জুলাই সিলেটে এমসি কলেজের শতবছরের পুরনো ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে পুড়ে ফেলে। শিক্ষামন্ত্রী এ দৃশ্য দেখে তখন কেঁদে ফেলেছিলেন। মাননীয় মন্ত্রীর মনের কোমলতায় সাধারণ মানুষ অভিভূত। কিন্তু মন্ত্রীকে তো কাঁদলে চলবে না, হুমকি-ধমকি দিয়ে কিংবা নীতিকথার অমিয় বাণী দিলেও চলবে না। এসব সন্ত্রাসীর কবল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও জনগণের জানমাল রক্ষার কাজটিও তাকেই করতে হবে। মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগ সামলান।’ কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তা করেছেন? বেপরোয়া ছাত্ররাজনীতির কুফলে আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, ফাও খাওয়া, ডাকাতি, খুন, হাইজ্যাক, ছিনতাই, অপহরণ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কিংবা ধর্ষণ—এর প্রতিটি অপকর্মেরই অভিযোগ আছে এই সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এদের সন্ত্রাসী হামলায় এ সরকারের মেয়াদে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগাম, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে গেছে ২৩টি তরতাজা টগবগে তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন। এদের কারণে ছোট-বড় নানা ধরনের সংঘর্ষে ৭৫টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের এমন অপকর্মে এবং দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন; কিন্তু তার এই ঘোষণা খুব বেশিদিন বলবত্ থাকেনি। ছাত্রলীগের কাউন্সিলে তিনি আবার তাদের আদর করে কাছে টেনে নেন। সরাসরি ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া এই ছাত্রলীগের তাণ্ডবের কাছে অসহায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ এমনকি পুলিশ প্রশাসনও। সারাদেশে ছাত্রলীগ যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, তা দেখলে মনে হয় সরকারি মদতপুষ্ট ছাত্র নামধারী এই বাহিনী সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বর্তমান মেয়াদের চেয়ে কিছুটা কম থাকলেও তখনও তারা সারাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনকি বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। সে সময় ছাত্রলীগের এক ক্যাডার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শততম ধর্ষণের উত্সব পালন করে।
শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মূলমন্ত্র সামনে রেখে যে ছাত্রলীগের জন্ম—সে ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ড এখন শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির অন্তরায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নিয়োগবাণিজ্যের খায়েশ পুরো না হওয়ায় তারা গাড়ি ভাংচুর এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে ক্ষতি করেছে তিন কোটি টাকার বেশি; কিন্তু মামলা হয়নি একটিও কিংবা গ্রেফতারও হয়নি কেউ। নিয়োগকেন্দ্রিক সমস্যার কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে যে সময় হারিয়ে যাচ্ছে, তার দায়ভার কে নেবে? এ ব্যাপারে পুরোপুরি দায়ী ছাত্রলীগ এবং ভিসি-প্রোভিসিলীগ যারা—সবাই সরকারেরই মদতপুষ্ট। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক্তভোগী এসব ছাত্রছাত্রী বা তাদের অভিভাবকদের কী জবাব দেবেন? অন্যদিকে সম্প্রতি সন্ত্রাসের আশঙ্কায় দু’দিন ধরে বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। মামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি, নেতাকর্মীদের গ্রেফতারও করা হয়েছে পাইকারিভাবে। ভাবতে অবাক লাগে, এ কোন দেশে বাস করছি আমরা? পত্রিকায় প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ছবি ছাপা হয় এক দলের আর আসামি গ্রেফতার হয় অন্য দলের। গুলিবর্ষণের এই কাজটা যদি শিবির বা ছাত্রদল করত, তাহলে পুলিশের ভূমিকা কি একই ধরনের হতো? যারা গুলিবর্ষণ করল, তারা নাকি ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ক্যাডার। তাহলে তাদের ক্ষমতার উত্স কোথায়? তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি (!) বলে তাদের জন্য খুন-খারাবি, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট সবকিছু জায়েজ? সাধারণ জনগণ সরকারের এ ধরনের নীরব ভূমিকা দেখে ভেবে নিতে পারে ছাত্রলীগ তাদের ওপর সরকার অর্পিত দায়িত্বই ইমানদারীর সঙ্গে পালন করছে মাত্র।
দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতার এই বরপুত্রদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এবং জিম্মি। তাদের অপ্রতিরোধ্য কুকর্ম দেখে মনে হয়, গোটা দেশই তাদের হাতে জিম্মি। ক্ষমতাসীনদের হাতে দেশ জিম্মি, ছাত্রলীগের হাতে ভার্সিটি জিম্মি আর মন্ত্রীদের কাছে মন্ত্রণালয় জিম্মি। অন্যদিকে হলমার্কের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজে জিম্মি ব্যাংকিং খাত আর পুলিশের কাছে জিম্মি বিরোধী দলের কার্যালয়। কী চমত্কার গণতান্ত্রিক সুব্যবস্থা! এই কি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দাবিদারদের আসল চেহারা? রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেই ছাত্রলীগ আজ এত বেপরোয়া। আর পুলিশ যেন পানি হয়ে গেছে, যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন তার আকার ধারণ করবে। তাদের নিজেদের কোনো আকার বা সত্তা নেই। তারাও হয় অসহায়, নয়তোবা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। গায়ের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সরকারের যে পুলিশ বাহিনীর বিকল্প নেই, তা বোধকরি পুলিশরাও ভালো করেই বুঝে গেছে।
এ সরকারের আমলে কোথাও কোনো দুর্নীতি হয়নি বলে দাবি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সাধারণ জনগণের তো এটাই চাওয়া ছিল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, রেলের ৭০ লাখ টাকা, হলমার্কসহ অন্যান্য দুর্নীতি যদি আমলে নাও আনি, তারপরও শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত সাড়ে তিন বছরে যে নজিরবিহীন নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা ধরনের দুর্নীতি হয়েছে— সেগুলোর ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের ব্যাখ্যা কী তা আমরা সাধারণ জনগণ জানি না। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ আর সেই মেরুদণ্ড ভিসিলীগের ভিসিরা ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতায় শত শত অযোগ্য, অদক্ষ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে বাঁকা করে ফেলেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতীতে এর চেয়ে দুঃসময় আর কখনও আসেনি। নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের এসব ক্যাডার একসময় আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিতে আসবে। তখন দেশের অবস্থাটা কী হবে? সাধারণ জনগণের ছাত্র নামধারী এসব রাজনৈতিক সন্ত্রাসী, তারা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বয়কট এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা উচিত। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের বেশিরভাগ নেতা, মন্ত্রী কিংবা আমলার ছেলেমেয়েরা এদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে না। তারা বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এদেশেরই অর্থে লেখাপড়া করে। সুতরাং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের সন্ত্রাস, দুর্নীতি জিইয়ে রাখায় কিছু যায় আসে না। যত সর্বনাশ সব হবে আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের। তাই তো দেশের এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্র খুন হয় কিংবা যত দুর্নীতি হয়, তার বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা বসে আছেন, তারা সব দেখেন তবু অন্ধ, সব শোনেন তবু বধির, সব বুঝেও তারা নির্বোধ। ক্ষমতা দুর্নীতি বাড়ায় আর একচ্ছত্র ক্ষমতা দুর্নীতির ভেতরে সারাদেশকে ডুবিয়ে দেয়। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন তাদের অসীম, একচ্ছত্র ও জবাবদিহিমুক্ত ক্ষমতার সুযোগে সারাদেশ আজ দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। তবু আমরা আশা করি, রাষ্ট্র এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, আমরা পাব একটি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল,
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads