রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

গণমাধ্যম ও সরকারের শত্রুমিত্র



গোলাপ মুনীর
থমাস জেফারসন। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট (১৮০১-১৮০৯)। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রণেতা। তার আরেক পরিচয়, তিনি আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার। তিনি সরকারের চেয়ে সংবাদপত্রকেই অগ্রাধিকার দিতেন রোজ। তার সুপরিচিত একটি উক্তি হচ্ছে : Were it left to me to decide whether we should have a government without newspapers, or newspapers without a government, I should not hesitate a moment to prefer the latter.” Ñ তার কথা স্পষ্ট। তাকে যদি বলা হতো, আপনিই বেছে নিন সংবাদপত্রবিহীন সরকার অথবা ‘সরকারবিহীন সংবাদপত্র’Ñ এ দু’টির যেকোনো একটি। তা হলে তিনি এক মুহূর্তও  ইতস্তত না করে দ্বিতীয়টি নেয়াকেই অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এই প্রশ্নটি যদি প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনকে না করে আমাদের বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে করা হতো, তখন সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হয়, তিনি বোধ হয় এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রথমটিকে বেছে নিতেন। সোজা কথায় তিনি হয়তো তৎক্ষণাৎ বলতেনÑ ‘আমি চাই সংবাদপত্রহীন সরকার।’ এমনটি মনে হলো গত ১৬ অক্টোবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী-সংশ্লিষ্ট একটি খবর পড়ে। আর এ খবরের বিষয়বস্তু ছিল গণমাধ্যম। অন্যান্য সংবাদপত্রে  খবরটি ছাপা হলেও এ লেখকের সুযোগ হয়েছে তা একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে পড়ার। খবরটি পড়ে মোটামুটি যা জানা গেল তা হচ্ছেÑ গত ১৫ অক্টোবর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানটি ছিল আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা। আর এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। অন্যান্য সময়ের মতোই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের এই অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য যথারীতি দাওয়াতও করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেশির ভাগ বেসরকারি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের এ অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ করতে দেয়া হয়নি। তাদের অনুষ্ঠানস্থলে যেতে বাধা দেয়া হয়। সাংবাদিকেরা অবাক হন, যখন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে টেলিভিশন, মুদ্রণ মাধ্যম ও সংবাদ সংস্থাগুলোকে জানানো হয়, সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনুষ্ঠানস্থলে না যেতে। সংবাদ সংগ্রহে আগ্রহী সাংবাদিকদের একই সাথে পরামর্শ দেয়া হয়, তারা যেন সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) এবং সেই সাথে বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ও বিডিনিউজ২৪ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেন। উল্লেখ্য, ইউএনবি ও বিডিনিউজ২৪ সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের নীতির ধারক-বাহক বলে পরিচিত। এখানে সর্বশেষ উল্লেখ্য, একই সাথে ওই দিন সাংবাদিক ও টেলিভিশন ক্যামেরা ক্রুদের গাজীপুরের ইসলামিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও না যেতে বলা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও কিছু সংবাদপত্র প্রধানমন্ত্রী-সংশ্লিষ্ট খবরাখবর যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ না করার কথা বলে উষ্মা প্রকাশ করেন। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এখন থেকে তার কোনো অনুষ্ঠানে বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে কভার করতে দেবেন না। কারণ এসব টিভি চ্যানেল প্রধানমন্ত্রীর খবর সম্প্রচার করে তাদের বুলেটিনের সপ্তম অথবা অষ্টম অবস্থানে রেখে। গত কয়েক মাস ধরেই প্রধানমন্ত্রী এই বলে গণমাধ্যমের সমালোচনা করে আসছিলেন যে, গণমাধ্যমে সরকারের ভালো কাজগুলো, সরকারের অর্জনগুলো তুলে না ধরে শুধু সরকারের নিন্দাই করা হচ্ছে। তিনি টেলিভিশনের টকশোগুলোতে অংশগ্রহণকারীদেরও খোলাখুলি  সমালোচনা করেন। তিনি টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যরাতের  সিঁধ কাটা চোরের সাথে তুলনা করে তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তা ছাড়া এ সরকারের মন্ত্রীরা টকশোতে অংশ নিয়ে এসব অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র হনন করে বক্তব্য দেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের ওপর প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহের ব্যাপারে উল্লিখিত বিধিনিষেধ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনৈক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, কয়েকটা দিন এভাবে যেতে দিন, যাতে করে গণমাধ্যম উপলব্ধি করতে পারে, সরকারপ্রধানের খবরের গুরুত্ব কতটুকু। কিছু কিছু গণমাধ্যম এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য জানতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
এ দিকে এ ঘটনার দুই দিন পর গত ১৫ অক্টোবর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সাথে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ মতবিনিময় সভায় সম্পাদকেরা টিভি টকশোর বিষয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের বিরূপ মন্তব্য, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ও সংবাদপত্রগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান  কভার করতে না দেয়া এবং সাংবাদিকদের হুমকি-ধমকি দেয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ  প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, এগুলো গণতন্ত্র ও স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য বড় ধরনের অশনি সঙ্কেত। তাদের মতে, এটি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধেরই নামান্তর। তারা বলেন, টিভি টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের প্রধানমন্ত্রী মধ্যরাতের সিঁধ কাটা চোর-ডাকাতের সাথে তুলনা করেছেন।
সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই টকশোতে অংশ নিয়ে টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের চরিত্র হনন করে বক্তব্য দেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে দেয়া হচ্ছে না। স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর এটি সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্পাদকেরা আরো বলেন, টিভি টকশো বন্ধ করার মাধ্যমে মিডিয়ার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য আরো বিপজ্জনক।
টিভি মালিকদের সাথে বৈঠকের এক দিনের মাথায় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তথ্যমন্ত্রী। বৈঠকে তথ্যসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বৈঠকে অংশ নেয়া সম্পাদকেরা সাংবাদিকদের সামনে কোনো ধরনের তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অবশ্য এ বৈঠকে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকেরা আমন্ত্রণ পাননি। সে যাই হোক, একটা পত্রিকা জানিয়েছে, সম্পাদকেরা এ বৈঠকে মিডিয়ার ওপর সরকারের নানা ধরনের হস্তক্ষেপের বিষয়টি তথ্যমন্ত্রীকে অবহিত করেন। জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, যে সরকার মিডিয়া সহ্য করতে পারে না, সে সরকার জনগণের বন্ধু নয়। মিডিয়াবিরোধী সরকার হচ্ছে একটি বন্ধ্যা সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে না দেয়ার বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী এ বৈঠকে বলেছেন, কী কারণে বেসরকারি টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে দেয়া হচ্ছে না, আমি তা পরীক্ষা করে দেখব। এ বিষয়ে সম্পাদকদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। কিন্তু উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো সুযোগ কি আছে? কারণ তার সরকারের এ নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রবল সমালোচনা চললেও সরকার এ ব্যাপারে কোনো নমনীয়তা প্রকাশ করছে না। গত ১৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের ব্রিফিংয়েও ডাকা হয়নি সাংবাদিকদের। অথচ আমরা জেনে আসছি, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিটি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে ডাকা হতো সাংবাদিকদের। এবারই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের ডাকা হয়নি। তবে শুধু সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ও অনলাইন সংবাদ সংস্থা বিডিনিউজ২৪ডটকম ওই বৈঠকের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছে। কেন অন্যান্য টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকদের এই প্রেস ব্রিফিংয়ে ডাকা হলো না, তা জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদকে ফোন করে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি পরিচয় দিলে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অপর দিকে উল্লিখিত প্রেস ব্রিফিং দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি জানিয়েছেনÑ প্রেস ব্রিফিংয়ে পাঁচ-ছয়জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘ব্রিফিং করার দায়িত্ব আমার, কিন্তু সংবাদ সংগ্রহের জন্য কাদের কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, তা আমার জানা নেই।’
তথ্যমন্ত্রীর সাথে গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সম্পাদকদের বৈঠকে টিভি টকশো প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, টিভি টকশো বন্ধ করা হচ্ছে, এটি নিছক একটি গুজব। টিভি টকশো আগে যেভাবে চলেছে, ভবিষ্যতে একইভাবে চলবে। তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে একজন সম্পাদক বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রধানমন্ত্রী টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যরাতের চোরের সাথে তুলনা করেছেন। বিভিন্ন দফতর থেকে টিভিতে ফোন করে টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকা দেয়া হচ্ছে। কে টকশোতে বক্তব্য রাখবেন, সেটাও বলে দেয়া হচ্ছে।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে সরকারের সমালোচকেরা বলেছেন, সরকারের নানা অপকর্ম, অপশাসন ও দুর্নীতি যখন গণমাধ্যমে আজ ব্যাপকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তখনই গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হয়েছেন। অযাচিতভাবে গণমাধ্যমের কঠোর সমালোচনায় নেমেছেন। তিনি ভুলে গেছেন, এক-এগারোর পর অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিবিদের চরিত্র হননে মেতে উঠেছিল। তখন গণমাধ্যমই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। আজ যখন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের এই সময়টায় গণমাধ্যমের সুবাদে দেশবাসী সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের নানা দুর্নীতি, দুঃশাসন আর নানা কেলেঙ্কারির কথা জানতে পারছে, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে সহ্য করতে পারছেন না। ফলে তিনি চাইছেন টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রকে সর্বোপরি সাংবাদিকদের তার চার পাশ থেকে দূরে রাখতে। সৌভাগ্য দেশের সাধারণ মানুষের, গণমাধ্যম আছে বলেই আজ দেশের মানুষ জানতে পারছে বিরোধীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের স্বরূপ ও তীব্রতা। জানতে পারছে, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সম্পর্কিত সমস্যা, ভিওআইপি কেলেঙ্কারি, রেলমন্ত্রীর ঘুষ কেলেঙ্কারিসহ এমনি ধরনের নানা কেলেঙ্কারির কথা, যেগুলোর সাথে সরকারের রাঘব বোয়ালদের নাম বিশ্বাসযোগ্য যৌক্তিক কারণে উচ্চারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমের সুবাদে আমরা জানতে পারছি, গুম ও বিচার-বহির্ভূত নানা হত্যার কথা। জানতে পারছে, লিমনের ওপর অত্যাচারের করুণ কাহিনীর কথা। সরকারি দলের লোকদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হামলাবাজি, মামলাবাজি, দলবাজি, টেন্ডারবাজির কথা।
গণমাধ্যম না থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কখনোই সুযোগ হতো না এসব শোনার। তখন সরকারি দলের লোকজন এ ব্যাপারে আরো অদম্য হয়ে উঠত। সে জন্যই গণমাধ্যম আজ আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য চক্ষুশূল। দেশে আজ সত্যিকার অর্থে কী ঘটছে, তারই একটা ক্ষুদ্রচিত্র উঠে আসছে গণমাধ্যমে। কিন্তু সরকার চাইছে, গণমাধ্যমে শুধু থাক সরকারের জয়গান। সরকারের উন্নয়নকর্ম ও অর্জনের কথা। কিন্তু নিন্দুকেরা বলে, গণমাধ্যমে তো সরকারের অর্জনের কথাই তুলে ধরা হচ্ছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, মন্ত্রীদের ঘুষ কেলেঙ্কারি, ভিওআইপি কেলেঙ্কারিসহ নানা কেলেঙ্কারিÑ এসবই তো এ সরকারের নিজস্ব অর্জন।
আসলে দেশের গণমাধ্যমগুলো যা করছে, তা সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের দায়বোধ থেকেই করছে। সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের একটা বিশেষ দায়বোধ রয়েছে বলেই আমাদের জীবনে এর একটা বিশেষ স্থান সব মহলে স্বীকৃত। যদি বলি অন্ন-বস্ত্রের মতোই গণমাধ্যমও আমাদের প্রতিদিনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে মনে হয় ভুল বলা হবে না। বলা যাবে না, বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। গণমাধ্যমই সময়ের সাথে গোটা পৃথিবীটাকে ছোট থেকে ছোটতর করে তুলছে। রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও ইন্টারনেটের মতো গণমাধ্যম আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্বজনগোষ্ঠীর সাথে বৃহত্তর পর্যায়ে যোগাযোগ গড়ে তুলতে স্বল্পতম সময়ে। বিশ্বের কোথায় কোথায়, কখন, কী ঘটছেÑ গণমাধ্যমই তৎক্ষণাৎ আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে, সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে সংশোধনের সুযোগ করে দিচ্ছেÑ আমরা তখন সে পরিস্থিতি দৃষ্টিতে আমাদের করণীয় সাজাতে পারছি যথার্থভাবে। অতএব গণমাধ্যমকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সরকার থাকবে, গণমাধ্যম থাকবে না- এটা ভাবাও পাপ। সে জন্যই পৃথিবীর সব সভ্য সমাজে, সব দেশে অবাধ গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয়ে আসছে। ‘ফ্রি প্রেস’ তথা গণমাধ্যম আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম স্তম্ভ। গণমাধ্যম যদি জনগণের কাছে তথ্য সরবরাহ না করত, তবে সরকারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের জানার কোনো সুযোগ থাকত না। জানত না কোন পথে চলেছে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়। ফলে কাকে ভোট দেয়া উচিত, কাকে নাÑ সে সম্পর্কে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগও থাকত না দেশের মানুষের সামনে। বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রবেশের সুযোগই দেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তথা সামগ্রিক জ্ঞানকেই সম্প্রসারিত করে। সে সুবাদে জনগণকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আরো সচেতন করে তোলে। তাই ভোট দেয়ার সিদ্ধান্তে গণমাধ্যমের একটা প্রভাব আছে। সেজন্য খারাপ সরকার বরাবর গণমাধ্যমকে ভয় পায়। কারণ জনমতের ওপর গণমাধ্যমের একটা বড় মাপের প্রভাব রয়েছে। সেজন্য বলা হয়Ñ তথ্য ক্ষমতা না হলেও, ক্ষমতার কাছাকাছি একটা কিছু। এ সত্য উপলব্ধি থেকে বিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদী ও কমিউনিস্ট সরকারগুলো গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। আজকের দিনের সামরিক সরকার, স্বৈরসরকার কিংবা নির্বাচিত স্বৈরশাসকেরাও এ নীতি আঁকড়ে ধরে সচেষ্ট হয় দেশের গণমাধ্যমের ওপর  নানাভাবে নানা মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে।
আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় যায়, তখনই এ দলটির নেতা-নেত্রীর মধ্যে সে প্রবণতাই বাসা বাঁধে। আজকে যখন সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাসস এবং সরকার সমর্থক দু’টি বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ও বিডিনিউজ২৪Ñ এই চারটি বাদে বাকি সব টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের খবর কভার করতে দেয়া হচ্ছে না, তখন প্রশ্ন জাগেÑ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বাকশাল আমলের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে কি না? সে সময় সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা জানি ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন, তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ও ‘মেহনতি মানুষের সমাজতন্ত্র’ কায়েমের পরিকল্পনা করছেন। এরই সূত্র ধরে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করেন। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে চালু করেন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা। সংসদে উপস্থাপিত এ সংবিধান সংশোধনী বিল আধা ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়। সংশোধিত  সংবিধান মতে, প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা দেয়া হয় মন্ত্রিপরিষদ গঠনের। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এমপিদের ও এমপিদের বাইরে থেকে নেয়া যাবে। প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয় সর্বসময় ক্ষমতা। তার বিরুদ্ধে কোনো কিছু আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। অধিকন্তু প্রসিডেন্টকে ক্ষমতা দেয়া হয় সব রাজনৈতিক দল বাতিল করে একটিমাত্র জাতীয় দল গঠনের। শুধু যে দল ওই জাতীয় দলে যোগ দেবে সে দলের লোকেরাই রাজনীতি করতে পারবে। সংবিধানের এই সংশোধনের চার মাস পর শেখ মুজিব গঠন করেন সেই একক জাতীয় দল- বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ)।  বাকি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চারটি দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক, অবজারভার, দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস রেখে বাকি সব দৈনিক বন্ধ করে দেয়া হয়। আজকের এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগেÑ এই চারটির স্থান কি এবার দখল করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাসস, ইউএনবি ও বিডি নিউজ ২৪ ডটকম?
সবশেষে বলতে চাই, সরকার পক্ষের বদনাম হয় এমন সব খবরই গণমাধ্যমে আজকাল বেশি প্রকাশ করা হচ্ছে, সরকারের সাফল্য আর অর্জনের কথা গণমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে নাÑ এমনটিই অভিযোগ সরকার পক্ষের। সরকার যদি বদনাম সৃষ্টি হয় এমন সব ঘটনা না ঘটায়, এর বিপরীতে জনগণের কল্যাণের কথা, দেশের অগ্রগমনের কথা ভেবে ভালো ভালো কাজ করে, তবে গণমাধ্যম নিশ্চিতভাবেই তা তুলে ধরবে। কিন্তু সরকার যখন সব সুসংবাদকে দুঃসংবাদে রূপ দেয়, তখন সরকারের সন্তুষ্টি সৃষ্টিকর ইতিবাচক সব খবর প্রকাশের সুযোগ কি গণমাধ্যমের হাতে থাকে? অতএব সরকারের প্রতি সুপরামর্শ, নেতিবাচকতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে নিজেদের ইতিবাচক করে তুলুন। তখনই একমাত্র সম্ভব গণমাধ্যমকে শত্রু না ভেবে বন্ধু ভাবা। ভাবতে হবে সাংবাদিকেরাও সরকারের বন্ধু, একই সাথে দেশ ও সমাজের বন্ধু।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads