মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

ঠিকানার জন্য রিমান্ড এবং বিপর্যস্ত গণতন্ত্র



মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন
খবরটি পড়ে একে সরকারের অসহিষ্ণু নীতি ও কূটকৌশলের বহিঃপ্রকাশ বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এমন আরেকটি নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। সোয়া দুই বছর আগে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তার অফিস থেকে গ্রেফতার করার বিরুদ্ধে পত্রিকাটির কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীরা তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের এ প্রতিক্রিয়াকে সরকারি কাজে পুলিশকে বাধা দেয়া হয়েছে বলে অভিহিত করে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ৪০০ সাংবাদিক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা দায়ের করা হয়। গত তিন বছর ১০ মাসে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগসহ প্রায় আট হাজার মামলা তুলে নেয়া হলেও এ মামলাটি এখনও ঝুলে আছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খুনের আসামি হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছে। শত শত খুনি অবৈধ অস্ত্রধারী চারদিকে কিলবিল করছে। এদের কারও কারও হাতে পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তা চড়-থাপ্পড় খেয়েছেন। পাবনার ডিসিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই সরকারি দলের ক্যাডার-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু তাদের দেখে পুলিশ সালাম দেয়। তারা খুন করেও মাফ পেয়ে যায়। দুর্নীতির কারণে পদত্যাগ করেও ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাবে ভূষিত হয়। কারণ তারা সরকারের বরকন্দাজ।
অন্যদিকের দৈনিক আমার দেশ-এর সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে ভিন্নমতাবলম্বী। এদের কোণঠাসা ও অকেজো করতে হবে, এদের মুখ তথা দৈনিক আমার দেশ কৌশলে বন্ধ করতে হবে। তাই আজগুবি অজুহাত। ৪০০ সাংবাদিক-কর্মচারীর সঠিক ঠিকানা সংগ্রহের জন্য জামিন বাতিল করে তাদের রিমান্ডে নিতে হবে। কেমন জঘন্য যুক্তি? রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ৩৪ আসামির কাউকেই রিমান্ডে নেয়া হয়নি। পাকিস্তান আমলে আমার মতো হাজার হাজার ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একাধিকবার কারারুদ্ধ করা হয়, কিন্তু কাউকেই রিমান্ড নামক টর্চার সেলে নেয়া হয়নি। জিজ্ঞেস করা হয়নি—কেন কিংবা কার প্ররোচনায় তুমি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগিয়েছিলে।
এখন স্বাধীন দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ছুতা-নাতা অজুহাতে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার-অপমান করা হয়, তাদের ‘সোজা’ (?) করতে। সে পন্থার অংশ হিসেবে সোয়া দুই বছর আগে দায়ের করা মামলায় জামিনপ্রাপ্তদের জামিন বাতিল করে তাদের আবার রিমান্ডে নেয়ার অজুহাতে আবার খোঁয়াড়ে ঢোকাতে হবে। ওই অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে কী ধরনের বাধা দেয়া হয়েছে, কীভাবে বাধা দিয়েছে, তাদের হাতে কোনো অস্ত্র কিংবা লাঠিসোটা ছিল কিনা? ওই বাধায় কোনো পুলিশ আহত হয়েছিল কিনা, বাধা দেয়া হলে মাহমুদুর রহমান কীভাবে গ্রেফতার হয়েছিলেন? যদি তাদের কর্মকাণ্ড বেআইনিই হয়ে থাকে, তবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে কেন গ্রেফতার করা হয়নি, কিংবা আদালত জামিন দেয়ার সময় কেন তাদের রিমান্ড চাওয়া হয়নি। এ ধরনের অজুহাতে রিমান্ডের দাবি অহেতুক বলেই আদালত তাদের রিমান্ডে দেয়নি।
দ্বিতীয়ত, ৪০০ সাংবাদিক তথা আসামিদের নাম-ঠিকানা জানার জন্য তাদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন আজগুবি চক্রান্ত। আড়াই বছর পরে তাদের নাম-ঠিকানার কেন প্রয়োজন হলো? যদি একান্তই প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে কি তাদের সঠিক ঠিকানা প্রদানের জন্য কখনোই তাগিদ দেয়া হয়েছিল? তারা কি তেমন তাগিদে সাড়া দেননি? দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলেই তো ঠিকানা পাওয়া যেত। কিন্তু পুলিশ তেমনটি করেছে বলে মনে হয় না। যদি করেও থাকে তথাপি তাদের রিমান্ডে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই। পুলিশ বিষয়টি আদালতের গোচরে এনে আদালতের মাধ্যমেই তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারত। এ তিনটি বিকল্পের কোনোটাই না করে পুলিশ কর্তৃক তাদের জামিন বাতিল করার আবেদন জানানোকে নিছক চক্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললে অত্যুক্তি হবে না।
শেখ হাসিনা সরকারের মানবতাবিরোধী দমননীতির কূটকৌশল সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন, এমন তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করে, রিমান্ডের আবরণে জামিন বাতিল করা গেলে তাদের প্রসঙ্গে অজানা ও সাজানো অভিযোগ এনে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের করা হতে পারে, কিংবা বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক রাখা হবে এবং তাদের অনেককেই আগামী নির্বাচনের আগে আর ছাড়া নাও হতে পারে। উদ্দেশ্য হলো দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাকে অচল করে দেয়া, যাতে সরকারের ব্যর্থতা ও গণবিরোধী কার্যক্রম জনগণের সামনে তুলে ধরার সামান্যতম সুযোগও না থাকে।
পুলিশ বিভাগসহ সর্বত্র দলীয় বিবেচনায় দলীয় ক্যাডার-কর্মীদের নিয়োগ দিয়েও শেখ হাসিনা সরকার পরবর্তী নির্বাচনে যে ক্ষমতায় ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত হতে পারছে না। বিরোধী দলকে পুলিশি হামলা ও সাজানো মামলার পর মামলা দিয়ে কোণঠাসা করা গেলেও দৈনিক আমার দেশকে সেভাবে দমানো যাচ্ছে না। মাহমুদুর রহমানকে দীর্ঘদিন জেলে রেখে এবং নির্যাতন চালানোর পরেও তিনি আরও নির্ভীক ও সোচ্চার হচ্ছেন দেখে সরকার উদ্বিগ্ন। সরকারের এখান থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। শুধু মাহমুদুর রহমান কেন, পৃথিবীতে যুগে যুগে যারা অকারণে নির্যাতিত হয়েছেন, যারা সত্যের জন্য দেশের জন্য লড়েছেন, তারা কখনোই নির্যাতনের মুখে সত্যকথন থেকে পিছপা হননি। আর বাংলাদেশের মানুষ যে হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে গণবিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করেছে, তেমন হাজার হাজার নজির রয়েছে। সরকার সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে, দেশে সবাইকে কথা বলার লেখার মত প্রকাশের সুযোগ দেবে—সে প্রত্যাশিত পথকে সঙ্কুুচিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে সরকার দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।
আরও উদ্বেগজনক খবর হলো দৈনিক আমার দেশ-এর বাউফল সংবাদদাতা জলিলুর রহমানকে লাঞ্ছিত করেছে বাউফল উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদ। জলিলুর রহমানের অপরাধ, ২৩ অক্টোবর রাতে পটুয়াখালীর বাউফলে সর্বজনীন কালীমন্দিরে প্রদত্ত ভাষণে জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ আ স ম ফিরোজ এমপি সাংবাদিকদের ‘কুলাঙ্গার’, ‘মোনাফেক’ ও ‘বেইমান’ বলে ধিকৃত করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, জলিলুর রহমানের পাঠানো সে খবর ২৫ অক্টোবর (২০১২) দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত হয়। এ খবর প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে আ স ম ফিরোজ এমপির সতীর্থ হারুন অর রশিদ ও তার সঙ্গীরা ওই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেয়ারও হুমকি দেয়। এ ঘটনা বাউফল থানার সামনেই ঘটে। কিন্তু পুলিশবাহিনী সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকেই গ্রেফতার করেনি, কিংবা মামলাও দায়ের করেনি। যদিও অতি তত্পর ও দক্ষ পুলিশ ঠিকানা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় কথিত বাধা দেয়ার অভিযোগে ৪০০ সাংবাদিককে রিমান্ডে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। কারণ পুলিশ সরকারের একান্ত সেবক—জনগণের নয় এবং পুলিশ সরকারের অ্যাজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে, তাই তাদের এমন পরস্পরবিরোধী দ্বিমুখী আচরণ।
সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, মিডিয়া মন্ত্রীদের ব্যাপারে কোনো অসত্য খবর প্রচার বা প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দেবেন। সুতরাং দৈনিক আমার দেশ-এর বাউফল সংবাদদাতা মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত খবর দিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে মামলা করাই ছিল আইনগত ব্যবস্থা, তাকে লাঞ্ছিত করা নয়। কিন্তু মামলা দেয়া হয়নি, কারণ ফিরোজ এমপি যথার্থ এ ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত খবর যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা কিন্তু শেখ হাসিনা বলেননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন মন্তব্য এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড এমন ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে মু্ক্তচিন্তা তথা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ তথা অধিকার দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের একহাত দেখিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, বরং সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের কুপোকাত করতে নানা ধরনের গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী অপকৌশল অবলম্বন করছেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে টিভি চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয়া হয় দৈনিক আমার দেশ। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে অপমান-নির্যাতন করা হয়। ১০ মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়। আর ওই মামলার হাজিরা দেয়ার জন্য তাকে এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর করা হয়। বন্ধ করা হয় শীর্ষ কাগজ ও শীর্ষ নিউজকে। আটক করা হয় এর সম্পাদক একরামূল হককে। কারারুদ্ধ করা হয় দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক আবুল আসাদকে। ডিবি অফিসে গোয়েন্দাদের সামনে হাজির করা হয় একই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নুরুল আমিনকে। আদালতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ডেইলি নিউএজ-এর সম্পাদক নুরুল কবিরকে, কলামিস্ট আসাফ উদ-দৌলা ও আবুল মকসুদকে। তিন বছর ১০ মাসে প্রাণ দিতে হয় ১৭ সাংবাদিককে।
অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ‘তথাকথিত সম্প্রচার আইন ১৯১১’ নামক খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ১৯১৪ সালে আবার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার তা বাস্তবায়ন করার অভিলাষ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ স্পষ্ট করে বলেছেন, তারা বাকশালী আদর্শ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাকশালী আদর্শ মানে একদলীয় একব্যক্তির শাসন। দেশে অঘোষিতভাবে এক ব্যক্তির শাসনই চলছে। সরকারি নীতির প্রতি সদয়শীল নন, এমন পত্র-পত্রিকা তো বটেই, ভিন্ন মতাবলম্বী হিসেবে পরিচিত কাউকেই সহ্য করা হবে না। এ নীতি অনুসারে সরকারি নিয়ন্ত্রণে সীমিতসংখ্যক পত্রিকা থাকবে। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সব ক্ষেত্র দলীয় ক্যাডারে সয়লাব হয়ে যাবে। ক্যাডারদের ব্যবহার করে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোণঠাসা তথা নির্মূল করা হবে। পুলিশি কাজে বাধার অভিযোগে সোয়া দুই বছর আগে দায়ের করা দৈনিক আমার দেশ-এর চারশ’ সাংবাদিক-কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে উদ্দেশ্যমূলক মামলার আসামিদের জামিন বাতিল করে তাদের সঠিক ঠিকানা সংগ্রহের জন্য রিমান্ডে নেয়ার পুলিশের আবেদন একত্ববাদী শাসনের অশনি সংকেতের আরেকটি নজির।
সরকারের যেসব নীতিনির্ধারক বিভিন্ন অজুহাতে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ড নামক নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে অপমানিত করছেন, তারা অবশ্যই জানেন, তত্কালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহ আগরতলা মামলার কোনো আসামিকেই রিমান্ডে নেয়া হয়নি। আজকে স্বাধীন দেশে আমাদের সরকার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যেসব জঘন্য পন্থা অবলম্বন করছে, তা কেবল মরহুম সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিনীয় যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিন্নমতাবলম্বীদের উচ্ছেদকল্পে তাদের গ্রেফতার, অভ্যন্তরীণ অন্তরীণ, পাগল চিকিত্সা কেন্দ্রে আটক, কিংবা সাইবেরিয়ার শীতলতম স্থানে পাঠিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে অন্যদের ভীতির মধ্যে রাখত। এদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সোভিয়েট ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পুরোধা আঁদ্রে শাখারভের মতো পদার্থবিজ্ঞানী, সলজেনিিসনের মতো লেখকসহ হাজার হাজার সরকারবিরোধীরা নির্যাতনের শিকার হন।
এ নির্যাতনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে হেলসিংকি ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী সদস্য হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবাধিকার বাস্তবায়ন দাবি জানানোর অপরাধে সোভিয়েত ইউনিয়নে হেলসিংকি গ্রুপের ১১ প্রতিষ্ঠাতা এবং তাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে যোগদানকারী আরও দশ সদস্য চরম নির্যাতনের শিকার হন।
সোভিয়েত একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও নিপীড়ন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের গণমানুষের আজন্ম লালিত স্বপ্ন ও দাবি হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ দাবিতে পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষ বারবার রাস্তায় নেমেছে। কারাবরণ করেছে। জীবন দিয়েছে। সর্বোপরি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙে না এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয় না, যদি পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিত। ওইটাই ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে একমাত্র মুক্ত ও অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতেই মানুষ তাত্ক্ষণিক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এ কারণেই গণআন্দোলন শুরু হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তান ভাঙা তথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। অর্থাত্ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এদেশের মানুষ তাদের বাবা-দাদাদের প্রতিষ্ঠিত দেশ পাকিস্তান ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবের ভাষ্যমতে, ৩০ লাখ মানুষ তাদের জীবন উত্সর্গ করেন।
গণতন্ত্রের বাইরে কোনো কৌশল আমাদের দেশে প্রযোজ্য নয়। আজকে দেশে সরকার যা করছে, তা পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্রের হোতা আইউবি শাসনকেও হার মানিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের এমন বিকট চেহারা বিশ্বের কোথাও এর আগে দেখা যায়নি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেই যে একটি সরকার গণতান্ত্রিক হয় না, শেখ হাসিনার চেয়ে সারা বিশ্বের অন্য কোনো সরকার এমন উত্তমভাবে তা প্রমাণ করতে পারেনি। দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এর অবসান হওয়া উচিত।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক
noa@agni.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads