বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

দুই মন্ত্রীর তেলেসমাতি ও দুদক চেয়ারম্যানের কাণ্ড



সৈয়দ আবদাল আহমদ
দুই কীর্তিমান মন্ত্রী। একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, অন্যজন দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আরেক কীর্তিমান পুরুষ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। এই তিনজনই এখন মিডিয়ার ফোকাসে আছেন। সাম্প্রতিক কিছু কর্মের জন্যই তারা গণমাধ্যমে আলোচিত। সংবাদপত্রে প্রতিদিনই তাদের নিয়ে রিপোর্ট হচ্ছে, সম্পাদকীয় মন্তব্য বের হচ্ছে এবং বিশ্লেষকরা নানা পর্যবেক্ষণ লিখছেন। একইভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রাতের টকশো জুড়েই আলোচনার বিষয়বস্তু তারা।
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কীর্তি, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হবে। প্রকৃত খুনি হোক বা না হোক—তিনি ১০ অক্টোবরের আগেই সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ‘খুনিরা’ শনাক্ত হয়েছে এবং ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন পেশাদার খুনি। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কীর্তি, তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছেন, গণমাধ্যম তথা মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। কারণ মিডিয়া নাকি তার এবং তার পরিবারের চরিত্র হনন করেছে। রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা গাড়িচালক আজম খান ফাঁস করে দেয়ায় এবং মিডিয়া এগুলো প্রচার করায় নাকি তার এই সম্মানহানি হয়েছে। আর কীর্তিমান পুরুষ দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের কীর্তি হচ্ছে, তিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পক্ষে সাফাই গেয়েই ক্ষান্ত হননি, বলেছেন—পিয়ন-চাপরাশি কিংবা ড্রাইভারদের কথায় বিচারকার্য চলে না। তিন কীর্তিমানের এই বাণী সব পত্রিকাই গুরুত্ব সহকারে সচিত্র প্রতিবেদন করে প্রকাশ করেছে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড : তদন্তের ভাগ্য
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আট মাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। রাজধানী ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ফ্ল্যাটের বেডরুমে গত ১১ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে খুন হন তারা। এই খুন দেশব্যাপী প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাংবাদিক দম্পতির চাঞ্চল্যকর খুন নিয়ে আট মাসের কথামালার পর হঠাত্ বুধবার ৯ অক্টোবর নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলন করে জানান, সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত সন্দেহে সাতজনকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন পেশাদার খুনি। এরা হচ্ছে—রফিক, বকুল, মিন্টু ও সাঈদ। এই চারজনই মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ডা. নিতাই হত্যারও খুনি। তাদের ড্রাইভার কামরুলকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া সাংবাদিক দম্পতির ‘পারিবারিক বন্ধু’ তানভীর রহমান ও তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী রুদ্র ওরফে পলাশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেক নিরাপত্তাকর্মী হুমায়ূন কবীর ওরফে এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনের পরপরই সাংবাদিক সাগর ও রুনির পরিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছেন, আমরা কাহিনী শুনতে চাই না। আমরা চাই খুনের মোটিভ উদঘাটন করে প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করা হোক। তারা ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পেশাদার খুনি’দের গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘আইওয়াশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। রুনির পরিবার জানায়, তানভীর নামে যে যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে, সে তাদের পারিবারিক বন্ধু নয়। একই কথা জানিয়েছেন তানভীরের বাবা। রুনির ভাই ও হত্যা মামলার বাদী নওশের আলম রোমান সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। হত্যার কারণও তিনি বলেননি। তারা কোনো কাহিনী না সাজিয়ে প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার ও খুনের রহস্য উদঘাটন করার দাবি জানান। সাগর সারওয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, তদন্তের গতি-প্রকৃতি আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রশ্ন, ডা. নিতাই হত্যার আসামিদের সঙ্গে এ ঘটনার যোগসাজশ হলো কীভাবে? ঘটনার আট মাস পর ৭ আসামিকে ধরে তারা বলছেন ‘সন্দেহভাজন’। সন্দেহভাজনই যদি হবে তাহলে নিতাই হত্যার আগে তাদের কেন ধরা হলো না? তাহলে অন্তত ডা. নিতাই তো হত্যার শিকার হতো না। এসব গোঁজামিল আমরা চাই না। সাংবাদিক দম্পতির পরিবার আরও বলেছে, আট খুনির মধ্যে যদি সাতজন ধরাই পড়ে তাহলে খুনের মোটিভ কেন পরিষ্কার হবে না?
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গেছেন। ফলে আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে নানা প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হবে না। প্রকৃত খুনি কে তা হয়তো কোনোদিনই কেউ জানতে পারবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, চারজন সন্দেহভাজন পেশাদার খুনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এ পেশাদার খুনিদের কে নিয়োগ করেছে বা এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী—সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের কোনো জবাবই দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আবার বলেন, খুনের কারণ অজানা। খুনের মোটিভ নিয়ে অতিরিক্ত কিছু বলব না। কারণ এখনও হত্যাকাণ্ডটির তদন্ত চলছে। অর্থাত্ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুরো বক্তব্যটিই অস্পষ্ট এবং স্ববিরোধিতায় ভরা। সাংবাদিক নেতারাও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। তার বক্তব্যে এ হত্যা রহস্যের জট খোলেনি। সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন পেশাদার খুনিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পেশাদার খুনিরা তো নিজের ইচ্ছায় খুন করে না। তাদের কেউ টাকা দিয়ে খুনের জন্য ভাড়া করে। এই পেশাদার খুনিদের নিয়োগ করেছিল কে? কেন, কী উদ্দেশ্যে তারা এই সাংবাদিক দম্পতিকে খুন করিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এ কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তদন্তের অগ্রগতির তথ্য স্পষ্ট নয়। এতে হত্যা রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। সাংবাদিক নেতা রুহুল আমীন গাজী বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী। পেশাদার খুনিরা খুন করলে সাগর-রুনির বাসার কাজে ব্যবহৃত ছুরি দিয়ে তাদের এত আঘাত করা হবে কেন? পেশাদার খুনিরা শুধু একটি ল্যাপটপ চুরির জন্য এমনভাবে সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করবে কেন? ডা. নিতাই হত্যাকাণ্ডের খুনিরা আগেই গ্রেফতার হয়েছে। তারাই খুনি হলে এতদিনে তো হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এবং মোটিভও জানা হয়ে যাওয়ার কথা। তার মতে, অস্পষ্ট তথ্যের মধ্য দিয়ে সাংবাদিক দম্পতির প্রকৃত খুনিকে আড়াল করা এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যই এভাবে একটি সাজানো কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। এ কাহিনী আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজানোর মতোই একটি ঘটনা।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ঘটনাটি দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে। শুরু থেকেই সরকার ঘটনাটি নিয়ে এক ধরনের কথামালা এবং তামাশায় নেমেছে। হত্যাকাণ্ডের দিন ১১ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিচক্র গ্রেফতার হবে। এর দু’দিন পর আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বললেন, হত্যাকাণ্ডের তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম বললেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, খুনিদের গ্রেফতার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আবার বললেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত মনিটরিং করছেন। কিন্তু সবকিছু যে ফাঁকা বুলি, জানা যায় ঘটনার ৫৭ দিন পর হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই, তদন্তে আমরা ব্যর্থ। এরপর আদালত ঘটনাটি তদন্ত করতে র্যাবকে দায়িত্ব দেয়। সাগর-রুনি হত্যার পর লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক বলেছিলেন, ‘খুনের ধরন দেখে মনে হয় না, পেশাদার খুনিরাই হত্যা করেছে। কারণ লাশে ছোরার এত আঘাত। তাছাড়া ছুরিকাঘাতের ধরন ছিল এলোপাতাড়ি। পেশাদার খুনিরা সাধারণত এভাবে ছুরিকাঘাত করার কথা নয়। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৯ অক্টোবর এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পেশাদার খুনিদের কথাই জানালেন। গার্ড হুমায়ূন ওরফে এনামুলকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল এবং পরে ছেড়ে দেয়। আবার তাকে ধরার জন্য ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ কেনই তাকে ধরল আবার কেনই ছেড়ে দিল। আবার কেনইবা তাকে ধরার জন্য ১০ লাখ টাকা ঘোষণা করল—সবকিছুই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। আবার তানভীরকে জড়িয়ে এক ধরনের পরকীয়া কিংবা অন্য কোনো রহস্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। অর্থাত্ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের পুরো বিষয়টি নিয়েই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। রহস্যের জট খোলেনি। বিষয়টি কি ধামাচাপা দেয়ার আলামত? আর এই দায়িত্ব কি পড়েছে কীর্তিমান নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর?
সুরঞ্জিতের যত ক্ষোভ মিডিয়ার বিরুদ্ধে
যত দোষ, নন্দ ঘোষ। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, যিনি নিজেই নিজেকে ‘উজিরে খামাখা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তার বক্তব্য-বিবৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সবকিছুর জন্য মিডিয়াকেই দায়ী করছেন। মিডিয়ার ওপরই সব ক্ষোভ ঝাড়ছেন তিনি । মধ্যরাতের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গাড়িচালক আজম খানের বক্তব্য প্রচার করার কারণে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বললেন, আমার পরিবার ও আমার সুনাম রক্ষার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ইস্যুতে সত্য কথা বলার কারণে এটা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের জন্য পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে একবার দায়ী করেন, আবার ইঙ্গিত করেন দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার দিকে। আবার বলেন, আমি সুনির্দিষ্ট করে কাউকে দোষারোপ করছি না। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, সাংবাদিকরা নিশ্চয় তা বুঝতে পারছেন।
গত ৯ এপ্রিল রাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় যাচ্ছিল বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে একটি গাড়ি। সেই গাড়িতে ছিলেন সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক ও মন্ত্রণালয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। এই টাকা পিলখানার বিজিবি গেটে ধরা পড়ে। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ-বাণিজ্যের এই ঘুষের টাকা ধরা পড়ার পর দেশব্যাপী এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রেখে দিলে সুরঞ্জিত ফের রাজনীতিতে ফিরে আসেন এবং নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে নিজের অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালান। এমন এক অবস্থায় আরটিভিতে প্রচারিত হয় সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক আজম খানের চাঞ্চল্যকর সাক্ষাত্কার। অজ্ঞাত স্থান থেকে দেয়া এই সাক্ষাত্কারে আজম খান জানান, ৭০ লাখ টাকার বস্তা নিয়ে সেদিন রাতে তিনি গাড়িটি নিয়ে যাচ্ছিলেন সুরঞ্জিতের বাসায়। ওমর ফারুক ও ইউসুফ আলী মৃধা মন্ত্রীকে এই টাকা পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। এর আগেও কয়েক দফায় এ ধরনের টাকার বস্তা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনের বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। রেলের নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে মন্ত্রীর ঘুষের ভাগ ছিল ১০ কোটি টাকা। গাড়িচালক আরও জানায়, রেলের ঘুষের টাকাই মন্ত্রী সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেনের টেলিকম ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছে।
মন্ত্রী সুরঞ্জিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দুর্নীতি করেছেন বলেও গাড়ি চালক সাক্ষাত্কারে জানান।
আরটিভিতে চালক আজম খানের যখন সাক্ষাত্কার প্রচারিত হচ্ছিল, মন্ত্রী সুরঞ্জিত তখন ছিলেন সুনামগঞ্জে। সেখান থেকে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন এবং তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার বলে উল্লেখ করেন। তবে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আইএসআই, দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা মহলবিশেষের দিকে ইঙ্গিত করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা তিনি ঘোষণা দেননি। এমনকি অভিযোগকারী চালক আজম খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেননি। তার ঘোষণা মিডিয়ার বিরুদ্ধে। মিডিয়া কেন এই ঘুষ কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে দিল, এটাই তার ক্ষোভের কারণ। এজন্য মিডিয়ার বিরুদ্ধে তিনি মামলা করবেন। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত একজন কীর্তিমান মন্ত্রীই বটে!
দুদক চেয়ারম্যানের কীর্তিকথা
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের আজ্ঞাবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। এ অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হয়ে আসছে। সরকারের এবং মন্ত্রীদের একের পর এক দুর্নীতি মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও, এবং এ নিয়ে দেশে-বিদেশে হৈ চৈ পড়ে গেলেও দুদক একেবারেই নিশ্চুপ। এক লাখ কোটি টাকার বড় শেয়ার কেলেঙ্কারি দেশে ঘটে গেলেও দুদক এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ঘটে গেলেও দুদক তা অনুসন্ধান করে দেখার বিষয়টি উপলব্ধি করেনি। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ঘটনা তো বিশ্বব্যাপীই আলোচনার বিষয়। দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রীর চাকরি গেছে, উপদেষ্টা ও সচিবকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তিও বাতিল করে দেয়। কিন্তু এত বড় ঘটনা নিয়েও দুদক নিজ থেকে কোনো তদন্তে এগিয়ে আসেনি। বিশ্বব্যাংকের চাপের পরই শুধু এ নিয়ে তদন্তে রাজি হয়। এহেন প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। একবার তিনি নিজেই বলেছিলেন, দুদক হচ্ছে নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্র। অর্থাত্ এটি যে সরকারের ইশারায় চলে সেকথা তিনি নিজেই জানিয়ে দেন। তার প্রমাণও পাওয়া যায় তার কাছেই। সাবেক যোগযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করে সার্টিফিকেট দেন তিনি। তেমনি সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে ঘোষণা দেন। সর্বশেষ তার কীর্তি হচ্ছে গাড়ি চালক আজম খান যখন চাঞ্চল্যকর সাক্ষাত্কার দিয়ে জানাল যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রেলের নিয়োগ বাণিজ্যের ঘুষের টাকার ভাগ ছিল ১০ কোটি টাকা, তখন আগ বাড়িয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বললেন, পিয়ন-চাপরাশি বা ড্রাইভারের কথায় বিচার চলে না। তার এ কথা দায়িত্বশীল তো নয়ই, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় একে এক ধরনের দুর্নীতিও বলা চলে। মন্ত্রী থেকে নিয়ে বড় কর্মকর্তারা পর্যন্ত সামান্য চাপরাশিদের মাধ্যমেও নানা ধরনের দুর্নীতি করে থাকেন। কাজেই সেদিক দিয়েও ড্রাইভার বা চাপরাশি অগ্রাহ্যের ব্যাপার নয়। আর আজম খান সামান্য কোনো ড্রাইভার নন। মন্ত্রীর বাসায় ৭০ লাখ টাকার বস্তা যাচ্ছিল, আজম খান সেই টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাকে অগ্রাহ্যও করার কোনো উপায় নেই। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের ওই বক্তব্যটি বিস্ময়করই নয়, একটি কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য। এ ধরনের লোক দুর্নীতিতে জর্জরিত একটি দেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ায় দেশটির ভাগ্যে যে কী আছে তা সহজেই বোঝা যায়। পদ্মা সেতু, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক দুর্নীতি, ডেসটিনির লুটপাটসহ বড় বড় সাগর চুরির ঘটনা দুদক এই চেয়ারম্যানের অধীনে কতটা কি করতে পারবে তা বুঝতে কারো বাকি নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads